প্রথম হুইল চেয়ারে খালেদা

Slider সারাদেশ


ঢাকা: চিকিৎসার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পরিত্যক্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে স্থানান্তর করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে। আদালতের নির্দেশে কারাকর্তৃপক্ষ গতকাল বিকালে তাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের তত্ত্বাবধানে তাকে হাসপাতালের কেবিন ব্লকে ভর্তি করা হয়। তিনি বর্তমানে কেবিন ব্লকের ৬ষ্ঠ তলায় ৬১১ নম্বর ভিআইপি কেবিনে চিকিৎসাধীন। তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান হিসেবে রয়েছেন বিএসএমএমইউ’র ইন্টারন্যাল মেডিসিন বিভাগের প্রফেসর ডা. মো. আবদুুল জলিল চৌধুরী। খালেদা জিয়ার চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে আজ দুপুরে মেডিকেল বোর্ডের সদস্যরা বৈঠক করবেন। বৈঠকের সিদ্ধান্তের পর তার আনুষ্ঠানিক চিকিৎসা শুরু হবে। তবে বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড পুনর্গঠনের সময় আদালতের নির্দেশনা মানা হয়নি বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। এদিকে কারাগার থেকে পুলিশের একটি সাদা রঙের পেট্রোল কারে করে খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে আনার পর হুইল চেয়ারে বসিয়ে কেবিন ব্লকের নির্ধারিত কক্ষে নেয়া হয়। এ সময় হাসপাতাল প্রাঙ্গণে জড়ো হয়ে তার মুক্তির দাবিতে স্লোগান দিয়েছেন বিএনপি ও অঙ্গদলের কয়েকশ’ নেতাকর্মী।

হুইল চেয়ারে খালেদা জিয়া : বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে হাসপাতালের উদ্দেশে বিকাল তিনটা ১০ মিনিটে কারাগার থেকে বের করা হয়। তিনটা ৪০ মিনিটে বিএসএমএমইউতে পৌঁছে খালেদা জিয়াকে বহনকারী ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (রমনা জোন) সাদা রংয়ের একটি পেট্রোল কার। সামনে পেছনে পুলিশ ও র‌্যাবের পাহারায় কারাগার থেকে হাসপাতালে আনতে বৃষ্টির কারণে অতিবাহিত হয় ৩০ মিনিট সময়। বিকাল সাড়ে তিনটা থেকে অনবরত বৃষ্টির কারণে হাসপাতালের কেবিন ব্লকের সামনে অবস্থান নেয়া নেতাকর্মী ও সাংবাদিকরা দুইপাশের ভবনের নিচে আশ্রয় নেন।

এ সময় তাদের সামনে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে নিরাপত্তা দেয়াল তৈরি করে পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যরা। খালেদা জিয়াকে বহনকারী পুলিশের পেট্রোল কারটি কেবিন ব্লকের সামনে পৌঁছাতেই কারারক্ষীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা চারদিকে কয়েক স্তরে দাঁড়িয়ে যান। ওই অবস্থায় খালেদা জিয়াকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনতে দুই মিনিটের মতো সময় অতিবাহিত হয়। বৃষ্টির কারণে তার মাথায় একটি ছাতা ধরেন এক নারী কারারক্ষী। গাড়ি থেকে নামিয়েই তাকে বসানো হয় একটি হুইল চেয়ারে। এ সময় তিনি পিংক কালারের একটি শাড়ি পরিহিত ছিলেন। তার চেহারা ছিল অনেকটাই বিধ্বস্ত। কিছুটা বিরক্তির ছাপও ছিল তার চোখে-মুখে। পরক্ষণেই দুইপাশ থেকে কয়েকজন মিলে খালেদা জিয়াসহ হুইল চেয়ারটি তুলে নিয়ে যান। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ির কারণে দলের নেতাকর্মীসহ নির্ধারিত চিকিৎসকদের বাইরে কেউ ওই সময় কেবিন ব্লকে ঢুকতে পারেননি।

কারাগারে থাকা খালেদা জিয়ার গৃহকর্মী ফাতেমা বেগমকেও গাড়ি থেকে নেমে হাসপাতালে উঠতে দেখা যায়। এদিকে ৭৩ বছর বয়সী সাবেক এ প্রধানমন্ত্রীর জন্য গতকাল সকালেই বিএসএমএমইউতে দুটি কেবিন প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। বিকালে খালেদাকে আনার আগে দুপুরে তার ব্যবহার্য বিছানাপত্র আনা হয় হাসপাতালে। খালেদা জিয়াকে কেবিন ব্লকে নেয়ার পর একটি পুলিশ ভ্যান থেকে তার ব্যবহৃত জিনিসপত্রের কয়েকটি ব্যাগও নামানো হয়। বিএসএমএমইউর ভিআইপি কেবিনেই চিকিৎসাধীন থাকবেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

মেডিকেল বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চিকিৎসা: পরিচালক: হাসপাতালে ভর্তির পর গণমাধ্যমের সামনে এ ব্যাপারে একটি সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং করেছেন বিএসএমএমইউ’র পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. হারুন অর রশিদ। তিনি বলেন, বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এই মুহূর্তে কেবিন ব্লকের ৬ তলায় অবস্থান করছেন। উনি ভর্তি হওয়ার পরে উনার কেবিনে মেডিকেল বোর্ডের সভাপতি প্রফেসর ডা. আবদুল জলিল চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তারপর চিকিৎসা শুরুর আগের ফরমালিটিজগুলো সম্পন্ন করেছেন। পরিচালক বলেন, রোববার বেলা ১টার পরে খালেদা জিয়ার জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হবে।

ওই বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা উনার চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করতে পারবো ইনশাআল্লাহ। পরিচালক জানান, হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী মেডিকেল বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। পুনর্গঠিত বোর্ডের সভাপতি হলেন- মেডিসিন বিভাগের প্রফেসর আবদুল জলিল চৌধুরী। সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন- রিমেটোলজি বিভাগের প্রফেসর ডা. সৈয়দ আতিকুল হক, কার্ডিওলজি বিভাগের প্রফেসর ডা. সজল কৃষ্ণ ব্যানার্জী, অর্থোপেডিক বিভাগের প্রফেসর ডা. নকুল কুমার দত্ত ও ফিজিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন বিভাগের সহযোগী প্রফেসর ডা. বদরুন্নেসা আহমেদ। খালেদা জিয়াকে কেমন দেখেছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে পরিচালক হারুন অর রশিদ বলেন, দেখুন- প্রফেসর ডা. আবদুল জলিল চৌধুরী উনাকে দেখেছেন। তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। মেডিকেল বোর্ডের সভার পরে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে পারবো।

খালেদা জিয়াকে খুবই অসুস্থ দেখা গেছে- এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, উনি কিন্তু আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, কুশল বিনিময় করেছেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মহোদয় দেখা করেছেন এবং উনার সঙ্গে আমাদের বিস্তারিত কথাবার্তা হয়েছে। মেডিকেল বোর্ড যেটা করা হয়েছে তা উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী করা হয়েছে। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার এই হাসপাতালে আসার পরিপ্রেক্ষিতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। সংবাদ ব্রিফিংয়ের সময়ে বিএসএমএমইউ’র অতিরিক্ত পরিচালক নাজমুল করীম মানিক ও সহকারী পরিচালক বেলাল হোসেন সরকার উপস্থিত ছিলেন।

মেডিকেল বোর্ড পুনর্গঠনে আদালতের নির্দেশনা মানা হয়নি: খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় মেডিকেল বোর্ড পুনর্গঠনে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মানা হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান ও ড্যাব মহাসচিব প্রফেসর ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন। বিকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের পরিচালক ব্রিফিং করার পর সাংবাদিকদের কাছে এ অভিযোগ করেন তিনি। ডা. জাহিদ বলেন, আজকে যে মেডিকেল বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে তাতে আদালতের নির্দেশনার প্রতিপালন ও প্রতিফলন ঘটেনি।

হাসপাতালের পরিচালক যে নামগুলো বলেছেন, তাতে যে তিনজন নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সে অন্তর্ভুক্তি আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী হয়নি। তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থে উনার (খালেদা জিয়া) চিকিৎসার জন্য যে মেডিকেল বোর্ড আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী হওয়া উচিত ছিল তা যথাযথভাবে প্রতিপালিত হয়নি বলে আমরা মনে করি। ডা. জাহিদ বলেন, আদালতের নির্দেশনা ছিল মেডিকেল বোর্ডে স্বাধীনতা চিকিৎসা পরিষদ (স্বাচিপ) ও ডক্টরস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)-এর কেউ প্রাথমিক সদস্যপদও থাকতে পারবে না। এখানে বোর্ডে যাদের রাখা হয়েছে তাদের মধ্যে তিনজন, বিশেষ করে সজল কৃষ্ণ ব্যানার্জী ও নকুল কুমার দত্ত তো স্বাচিপের লাইভ মেম্বার এবং বদরুন্নেসা আহমেদ স্বাচিপের সদস্য। আমি চিকিৎসক হিসেবে একথা বলা উচিত না যে- কে স্বাচিপ, আর কে ড্যাবের মেম্বার।

আমাদের সবার পরিচয় হওয়া উচিত চিকিৎসক। কিন্তু আজকে একথা বলতেই হচ্ছে। তিনি বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়াকে যথাযথ চিকিৎসা দেয়া এবং সম্মানের সঙ্গে চিকিৎসার জন্য আদালত নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু আজকে যে মেডিকেল বোর্র্ড করা হয়েছে সেটা নিয়ে আমরা সন্দিহান। কারণ বোর্ডে এমন সদস্যও আছেন হাইকোর্টের আপিল বিভাগ যাদের মেডিকেল বোর্র্ড বাতিল করে দিয়ে নতুন বোর্ড করিয়েছিলেন। যখন মেডিকেল বোর্ড নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিলো তখন হাইকোর্টের আপিল বিভাগ এই কাজটি করেছিলেন। ডা. জাহিদ বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা যে ডাক্তার সম্পর্কে বলছেন- ‘সে বারে বারে আইসা আমাকে বলতেন আপনি অসুস্থ, অসুস্থ।’ সেই ডাক্তার সাহেবও এই বোর্ডের সদস্য। আমরা যেটা বলতে চাই, খালেদা জিয়াকে যথাযথ চিকিৎসা দেয়ার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালে এনেছেন। এই হাসপাতালে কার্ডিওলজি, রিমেটোলজি, ফিজিক্যাল মেডিসিন, অর্থোপেডিক্স, ইন্টারনাল মেডিসিন- প্রত্যেকটা বিভাগেই অত্যন্ত প্রফেশনাল চিকিৎসক আছেন। যাদেরকে নিয়ে আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বিতর্কহীনভাবে মেডিকেল বোর্ড পুনর্গঠন করা যেতো। আদালতের নির্দেশনার প্রতিফলন ঘটানো যেতো।

এ ছাড়া খালেদা জিয়া ভর্তির আগেই হাসপাতালের পরিচালক মেডিকেল বোর্ডটি গঠন করেছেন। এখানে রোগী হিসেবে খালেদা জিয়ার পছন্দ-অপছন্দ ও স্বস্তি-অস্বস্তির বিষয়টিকে ন্যূনতম মূল্য দেয়া হয়নি। রোগীর মৌলিক অধিকারের প্রতিফলন ঘটানোর সুযোগই দেয়া হয়নি।

হাসপাতাল প্রাঙ্গণে মিছিল, স্লোগান: খালেদা জিয়াকে বিএসএমএমইউতে আনা হবে কারা মহাপরিদর্শক এই তথ্য গণমাধ্যমে জানানোর পর থেকে হাসপাতালের আশেপাশে জড়ো হতে থাকে বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেয়ার আগে পুলিশ ধাক্কিয়ে ও হুইসেল বাজিয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের হাসপাতাল আঙ্গিনা থেকে সরিয়ে দেয়। যখন হাসপাতালে খালেদা জিয়াকে আনা হয় তখন নেতাকর্মীদের সামলাতে পুলিশকে বেগ পেতে হয়। পুলিশের বাধায় আটকে বৃষ্টির মধ্যে হাসপাতাল প্রাঙ্গণে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে স্লোগান দেন মহিলা দলের নেতাকর্মীরা। তবে পুলিশের বাধার কারণে তারা দলীয় নেত্রীর কাছে যেতে পারেননি। এ সময় বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটে পুলিশের।

এক পর্যায়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের ধাওয়া দেয় পুলিশ। অন্যদিকে খালেদা জিয়াকে দেখতে গতকাল দুপুর থেকে হাসপাতালের কেবিন ব্লকের প্রতিটি বেলকনিতে ভিড় করেছিলেন রোগী ও তাদের স্বজনরা। হাসপাতালের ভেতরে বিএনপি নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন, ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, ডা. একেএম আজিজুল হক, ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, কেন্দ্রীয় নেতা নাজিমউদ্দিন আলম, শিরিন সুলতানা, সানাউল্লাহ মিয়া, হেলেন জেরিন খান, শাম্মী আখতার, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদসহ কয়েকশ’ নেতাকর্মী। ওদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় সাংবাদিকদের বলেন, বিএনপি’র চেয়ারপারসন কারাবন্দি খালেদা জিয়াকে বিএসএমএমইউতে ভর্তি করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার নিরাপত্তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *