বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, আইনজীবীসহ প্রায় তিন লাখ মানুষের বিরুদ্ধে সারা দেশে সেপ্টেম্বর মাসে দায়ের করা প্রায় চার হাজার মামলার তদন্তে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিশন গঠনের নির্দেশনা চেয়ে করা রিটের শুনানি শেষ হয়েছে। আজ মঙ্গলবার এ বিষয়ে আদেশ দেবেন হাইকোর্ট।
বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো: আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল সোমবার আদশের জন্য এ দিন ধার্য করেন। শুনানিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা প্রায় চার হাজার মামলায় মৃত ব্যক্তি কিংবা সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীদের আসামি করায় পুলিশের ভাবমর্যাদা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে হাইকোর্ট বলেছেন, এ ধরনের মামলায় (গায়েবি) পুলিশের ভাবমর্যাদা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের বিরুদ্ধে এমন (গায়েবি) মামলা হলে জনগণের কাছে কী মেসেজ যাবে?
আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, জয়নুল আবেদীন, মাহবুব উদ্দিন খোকন, সুব্রত চৌধুরী, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, মাসুদ রানা প্রমুখ। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
শুনানির শুরুতে কয়েকটি মামলার এজাহার পর্যবেক্ষণ করে হাইকোর্ট বলেন, এ ধরনের মামলায় (গায়েবি) পুলিশের ভাবমর্যাদা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়। খন্দকার মাহবুব হোসেনের মতো লোকদের বিরুদ্ধে এমন মামলা হলে জনগণের কাছে কী মেসেজ যাবে?
এরপর প্রবীণ আইনবিদ ও অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন শুনানি করেন। আদালতকে প্রশ্ন রেখে বলেন, খন্দকার মাহবুব হোসেনের মতো জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা কি ঢিল বা ককটেল ছুড়তে পারেন? এসব করে জনগণের কাছে পুলিশের কী ধরনের মেসেজ যাচ্ছে। সাতটি মামলার এজাহার তুলে ধরে রিট আবেদনকারীর আইনজীবী ড. কামাল হোসেন বলেন, যেসব গায়েবি মামলা হয়েছে সেগুলোর অভিযোগ একই, গৎবাধা। তিনি বলেন, মামলাগুলো আমি দেখেছি। মামলায় যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা ভিত্তিহীনও কাল্পনিক। এ রকম কোনো ঘটনা ঘটেনি। এসব মামলার অভিযোগ একই ধরনের। অভিযোগগুলো অস্পষ্ট। আর জব্দকৃত যে আলামতের কথা বলা হচ্ছে সেগুলোও একই। তিনি বলেন, খন্দকার মাহবুব হোসেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি। সিনিয়র আইনজীবী। তিনিও নাকি পুলিশের বিরুদ্ধে ইটপাটকেল ছুড়েছেন? ড. কামাল বলেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে এ ধরনের মামলা করা হয়েছে; যা সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। এ পর্যায়ে আদালত কয়েকটি মামলার এজাহার পর্যালোচনা করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, খন্দকার মাহবুব হোসেন একজন সিনিয়র আইনজীবী। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে তিনিও ককটেল মেরেছেন? এটি হাস্যকর।
আদালত বলেন, ফৌজদারি মামলা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ঘটনা সত্য কিন্তু রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তির কারণে মামলার মেরিট নষ্ট হয়ে যায়। এ পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল বলেন, উনি (খন্দকার মাহবুব) তো শুধু আইনজীবীই নন একটি রাজনৈতিক দলেরও পদে আছেন। তখন আদালত বলেন, আপনি এটি কী বললেন? আইনজীবী হলে কি রাজনীতি করা যাবে না? আইনে কোনো বিধিনিষেধ আছে? আইনজীবীরাই তো আগে রাজনীতিতে বেশি সক্রিয় ছিল।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে আদালত বলেন, আপনি যদি নির্দেশনা দিতেন তাহলে এ ধরনের মামলা হতো না। এতে পুলিশের ভাবমর্যাদা নষ্ট হচ্ছে। শুনানির শেষ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল সময় চাইলে আদালত আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত মামলাটি মুলতবি করেন এবং ওই দিন অ্যাটর্নি জেনারেলের শুনানি শেষে আদেশ দেবেন বলে জানান।
গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে ২০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন থানায় বিএনপিসহ বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে তিন হাজার ৭৩৬টি মামলা করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে তিন লাখ ১৩ হাজার ১৩০ জনকে।
প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, সাবেক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী ও অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়ার পক্ষ থেকে গত ২২ সেপ্টেম্বর এ রিট দায়ের করেন অ্যাডভোকেট একে খান।
রিট আবেদন দায়েরের পর খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের আইনজীবীরা যাতে খালেদা জিয়ার মামলা না করতে পারে এবং আগামী নির্বাচনের সময় বিএনপি নেতাকর্মীরা যাতে ঘরে না থাকতে পারে সে আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্য এসব মামলা করা হয়। খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে সারা দেশে ঢালাওভাবে এ ধরনের কাল্পনিক মামলা করার উদ্দেশ্যে হচ্ছে বিরোধী দলকে চাপে রেখে বিরোধী নেতাকর্মীদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করা। আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ বিরোধীদল যাতে মাঠে থাকতে না পারে সেজন্য এসব মামলা করা হয়েছে। এ ধরনের মামলা সঠিক হয়েছে কিনা তা তদন্ত করতে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিশন গঠন করার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। রিটে ভবিষ্যতে এ ধরনের কাল্পনিক মামলা করে যেন হয়রানি না করা হয় তার নির্দেশনা জারির আবেদন করা হয়েছে। যারা এ ধরনের মামলা করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আবেদনও করা হয়েছে রিটে।
আইনজীবীরা জানান, ১০ বছর আগে মারা গেছেন এমন লোকদেরও এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনকে একই জায়গায় পরপর তিন থেকে চার দিনে চার-পাঁচটি মামলায় আসামি দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রত্যেকটি মামলায় তিনি ককটেল বিস্ফোরণের আসামি। তার মতো ব্যক্তি সন্ধ্যার পরে গিয়ে ককটেল ছুড়তে পারেন এটি আদৌ কি বিশ্বাসযোগ্য? ২০০৭ সালে মারা গেছেন, কিংবা চলতি বছর হজে ছিলেন, বিদেশে থাকেন- এমন লোকদের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে।
আইনজীবীরা আরো বলেন, আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্য দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত যত গায়েবি মামলা দেয়া হয়েছে সেগুলোর তদন্ত বন্ধ এবং এ গায়েবি মামলাগুলোর বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক উচ্চপর্যায়ের কমিটি করে ঘটনার তদন্ত করা এবং তাদের বিরুদ্ধে পরে যেন এ ধরনের মামলা দেয়া না হয়, তার নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ব্যতীত অন্য রাজনৈতিক দলের অগণিত নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে পুলিশি ক্ষমতা অপব্যবহার করে গায়েবি বা আজগুবি মামলা দায়ের করা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, রিটে সে বিষয়ে রুল জারির আরজি জানানো হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিব, পুলিশের আইজি, ডিএমপি কমিশনার, ডিএমপি রমনা জোনের ডেপুটি ও অতিরিক্ত ডেপুটি কমিশনার, রমনা, পল্টন ও শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ ৯ জনকে এই রিটে বিবাদি করা হয়েছে।
রিট আবেদনে সেপ্টেম্বর মাসে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে আবেদনকারী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অগণিত মানুষের বিরুদ্ধে ‘কাল্পনিক’ মামলা করা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, এই ধরনের ‘কাল্পনিক’ মামলাকারী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিবাদিদের কেন নির্দেশ দেয়া হবে না এ মর্মে রুল জারির আর্জি জানানো হয়েছে। এ রুল বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায় আবেদনকারীসহ বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে পরে এ ধরনের মামলা দায়ের থেকে বিরত থাকতে এবং এ ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের একটি স্বাধীন তদন্ত কমিটি (যার মধ্যে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের প্রতিনিধি রাখা) গঠনের নির্দেশনা জারির আবেদন করা হয়। এ ছাড়াও রুল বিবেচনাধীন থাকা অবস্থায় আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে করা এসব মামলার তদন্ত থেকে পুলিশ যাতে বিরত থাকে সে নির্দেশনা জারির আর্জি জানানো হয়।