ঢাকা: সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার আলোচিত নতুন বই ‘অ্যা ব্রোকেন ড্রিমে’র একটি অধ্যায়ে তিনি আলোকপাত করেছেন ২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার ওপর। তিনি প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সঙ্গে হওয়া এক আলাপের প্রসঙ্গও বইতে এনেছেন।
প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে তিনি লিখেছেন, [তত্ত্বাবধায়ক সরকারের] প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টি হলো। আওয়ামী লীগ কে এম হাসানের নিয়োগের বিরোধিতা করলো। এক পর্যায়ে হাসান নিজেই প্রধান উপদেষ্টা হতে অস্বীকৃতি জানালেন।
কিন্তু সংবিধানের অনেক নিয়মনীতি উপেক্ষা করে প্রধান উপদেষ্টা হলেন প্রেসিডেন্ট ড. ইয়াজউদ্দিন আহমদ। ওই সময় আওয়ামী লীগ যে আন্দোলন শুরু করলো তার ফলে দেশজুড়ে কার্যত অরাজকতা বিরাজ করছিল। শেষ অবধি সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করলো। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর চাপ ছিলো যে, সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যদি সরকার আয়োজন করতে না পারে, তাহলে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে নিয়োজিত বাংলাদেশী সদস্যদেরকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। এ বিষয়টি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ে দুশ্চিন্তা সৃষ্টি করে।
সেনাবাহিনীর চাপে ইয়াজউদ্দিন আহমেদ পদত্যাগে বাধ্য হন। দেশে জারি করা হয় জরুরি অবস্থা। ফখরুদ্দিন আহমেদ নিযুক্ত হন প্রধান উপদেষ্টা। বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এই ফলাফলে ভীষণ সন্তুষ্ট হলো। কিন্তু বিএনপি নৈতিকভাবে বেশ ভেস্তে পড়লো।
এই ডামাঢোলের মধ্যে হঠাৎ বিচারপতি বিকে দাসের স্ত্রী মারা গেলেন। এই খবর পেয়ে আমি তার বাসার দিকে রওনা দিই। কয়েক মিনিট পর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ প্রখ্যাত নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও সেখানে উপস্থিত হলেন। আমরা একে অপরের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম।
জরুরি অবস্থা ঘোষণার খবরে নিজের খুশি যেন দমাতেই পারছিলেন না সুরঞ্জিত। তিনি একে আওয়ামী লীগের অর্জন বলে দাবি করলেন। তার কথা শুনে মনে হবে যেন খোদ আওয়ামী লীগই বোধ হয় ক্ষমতায় চলে এসেছে। সুরঞ্জিত আরও বললেন, তার দল পরবর্তী সরকার গঠন করবে, এটি এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। তিনি এত খুশি ছিলেন যে তিনি যেন ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি একটি শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি, বিশেষ করে বিকে দাসের প্রতি শোক প্রকাশ করতে এসেছিলেন।
সুরঞ্জিত চলে যাচ্ছিলেন। বলছিলেন যে, তার কিছু কাজ আছে। আমি তাকে থামালাম। বললাম, ‘হ্যালো লিডার, চলে যাওয়ার আগে আপনাকে কিছু বলার আছে আমার। দয়া করে বসুন।’
আমি তাকে বললাম, পরিস্থিতির রাজনৈতিক মূল্যায়ন না করেই তার মতো নেতারা জরুরি অবস্থা ঘোষণায় নাচানাচি করছেন। আমি তাকে বললাম, এই ঘটনার ফলে দেশের প্রতি যে অনিবার্য বিপদ তৈরি হলো তা সম্ভবত আপনি ভুলে গেছেন। আমি আরও বললাম, ‘সম্ভাব্য পরিণতি না বুঝেই আপনারা বোকার মতো সেনাবাহিনীকে স্বাগত জানিয়েছেন। আপনার দল হবে প্রথম লক্ষ্যবস্তু। আর লিখে রাখুন, শিগগিরই কোনো নির্বাচন হবে না।’ যখন আমি তাকে কারণসমূহ ব্যাখ্যা করে বললাম, আমার মনে হলো যে তিনি কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তিনি বেরিয়ে গেলেন। শুধু বললেন যে, ‘আচ্ছা দেখা যাক।’
মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই আমার কথা সত্য প্রমাণিত হলো। সেনাবাহিনীর প্রথম লক্ষ্যবস্তু হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। দুর্নীতির অভিযোগে সাম্প্রতিক অতীতে দায়ের করা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হলো। ধীরে ধীরে আরও অনেক রাজনৈতিক নেতা আটক হলেন।