যুদ্ধ, বিশৃঙ্খলা, মতবিরোধে মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল হয়ে থাকার মধ্যে একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্য তৈরি করতে যুক্তরাষ্ট্রকে বেশ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগ এর আগে যেখানে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে এ নতুন উদ্যোগ কিভাবে সফল হবে?
মার্কিনিদের নতুন এ ধারণার ক্ষেত্রে আগেরগুলোর সাথে এর সবচেয়ে বড় পার্থক্যটি হচ্ছে, তারা এটি বাস্তবায়নে শুধু কূটনীতিক বা রাজনীতিকদের ওপর নির্ভর করছে না। বরং এক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের ওপর বেশি আস্থা রাখছে ট্রা¤প প্রশাসন। তারা খুব সম্ভবত ইরাকের অভিজ্ঞতা থেকেই এতে উদ্বুদ্ধ হয়েছে।
কয়েক বছর ধরেই ইসরাইল অভিযোগ করে আসছে, পরমাণু অস্ত্র থাকুক আর না-ই থাকুক, মধ্যপ্রাচ্যে ইরানই সবচেয়ে বড় বিপদ। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন মিত্রদের এ দাবির সাথে কখনোই একমত হয়নি। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন এসব বিষয়ে ইসরাইলের সাথে একই দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে আসছে। পাশাপাশি সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো ইসরাইলের অন্য মিত্ররাও ইরানের ব্যাপারে একই বক্তব্য দিয়ে আসছে। তারা বলছে, ইরান তাদের জাতীয় স্বার্থের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।
যেহেতু ইসরাইল ও উপসাগরীয় দেশ উভয়েরই শত্রু ইরান, সুতরাং তারা এখন সেই ঐতিহাসিক উপসংহারে পৌঁছতে পারে, আমার শত্রুর শত্রু, আমার বন্ধুর বন্ধু। তবে এখনো পর্যন্ত ইসরাইল ও গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) সদস্যদের মধ্যে বন্ধুত্বের বিষয়টি কল্পনা করা যতটা সহজ, বাস্তবে ততটা নয়। সাত দশকব্যাপী আরব-ইসরাইল দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যে অনেক খারাপ পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। সেই সাথে ফিলিস্তিন ও ইসরাইলি শাস্তিপ্রক্রিয়াও থেমে গেছে। ইসরাইল ও উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে একটি মিত্র সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়টি এখনো অনেক দূরের বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে। এমনকি ইসরাইলের সাথে দ্রুত ও নিরপেক্ষ শান্তি প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় আরব সমর্থকের জন্যও বিষয়টি একই রকম রয়ে গেছে।
এ অবস্থায় ইসরাইলের প্রতি আরব বিশ্বের বিদ্বেষ এবং মিসর, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশের সাথে সামরিক সম্পর্ক সফল হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এখন সে পথেই এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এখন তাদের দর্শন, যেখানে কূটনীতিক ও রাজনীতিকরা ব্যর্থ সেখানে জেনারেলরাই সামরিক পন্থায় সফলতা নিয়ে আসছেন।
এ চিন্তা থেকে এ মাসের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র কুয়েতে জিসিসি দেশগুলো, মিসর, জর্ডানের সাথে আলোচনায় বসে। সে বৈঠকে তারা মিডল ইস্ট স্ট্র্যাটেজিক অ্যালায়েন্স (মেসা), যাকে আরব ন্যাটো বলেও কখনো কখনো বলা হচ্ছে তা গঠনের ব্যাপারে আলোচনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, এ সামরিক জোট বাস্তবায়িত হলে তা রাজনৈতিক সম্পর্কের চেয়েও বেশি টেকসই হবে। ওই বৈঠকেই কিছু সফলতার দেখাও পায় যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মধ্যপ্রাচ্যের দুই পক্ষকেই এক টেবিলে বসাতে সক্ষম হওয়া। দুই পক্ষের এক পক্ষে ছিল সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইন, অন্য দিকে ছিল কাতারসহ অন্য আরো কিছু দেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের এ পরিকল্পনার ফলে ন্যাটোর পরে আরেকটি সামরিক জোট তৈরি হতে যাচ্ছে, যেখানে সম্ভবত যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং মার্কিন কর্মীবাহিনীও সেখানে থাকবে। মেসার প্রাথমিক মিশন হিসেবে প্রথমত ইরানের দুই ধরনের কার্যক্রমকে ঠেকানো হবে, যেগুলোকে যুক্তরাষ্ট্র সমস্যা বলে মনে করে। প্রথমত মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিভিন্ন দেশে ইরানের অস্ত্র সরবরাহ এবং উপসাগরীয় লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করার ক্ষমতা। উভয় ক্ষেত্রে এই জোট তিনটি উল্লেখযোগ্য পানিপথ হরমুজ, প্রণালী, বাবেল মান্দেব ও সুয়েজ খালে তাদের সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করবে, ইরান যাতে এ অঞ্চলে বিশেষ করে ইরাকের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকা এবং সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠনকে অর্থ ও অস্ত্র জোগান দিতে না পারে জন্য তারা স্থানীয় বিভিন্ন বাহিনীকেও সহায়তা দেবে তারা।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র আশা করছে, এর মাধ্যমে এ অঞ্চলে রাজনৈতিকভাবে সফলতা অর্জন করা সম্ভব হবে। যদি কাতার ও তার বিরোধী উভয় পক্ষই মেসার সামরিক বৈঠকে মিলিত হয়, তাহলে একইভাবে তা গোয়েন্দা কার্যক্রমেও সহায়তা করতে পারে এবং পরবর্তীতে তা কূটনৈতিক সম্পর্কও পুনরুদ্ধার করতে পারে। চূড়ান্ত পর্যায়ে মেসায় একজন সহযোগী হিসেবে ইসরাইল যুক্ত হবে। কারণ ইসরাইল ও মেসা মূলত একই ধরনের নির্দেশনায় বিশেষ করে এ অঞ্চলে ইরান ও তার সামরিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধেই কাজ করবে। সুতরাং ইসরাইল এবং এই নতুন সামরিক জোটের মধ্যে যে সহযোগিতা সম্পর্ক স্থাপন হবে তা সহজেই অনুমেয়। কারণ উপসাগরীয় দেশ ও ইসরাইলের মধ্যে যে সামরিক সহযোগিতাই স্থাপিত হোক না কেন, ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক যে স্বাভাবিক হয়ে আসবে তা ভাবা অমূলক নয়।
কাতার ও তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সামরিক সহযোগিতা ইসরাইলের সাথে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আরব সম্পর্কের উন্নয়নের পথ খুলে দিতে পারে। আর যদি তা-ই হয় তাহলে সামরিক সম্পর্কের পথ ধরে ধীরে ধীরে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের পথও খুলে যাবে। প্রস্তুত হবে ট্রাম্প প্রস্তাবিত ‘শতাব্দীর সেরা চুক্তি’ বাস্তবায়নের পথ, যার নকশা করেছেন জ্যাসন গ্রিনব্লাট এবং দায়িত্বে আছেন ট্রাম্পের সিনিয়র উপদেষ্টা ও জামাতা ইহুদি জ্যারেড কুশনার।
যদিও মেসার বিষয়টি একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তারপরও যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য এটিকে অর্ধেক সম্ভাবনাময় বলেই ধরা হচ্ছে। কারণ ইরানের প্রতি আরব ও ইসরাইল উভয়ের ক্ষোভের ফলে তাদের নেয়া পদক্ষেপ তেহরানকে অনেক দুর্বল করে ফেলতে সক্ষম হবে। সামরিক এই সহযোগিতা প্রমাণ করেছে যে, এটি রাজনৈতিক বন্ধুত্বের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর ও অধিক টেকসই। যেমন ইরানকে পর্যদুস্ত করার ক্ষেত্রে একত্রে কাজ করার কারণে মেসা আন্তঃউপসাগরীয় শান্তি এবং আরব ইসরাইল শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে কাজ করতে পারে। ফলে ওয়াশিংটনে মেসা ইস্যুতে এখন কূটনীতিক ও রাজনীতিকের চেয়ে সামরিক জেনারেলদের দাপট চলছে। আগের প্রকল্পগুলো বিচারে এখন কূটনীতিক-রাজনীতিকদের অবস্থান নিচের দিকে অবস্থান করছে, কারণ তাদের সে প্রচেষ্টা তেমন কোনো সাফল্য বয়ে আনতে পারেনি।