উত্তরাঞ্চলে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ লিটার উচ্চমাত্রার সিসাযুক্ত কনডেনসেট অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিনে মেশানো হচ্ছে। ভেজাল জ্বালানি তেল ব্যবহারের ফলে তেলচালিত যানবাহনের ইঞ্জিনসহ মূল্যবান যন্ত্রপাতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সেই সঙ্গে ঘটছে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়।
অন্যদিকে উচ্চমাত্রায় সিসাযুক্ত কনডেনসেটের (অপরিশোধিত তেল) অবৈধ ব্যবসা করে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট বছরে প্রায় ১৮০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিপিসির বাঘাবাড়ী ডিপো ও জ্বালানি তেল ব্যবসায়ী সূত্রে জানা যায়, কনডেনসেট থেকে জ্বালানী তেল উৎপাদনের অনুমতি পাওয়া পাঁচটি বেসরকারি রিফাইনারি কোম্পানি ভেজাল মেশানোর এ কাজটি করছে। আর এসব ভেজাল জ্বালানি তেল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অধীন তেল বিতরন কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার চোখ এড়িয়ে উত্তরাঞ্চলের তেল পাম্প, ডিলার ও দোকানদারদের কাছে পৌছে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম ডিলার ডিস্ট্রিবিউটরর্স এজেন্ট এন্ড পেট্রোল পাম্প ওনার্স এসোসিয়েশন বাঘাবাড়ী ঘাট শাখার একাধিক সূত্র জানিয়েছে, চট্রগ্রাম ও সিলেটের মমিন, মন্টু, রফিকসহ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হরিপুর, কৈলাশটিলা, রশিদপুর ও বিয়ানীবাজার গ্যাস ফিল্ড এবং বেসরকারি সুপার রিফাইনারি কোম্পানি, জেবি রিফাইনারি কোম্পানিসহ পাঁচটি রিফাইনারি কোম্পানির অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজসে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ লিটার উচ্চমাত্রায় সিসাযুক্ত কনডেনসেট এনে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীতে ভেজাল জ্বালানি তেল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের সদস্য আলোকদিয়ার গ্রামের মফিজ উদ্দিন, মতিন, শাহাজাদুরের অরুন, শাকতোলার আলম, হাফিজ, বাবু, নুকালীর বাবলু শেখ, সেলাচাপরি গ্রামের শাহিনসহ কয়েকজনের কাছে বিক্রি করছে।
পরে এই সিন্ডিকেট সদস্যরা ভেজাল জ্বালানি তেল উত্তরাঞ্চলের সাড়ে ৪০০টি তেল পাম্পসহ সহস্রাধিক ডিলারের কাছে পৌছে দিচ্ছে। প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই তারা ভেজাল তেলের রমরমা ব্যবসা করে আসছে। শাকতোলা গ্রামের আলম ভেজাল জ্বালানী তেলের ব্যবসার কথা অস্বীকার করে বলেন, সে কোম্পানি থেকে জ্বালানি তেল নিয়ে ব্যবসা করছে।
জানা যায়, গত ১৬ অক্টোবর শাহাজাদপুর থানা পুলিশ বাঘাবাড়ীতে কনডেনসেট ভর্তি তিনটি ট্যাংকলরি আটক করে। পরে জ্বালানি তেল ভেজালকারী চক্রের সদস্যদের তদবিরে ট্যাংকলরি তিনটি ছেড়ে দেওয়া হয়। শাহজাদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাসান শামীম ইকবাল ট্যাংকলরি ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সূত্র জানায়, হরিপুর, কৈলাশটিলা, রশিদপুর ও বিয়ানীবাজার গ্যাস ফিল্ড থেকে গ্যাস উত্তোলনের সময় গ্যাসের সাথে উচ্চমাত্রার সিসাযুক্ত কনডেনসেট (গ্যাসের সহজাত ক্রুড অয়েল) বেরিয়ে আসে। রিগ মেশিনে গ্যাস ও কনডেনসেট আলাদা হয়ে যায়। পরে উত্তোলিত কনডেনসেট রিফাইনারিতে রিফাইনের জন্য পাঠানো হয়। গ্যাস ফিল্ডগুলোতে উত্তোলিত কনডেনসেটের সঠিক হিসাব নেই। এ সুযোগে গ্যাস ফিল্ডের এক শ্রেণীর অসাধু কর্মকর্তা গোপনে উচ্চমাত্রার সিসাযুক্ত কনডেনসেট জ্বালানি তেল ভেজালকারীদের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছে।
জানা গেছে, অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিনে কনডেনসেট মেশানোর উদ্দেশ্য বেশি মুনাফা করা। এক লিটার কনডেনসেটের দাম ৫০.৫০ টাকা। আর এক লিটার অকটেনের দাম ৯৬.০১ টাকা, পেট্রোল ৯২.১৫ টাকা, ডিজেল ৬৫.৮১ টাকা ও কেরোসিনের দাম ৬৬.৬১ টাকা। অধিক মুনাফার লোভেই জ্বালানি তেলে কনডেনসেট মেশানো হচ্ছে। যমুনা সেতুতে চেক পোস্ট বসালে পাচার হয়ে আসা কনডেনসেট হাতেনাতে ধরা যাবে বলে বিপিসির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে।
বাঘাবাড়ীতে জ্বালানি তেল ব্যবসার সঙ্গে জড়িত একটি সূত্র জানায়, উত্তরাঞ্চলে প্রতিদিন দুই লাখ লিটার কনডেনসেট জ্বালানি তেলে মেশানো হচ্ছে। প্রতি লিটার জ্বালানি তেলে ২৫ টাকা হিসেবে দৈনিক ৫০ লাখ টাকা লাভ করছে। সেই হিসেবে মাসে ১৫ কোটি টাকা এবং বছরে ১৮০ কোটি টাকা প্রভাবশালী চক্রটি হাতিয়ে নিচ্ছে। ভেজাল তেল ব্যবহার করায় যানবাহনের ইঞ্জিনসহ মূল্যবান যন্ত্রপাতির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সেই সাথে পরিবেশের ভয়াবহ দূষণ ঘটছে।
এ ছাড়া গ্যাস চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কমপ্রেসারের সাহায্যে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। কমপ্রেসারের চাপে গ্যাসের গাদ ট্যাংকিতে জমা হয়। সেই গাদ প্রতি লিটার ২২ টাকা দরে বিক্রি হয়। আর অসাধু ব্যবসায়ীরা ২২ টাকা লিটারের গাদ পেট্রোলে মিশিয়ে ৯২.১৫ টাকা দরে বিক্রি করছে বলে সূত্রে জানা গেছে।
জানা যায়, বাংলাদেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাসের সহজাত হিসেবে কনডেনসেট উৎপন্ন হয়। পরে গ্যাসের এই উপজাত পরিশোধন করে অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিন প্রভৃতি পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করা হয়। কনডেনসেট থেকে পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদনের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান রুপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিজিএল) রয়েছে।
এর বাইরে সরকার পাঁচটি বেসরকারি কোম্পানিকে কনডেনসেট রূপান্তরের দায়িত্ব দিয়েছে। এসব বেসরকারি কোম্পানি কনডেনসেট থেকে অক্টেন, পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিনসহ বিভিন্ন পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদন করে। অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিন খোলাবাজারে বিক্রির কোন বিধান নেই। বেসরকারি রিফাইনারি কোম্পানিগুলো পরিশোধিত জ্বালানি তেল বিপিসির পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা এই তিনটি কোম্পানি কাছে বিক্রি করবে।
জানা যায়, কনডেনসেটের রং হুবহু ফিল্টার পানির মতো। গ্যাসের এই উপজাত অকটেন, পেট্রোল, ডিজেল ও কেরোসিনের সাথে মেশালে বোঝার উপ্য়া নেই যে সেটি ভেজাল। বেশি মুনাফার আশায় কিছু বেসরকারি তেল রিফাইনারি কোম্পানি ও গ্যাস ফিল্ডের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা একটি প্রভাবশালী চক্রের যোগসাজসে উচ্চমাত্রায় সিসাযুক্ত কনডেনসেট সরাসরি জ্বালানি তেলে মেশাচ্ছে।
এই ভেজাল জ্বালানি তেল দেশের বিভিন্ন স্থানে পেট্রোল পাম্প ও ডিলারদের কাছে গোপনে বিক্রি করছে। যমুনা সেতু হয়ে প্রতিরাতে ৪০ থেকে ৫০ লরি (প্রতি লরির ধারণ ক্ষমতা নয় হাজার থেকে সাড়ে ১৩ হাজার লিটার) উচ্চমাত্রার সিসাযুক্ত কনডেনসেট উত্তরাঞ্চলে ঢুকছে। পরে এই কনডেনসেট এ অঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় তেল পাম্প, ডিলার এবং খুচরা দোকানদারদের কাছে গোপনে বিক্রি করা হচ্ছে।
এদিকে বিপিসির উত্তরাঞ্চলের বাঘাবাড়ী, পারবর্তীপুর, রংপুর, রাজশাহী ও হরিয়ানা অয়েল ডিপোর পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা কোম্পানী থেকে উত্তরাঞ্চলে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, নওগাঁ, গাইবান্ধা, রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, পঞ্চগড়, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ, নাটোর ও রাজশাহী জেলায় প্রতিদিন প্রায় ২২ লাখ লিটার জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হয়। এ অঞ্চলে কনডেনসেট পাচার হয়ে আসায় এই পাঁচটি ডিপোতে জ্বালানি তেল বিক্রি কমে গেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান ইউনুসুুর রহমান বেসরকারি কোম্পানিগুলো জ্বালানি তেলে কনডেনসেট মিশিয়ে গোপনে বিক্রি করছে এ অভিযোগ স্বীকার করে বলেন, বিপিসি যখন বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে তেল নেয়, তখন সেই তেলের মান পরীক্ষা করে নেওয়া হয়। জ্বালানি তেলে ভেজাল মেশানো মারাত্মক অপরাধ।
তিনি জানান, জ্বালানী তেলে ভেজাল নিয়ে গত ৪ জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বিপিসি, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ও জ্বালানি মন্ত্রনালয়ের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বৈঠক হয়। তবে বৈঠকে কোন পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়নি।
জ্বালানি তেলে কনডেনসেট মেশানোর অভিযোগ সম্পর্কে সুপার রিফাইনারি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আহমেদের কাছে জানার জন্য তার দুটি মোবাইল ফোনে কল করে বন্ধ পাওয়া যায়। ফলে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। রশিদপুর কনডেনসেট ফ্রাকশনেশন প্লান্টের ব্যবস্থাপক (সমন্বয়) মোঃ নজরুল ইসলামের মোবাইল ফোনে কল করা হয়। কিন্তু তিনিও ফোন রিসিভ করেননি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ সিসাযুক্ত ভেজাল তেলের কারনে মূল্যবান গাড়ি নষ্ট হচ্ছে। আর সৃষ্ট ধোঁয়া মানবদেহের অপূরণীয় ক্ষতি করছে। কনডেনসেট মেশানো জ্বলানি দিয়ে গাড়ি চালালে গাড়ির ইঞ্জিন কাঁপে এবং দ্রুত নষ্ট হয়। কনডেনসেট মিশ্রিত জ্বালানি তেল ব্যবহার করে সাধারন মানুষ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।