ঢাকা: সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পেনশনের পুরো টাকা যাঁরা তুলে নিয়েছিলেন, তাঁরাও এখন মাসিক পেনশন পাবেন। শুধু তা-ই নয়, প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্টও (বার্ষিক বৃদ্ধি) পাবেন তাঁরা। ভোটের আগে এই সিদ্ধান্ত দিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ গতকাল সোমবার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।
অবসরে যাওয়া সরকারি কর্মচারীদের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার সিদ্ধান্তটি নিয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়। ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর। বর্তমানে তাঁরা মাসিক পেনশন পান না। তাঁরা কেবল দুটি উৎসব ভাতা, বাংলা নববর্ষ ভাতা ও মাসিক চিকিৎসা ভাতা পান। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, শতভাগ পেনশন সমর্পণকারী, অর্থাৎ যেসব সরকারি কর্মচারী পেনশনের পুরো টাকা তুলে নিয়েছেন, অবসরের তারিখ থেকে ১৫ বছর পার হলে তাঁরা আবার মাসিক পেনশন পাবেন।
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম গত রাতে বলেন, আসল কথা হচ্ছে সামনে নির্বাচন। সরকারি কর্মচারীদের খুশি করতে আগে গাড়ি-বাড়ির সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এবার পেনশন সুবিধা। এটা তেমনই একটি সহানুভূতি আদায়ের চিন্তা থেকে হয়ে থাকতে পারে। অর্থাৎ শুধু বর্তমান সরকারি কর্মচারী নন, সাবেক কর্মচারীদের কথাও সরকার চিন্তা করে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য গত ২৪ সেপ্টেম্বর ভারপ্রাপ্ত অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার ‘শতভাগ পেনশন সমর্পণকারী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের পেনশন পুনঃস্থাপন’ শীর্ষক একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেন। প্রধানমন্ত্রী সারসংক্ষেপ অনুমোদন করেন ৩ অক্টোবর।
বাস্তবে শতভাগ পেনশন তুলে নেওয়া সরকারি কর্মচারীদের মাসিক পেনশন পাওয়ার সুযোগ নেই। অর্থ বিভাগের সারসংক্ষেপে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত মন্তব্য করেন, ‘শতভাগ পেনশন সমর্পণকারী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীরা কোনো দাবি করতে অপারগ। তবে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করে তাঁদের অতিরিক্ত পেনশন দেওয়া যেতে পারে।’
তবে পুরো পেনশন তুলে না নিয়ে যাঁরা অর্ধেক বা আংশিক তুলে নিয়েছিলেন, সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত তাঁদের জন্য অমানবিক হয়েছে বলে জানান অবসরে যাওয়া কয়েকজন কর্মচারী।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার গত রাতে বলেন, ‘সিদ্ধান্তটি আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিল। বরং যে সুবিধাটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা অপ্রতুল।’
অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়, শতভাগ সমর্পণকারী পেনশনার্স ফোরাম, বাংলাদেশ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী কল্যাণ সমিতি ও অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার্স কল্যাণ অ্যাসোসিয়েশন নামের তিনটি সংগঠন দুই বছর আগে দাবির পক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানায়। ২০১৭ সালের ২ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকও করে তারা।
প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপিত সারসংক্ষেপে দাবির পক্ষে সংগঠনগুলোর যুক্তি তুলে ধরেছে অর্থ বিভাগ। যুক্তিগুলো হচ্ছে কেউ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, অনেকে ব্যবসা করতে গিয়ে লোকসান করেছেন, কেউ জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন, কেউ কেউ আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে প্রতারিত হয়েছেন, অনেকে নিজের সন্তানদের কাছ থেকে আশ্রয় হারিয়েছেন। কারও কারও থাকার জায়গা এখন বৃদ্ধাশ্রম।
পেনশনের পুরো টাকা একবারে তুলে নেওয়ার পদ্ধতিটি ১৯৯৪ সালে শুরু হয়। কিন্তু ২০১৭ সালের ১ জুলাই থেকে বাধ্যতামূলক নিয়ম করা হয় যে মোট পেনশনের ৫০ শতাংশ তুলে নেওয়া যাবে, বাকি ৫০ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে জমা রাখতে হবে।
অর্থ বিভাগের সারসংক্ষেপ অনুযায়ী, ১৯৯৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১ লাখ ৭ হাজার ৬৬২ জন সরকারি কর্মচারী পেনশনের পুরো টাকা তুলে নিয়েছেন। তবে অবসর নেওয়ার ১৫ বছর পার হয়েছে, এমন কর্মচারীর সংখ্যা ১৯ হাজার ৫৩৮। তাঁদের জন্য নতুন সুবিধাটি কার্যকর করতে গেলে ১৩৯ কোটি টাকা ব্যয় হবে। তবে ইনক্রিমেন্টসহ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তাঁদের জন্য বাড়তি ৭ কোটি, অর্থাৎ ১৪৬ কোটি টাকা লাগবে।
এর আগে চাকরি স্থায়ী হওয়া সব সরকারি কর্মচারীর জন্য ১ অক্টোবর থেকে বাড়ি তৈরি বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণের সুবিধা দিয়েছে সরকার। ঋণের বিপরীতে কর্মচারীদের পরিশোধ করতে হবে ৫ শতাংশ সুদ। বাকি সুদ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভর্তুকি হিসেবে দেওয়া হবে। অর্থ বিভাগের একটি হিসাব বলছে, বছরে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা করে।
গৃহঋণের আগে উপসচিব থেকে শুরু করে তারও উচ্চ পদের সরকারি কর্মচারীদের গাড়ি কেনার জন্য সরকার এককালীন ৩০ লাখ টাকা করে ঋণ দিয়ে আসছে। ‘বিশেষ অগ্রিম’ নামের এই ঋণের বিপরীতে তাঁদের কোনো সুদ দিতে হচ্ছে না। এমনকি সেই টাকা দিয়ে কেনা গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ, তেল খরচ ও চালকের বেতন বাবদ সরকার তাঁদের আরও দিচ্ছে মাসে ৫০ হাজার টাকা করে।