সম্পাদকীয়: সাংবাদিক নিপিড়ন আইনগুলো রাজনৈতিক সাংবাদিকতার ফসল!

Slider টপ নিউজ বিনোদন ও মিডিয়া

সব সরকারেই কিছু সাংবাদিক থাকেন সরকার সমর্থক। তারা পদও পান সরকারী। তাহলে সরকারগুলো কেন সাংবাদিক নিপিড়নমূলক আইন করে? তারা তাহলে কি করেন সরকারের ঘরে থেকে! প্রশ্নটি এসে যায় এই কারণে যে, সব সরকারের সময় কতিপয় সিনিয়র সাংবাদিক সরকারী হয়ে যান। ফলে সরকার সাংবাদিক নিপিড়নমূলক আইন করতে সাহস পায়। আর ওই সকল আইন ধারা ক্ষতিগ্রস্থ হন সাধারণ সাংবাদিকেরা। ফলে প্রশ্নটি এসেই যায়, রাজনৈতিক সাংবাদিকতার খেসারত দিতেই বিদায়ের সময় সরকারগুলো একটি করে সাংবাদিক নিপিড়নমূলক আইন করে যায় পুরস্কার হিসেবে। এই পুরস্কার দ্বারা সরকারী সাংবাদিকেরা তাৎক্ষনিকভাবে নিপিড়িত না হলেও বিরোধী দলে গেলে নিপিড়িত হয়। আর অহঃরহ এই সকল আইন দ্বারা নিপিড়িত হয় সাধারণ সাংবাদিক সমাজ, যারা দেশের ও জনগনের জন্য সাংবাদিকতা করেন।

অতীতের প্রতিশোধ নিতে বর্তমানকে আরো ভয়াবহ করতে হবে এমনটা করা উচিত নয়। অতীতের খারাপকে ভবিষৎ ভাল করার সংস্কৃতি লালন করতে হবে। না হয় এমন সময় আসবে যে, তখন আর ভাল করার ইচ্ছাটাও মরে যাবে। তাই সরকারের উচিত কালো আইন বাতিল করে সকলের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে একটি ভাল আইন করা।

বিশ্লেষন করলে দেখা যায়, ৮৯টি ধারার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬। এই আইনটি করে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। ৪৪টি ধারার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ করল মহাজোট সরকার। দুই আইনে দৃশ্যত তেমন কোন পার্থক্য নেই। পার্থক্য শুধু ব্যাপকতার। তদন্ত ছাড়া এ্যাকশন করার প্রবণতা শুধু বেড়েছে। দুটি আইনই দুটি সরকার করেছে যা বিদায়ের আগে। যদি এই রীতি চলতে থাকে তবে রীতিটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়ে যাবে এটাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারার সঙ্গে নতুন আইনের এই ১৯ ধারার বেশ মিল রয়েছে। তবে পার্থক্য হলো, ৫৭ ধারার তুলনায় ১৯ ধারায় শাস্তির পরিমাণ কম। ৫৭ ধারায় কেউ অপরাধ করলে তার অনধিক ১৪ বছর এবং অন্যূন সাত বছর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। পাশাপাশি এটি জামিন অযোগ্য। পক্ষান্তরে নতুন আইনের ১৯ ধারায় কেউ অপরাধ করলেও সেটি জামিনযোগ্য।

নতুন এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার সাথে সাথে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ধারা রহিত হবে এবং এই ধারাগুলোর অধীনে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা নতুন এই আইনের অধীনে নেওয়া হয়েছে বলে গণ্য হবে। অর্থাৎ এটি এখন কিছুটা আশার কথা যে, ৫৭ ধারার ভয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ কিছু লিখতে গিয়ে যেমন তটস্থ থাকেন, ধারাটি রহিত হলে সেই ভয় অনেকটা কাটবে।

নতুন এ আইনে ‘সন্ত্রাসী সম্পদ’ বলে একটি টার্ম রয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে কোনো সম্পদ যা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সন্ত্রাসী কাজে ব্যবহৃত হতে পারে বা হয়েছে বা ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাপ্ত এবং বাংলাদেশ বা কোনো বিদেশি রাষ্ট্র কর্তৃক সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত কোনা ব্যক্তি, কোম্পানি বা স্বত্বার সম্পদকে বুঝাবে। এ ক্ষেত্রে জঙ্গিবাদে অর্থায়নের অভিযোগে যেসব ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা নানা সময়ে ইঙ্গিত করেছেন, সেসব প্রতিষ্ঠানও এ আইনের অধীনে শাস্তির আওতায় আসতে পারে বলে ধারণা করা যায়।

একটি ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি এমন কিছু প্রকাশ করেন যা দেখলে বা শুনলে নাগরিকদের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে শত্রুতা বা ঘৃণার উদ্রেক হতে পারে, তাহলে এই অপরাধে তাকে সাত বছর কারাদণ্ড অথবা সাত লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দেওয়া হতে পারে। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, সম্প্রতি দুজন সরকারি কর্মকর্তাকে নির্যাতনের অভিযোগে পুলিশ বাহিনী সম্পর্কে ফেসবুকে অনেকেই এমন কিছু লিখেছেন, যা এই বাহিনীটির সম্পর্কে ঘৃণা তৈরি করেছে। সুতরাং এই আইনের বলে পুলিশ বাহিনী সস্পর্কে ওই সব লেখালেখির কারণে কি কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে?

৪৪টি ধারা সংবলিত নতুন এই আইনে এ রকম আরো বেশ কিছু বিধান রাখা হচ্ছে, যেগুলো নিয়ে নানা প্রশ্ন করার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরল বিশ্বাসে কৃতকর্মের নামে যে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে, সেটি নিয়েও প্রশ্ন করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ফলে সরকারের উচিত ছিল, আইনটি কেবিনেটে তোলার আগে এটির খসড়া নাগরিকদের মতামতের জন্য যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা। এ ক্ষেত্রে একটি নির্ধারিত সময় বেঁধে দেয়া উচিত ছিল যাতে ওই সময়ের মধ্যে নাগরিকরা আইনটি সম্পর্কে তাদের মতামত দিতে পারে। এরপর সেখানে প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন-বিয়োজন করে কেবিনেটে তোলা হলে এটি নিয়ে পরবর্তী সময়ে অনেক বিতর্ক এড়ানো যাবে।

সবশেষ কথা হচ্ছে, আইনের ধারা যত কঠোর বা কোমল হোক না কেন, সেটির প্রয়োগ নির্ভর করে সরকারের ইনটেনশন বা ইচ্ছের ওপর। খুব দুর্বল ধারা দিয়েও সরকার চাইলে যে কাউকে ফাঁসাতে পারে। যেমন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার অতিপ্রয়োগ আমরা দেখেছি। আবার খুব কঠোর কোনো ধারাও অকার্যকর হয়ে যেতে পারে যদি সর‌কার সেটি প্রয়োগ করতে না চায়।

ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের লক্ষ্য যদি হয় প্রকৃত প্রস্তাবেই সাইবার নিরাপত্তা বিধান এবং সেই সাথে অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মতো কার্যক্রম প্রতিরোধ করা, তাহলে এ নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক হবে না। কিন্তু যদি এ আইনের অন্যতম উদ্দেশ্য হয় বাকস্বাধীনতা হরণ বা ভিন্ন মত দমন, তখন আইনের ব্যাখ্যা নিজেদের মতো দিয়ে সহজ-সরল বিষয়কেও জটিল করে তুলতে পারবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুরোটাই নির্ভর করবে আইনটি যারা প্রয়োগ করবে, তাদের ওপর। তবে আমাদের আশা করতে দোষ নেই, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কোনো ধারা নিয়ে ৫৭ ধারার মতো আতঙ্ক তৈরি হবে না।

জাতি আশা করে, অতীতের প্রতিশোধ নিতে বর্তমানকে আরো ভয়াবহ করতে হবে এমনটা করা উচিত নয়। অতীতের খারাপকে ভবিষৎ ভাল করার সংস্কৃতি লালন করতে হবে। না হয়, এমন সময় আসবে যে, তখন আর ভাল করার ইচ্ছাটাও মরে যাবে। তাই সরকারের উচিত কালো আইন বাতিল করে সকলের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে একটি ভাল আইন করা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *