মিয়ানমারের সরকারি ওয়েবসাইটে দেশটির মানচিত্রে বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ সেন্টমার্টিনকে অন্তর্ভুক্ত দেখানোর বিষয়টি বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। রাষ্ট্রদূত এটি ভুলবশত হয়ে থাকতে পারে বলে উল্লেখ করেছেন। প্রশ্ন হলো এ সংবেদনশীল বিষয়টি আসলেই কি ভুল? নাকি এর পেছনে অন্য কোনো রহস্য রয়েছে।
কোরাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন বা এর সাথে সংলগ্ন ছেঁড়াদ্বীপের মালিকানা নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে কোনো অনিষ্পন্ন বিরোধ নেই। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে যে বিরোধ ছিল সেটি আন্তর্জাতিক আদালতে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে কয়েক বছর আগেই। আদালতের রায়ে দুই দেশের সমুদ্রসীমা স্পষ্ট করে টানা হয়েছে। এরপরও এ দ্বীপ নিয়ে নেইপিডোর উসকানিমূলক কাজের পেছনে কোনো না কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে।
মিয়ানমার সে দেশের ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গা অধিবাসীকে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। ৮০-এর দশকে নিজস্ব নাগরিকত্ব আইন বানিয়ে তাদের অনাগরিক ঘোষণা করা হয়েছে। সর্বশেষবার রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো গণহত্যা বা জাতিগত নিপীড়ন নিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সু চির সরকার তীব্র চাপের মুখে রয়েছে। এ ব্যাপারে দৃষ্টি অন্য দিকে সরিয়ে নিয়ে নতুন একটি ইস্যু তৈরি করার চেষ্টা হয়ে থাকতে পারে মিয়ানমারের মালিকানা দাবির মধ্য দিয়ে। কিন্তু সেন্টমার্টিনের মতো বিরোধহীন একটি ইস্যুকে চাঙ্গা করে রোহিঙ্গা নিপীড়ন বা জাতিগত নির্মূলের দায় থেকে কি রেহাই পাওয়া যাবে?
কূটনৈতিক সূত্রের আভাস অনুসারে সেন্টমার্টিনের মালিকানা দাবি একটি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে করা হয়েছে। আর এটি হলো মিয়ানমারের একেবারেই নিকটবর্তী। এ দ্বীপটিতে যাতে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো দেশ সামরিক উপস্থিতি বা ঘাঁটি করার সুযোগ না পায়। মিয়ানমার ও দেশটির প্রধান মিত্র চীনের ভীতি রয়েছে যে, বাংলাদেশের কোনো সরকার রোহিঙ্গা সঙ্কটের কারণে সৃষ্ট নিরাপত্তা ঝুঁকি কমাতে সেন্টমার্টিনে যুক্তরাষ্ট্রকে ঘাঁটি দেয়ার ব্যাপারে চুক্তি করে বসতে পারে। সরকারি দলের কোনো কোনো নেতা বিএনপি আমেরিকার সাথে এ ধরনের একটি সমঝোতায় গেছে বলে দাবি করে বেইজিংকে ভয়ভীতির মধ্যে রাখতে চায়। বিরোধীপক্ষের ক্ষমতায় যাওয়ার ব্যাপারে সেন্টমার্টিনকে ঘিরে বিতর্ক তৈরি করা হলে এর সুফল শাসক দলের পক্ষে যাবে বলে মনে করা হয়। সেন্টমার্টিনে মিয়ানমারের মালিকানা দাবির মতো পদক্ষেপ সেখানে কথিত সামরিক সুবিধা দেয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের যেকোনো সরকারকে চাপে ফেলবে বলে নেইপিডোর ধারণা থাকতে পারে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা অন্য কোনো সূত্র সেন্টমার্টিনে কোনো দেশকে সামরিক সুবিধা দেয়ার মতো কোনো বিষয় সরকারের বিবেচনায় রয়েছে বলে মনে করে না। অবশ্য সেন্টমার্টিনে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের ব্যাপারে সরকারের বিধিনিষেধ রয়েছে। এর সাথে মিয়ানমারের আশঙ্কার বাস্তব কোনো সংযোগ রয়েছে কি না জানা যায়নি।
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের ভূখণ্ড টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটারের মতো দক্ষিণে অবস্থিত সেন্টমার্টিন দ্বীপটি স্থানীয়দের কাছে নারিকেল জিঞ্জিরা বা দারুচিনি দ্বীপ হিসেবে পরিচিত। ২৫০ বছর আগে আরব নাবিকেরা প্রথম এ দ্বীপে বসবাস করেন। তারা এর নাম দেন ‘জাজিরা’। ব্রিটিশ শাসনের সময় এর নাম দেয়া হয় সেন্টমার্টিন দ্বীপ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শেখ বখতিয়ার উদ্দিন এবং অধ্যাপক মোস্তফা কামাল পাশা সেন্টমার্টিন দ্বীপ নিয়ে গবেষণা করেছেন। অধ্যাপক বখতিয়ার বলেন, প্রায় ৫০০০ বছর আগে টেকনাফের মূল ভূমির অংশ ছিল জায়গাটি। কিন্তু ধীরে ধীরে এটি সমুদ্রের নিচে চলে যায়। এরপর প্রায় ৪৫০ বছর আগে বর্তমান সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণ পাড়া জেগে ওঠে। এর ১০০ বছর উত্তর পাড়া এবং পরবর্তী ১০০ বছরের মধ্যে বাকি অংশ জেগে ওঠে।
ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯০০ সালে ভূমি জরিপের সময় এ দ্বীপটিকে ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়া হয়। সে সময়টিতে বার্মা ব্রিটিশ শাসনের আওতায় ছিল। কিন্তু তারপরও সেন্টমার্টিন দ্বীপকে বার্মার অন্তর্ভুক্ত না করে ব্রিটিশ-ভারতের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এর আগে ১৮২৪ থেকে ১৮২৬ সালে ব্রিটিশদের সাথে বর্মী রাজার যে যুদ্ধ হয় তাতে বিতর্কের ইস্যুগুলোর মধ্যে এ দ্বীপের মালিকানাও একটি ছিল। সেন্টমার্টিন দ্বীপের আয়তন আট বর্গকিলোমিটারের মতো। এর সাথে সংলগ্ন ছেঁড়াদ্বীপটির মিয়ানমারের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় উপকূল থেকে দূরত্ব মাত্র আট কিলোমিটার। ভাটির সময় দু’টি দ্বীপ এক হলেও জোয়ারের সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।