কেউ নিয়ে এসেছিলেন ফুলের ডালি, কেউ হাতে তুলে দিলেন তাকে উৎসর্গ করা বই, কেউ আনলেন তাকে নিয়ে তৈরি তথ্যচিত্র- এ সবই তিনি সাদরে গ্রহণ করছিলেন মঞ্চে বসে।
কিন্তু বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে যখন তার গলায় ৮০টি গোলাপ দিয়ে তৈরি মালা পরিয়ে দেওয়া হলো, তখন তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সেই সঙ্গে তার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা জানাতে উঠে দাঁড়ালেন হল-ভর্তি দর্শক-শ্রোতা।
৮০তম জন্মবার্ষিকীতে এভাবেই জাতীয়ভাবে সংবর্ধিত হলেন লেখক, সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’- এই অমর গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে ১২ ডিসেম্বর বিকেলে বাংলা একাডেমি ও জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় কমিটির পক্ষে একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে জাতীয়ভাবে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান।
দৃষ্টিনন্দন মঞ্চ, শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রত্যেকের তিন মিনিটের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, মনোমুগ্ধকর উপস্থাপনা এবং আয়োজনের ব্যাপকতা- সব মিলিয়ে শ্রোতারা দীর্ঘদিন পর একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের জন্মদিনের অনুষ্ঠান উপভোগ করল।
অনুষ্ঠানে মানপত্র পাঠ করেন কবি আসাদ চৌধুরী। এক্সিম ব্যাংকের পক্ষ থেকে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর হাতে ২১ লাখ টাকার একটি চেক তুলে দেওয়া হয়। এরপর দেশের বিশিষ্ট লেখক-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী-রাজনীতিক-সাংবাদিকসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা গাফ্ফার চৌধুরীকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে বক্তব্য দেন।
বক্তারা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে বাঙালি জীবনের প্রোজ্জ্বল আলোক-মশাল এবং তার কর্ম জাতির জন্য প্রেরণাদায়ক- উল্লেখ করে তাকে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, সম্মান জানান। অনুষ্ঠানের মাঝ পর্যায়ে ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে উপস্থিত হন যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা মুঠোফোনে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে শুভেচ্ছা জানান। সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর অনুষ্ঠানে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত ‘লালগঞ্জের তীরে সূর্যোদয়’ কবিতা আবৃত্তি করে শোনান।
গাফ্ফার চৌধুরী তার বক্তব্যে সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বায়ান্নর সেই শহীদদের স্মরণ করে বলেন, ‘আমি ছিলাম কালের পুতুল। কালের বাঁশি আমার হাতে বেজেছে। আমি ভাবিনি, বিশ্বে এ গান একদিন এভাবে উচ্চারিত হবে।’
এরপর তিনি ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ কবিতাটি সেদিন কোন পটভূমিতে লেখা হয়েছিল সেই ইতিহাস বর্ণনা করেন। এই গানের জন্যই যে সুরকার আলতাফ মাহমুদকে একাত্তরে জীবন দিতে হয়েছে সে কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘এই মৃত্যুর জন্য আমিও কিছুটা দায়ী।’
আন্তর্জাতিকভাবে মাতৃভাষা দিবস উদ্যাপিত হচ্ছে, বাংলা এখন জাতীয় ভাষা অথচ এই ভাষার ব্যবহারিক মূল্য বাড়েনি- মন্তব্য করে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘উর্দুর বিরুদ্ধে একসময় সংগ্রাম করেছি, এখন হিন্দির খপ্পরে পড়েছি। ভাষার জন্য রাজনীতিও ব্যাহত হচ্ছে। দেশ এখন স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত হয়েছে। মৌলবাদের এত প্রচার আর কখনো দেখিনি।’
গাফ্ফার চৌধুরী বলেন, ‘যত দিন মৌলবাদী শক্তি নির্মূল না হবে, তত দিন আমি শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে যাব।’ তিনি বলেন, ‘আমি একবার আন্তর্জাতিক খ্যতিসম্পন্ন এক আইনজীবীর কাছে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমি শেখ হাসিনার অন্ধ-সমর্থক। আমি তাকে বলেছিলাম, শেখ হাসিনার অলটারনেটিভ কী? জঙ্গিবাদ, আফগান, পাকিস্তান, ড্রোন হামলা? তাই আমি বলব, যত দিন বেঁচে থাকব, শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে যাব।’
তিনি আরো বলেন, ‘শেখ হাসিনা একাই সেক্যুলার রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তার একা বা শুধু আওয়ামী লীগের পক্ষে সেক্যুলার রাষ্ট্র গঠন করা সম্ভব নয়। এজন্য সব বাম রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা করতে হবে। তিনি বলেন, শেখ হাসিনার আমলে যদি মৌলবাদী হেফাজত, জামায়াত মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, তার প্রতিবাদে যদি গণজাগরণ মঞ্চের মতো কোনো শক্তির উত্থান হয়, তাহলে আমি তাদের সমর্থন দেব।’
তিনি বলেন, একসময় দেশ শাসিত হতো ইংরেজিতে শিক্ষিতদের দিয়ে, তারা বিদেশ চলে যাচ্ছে। এখানে মাদ্রাসায় শিক্ষিতরা থেকে যাচ্ছে। অথচ মাদ্রাসা-শিক্ষা আধুনিক হয়নি। তৃণমূল থেকে মৌলবাদ তৈরি হচ্ছে। অথচ মৌলবাদ এবং ইসলাম আলাদা- এ কথা কেউ বলছে না। দেশের সর্বাধিক প্রচারিত একটি দৈনিক মৌলবাদকে উৎসাহিত করছে। এর বিরুদ্ধে আদর্শগত সংগ্রাম করতে হবে।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠান দুই পর্বে বিভক্ত ছিল। দ্বিতীয় পর্বে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত অমর একুশের গান, পঞ্চকবির গান ও লালনগীতি পরিবেশন করা হয়।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় সংবর্ধনা কমিটির সভাপতি এমেরিটাস প্রফেসর ড. রফিকুল ইসলাম। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চের মহাপরিচালক মোনায়েম সরকার।