মতিউর রহমান চৌধুরী: কোনো ওজর আপত্তিতেই কাজ হলো না। শেষ পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি সহসাই পাস হতে চলেছে সংসদে। সম্পাদক পরিষদ প্রত্যাখ্যান করেছে। সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোও আপত্তি তুলেছে। সিভিল সোসাইটি বিচ্ছিন্নভাবে কথা বলেছে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, বাংলাদেশে সিভিল সোসাইটি মৃতপ্রায়। দলীয় ব্যানারে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয় মাঝেমধ্যে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিরামহীনভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। বলছে, এই আইন পাস হলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করবে। দেশীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো কমবেশি সোচ্চার।
ডিজিটাল যুগে এই আইন? সরকার বলছেন ডিজিটাল যুগ মানে এটা নয়- অবাধ লাইসেন্স? যা কিছু বলা বা লেখা যাবে। যা ইচ্ছে লেখার মানে হচ্ছে স্বেচ্ছাচারিতা। এটা কখনো কাম্য নয়। এ জন্য কি আইনের দরকার? যে আইন আমার মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়। যে আইন সংবিধানের প্রতি মানুষকে শ্রদ্ধাশীল হতে শেখায় না। যে আইন বাকস্বাধীনতাকে বাক্সবন্দি করে। মনে রাখা দরকার, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনগণের অপরিহার্য অধিকার হচ্ছে বাকস্বাধীনতা। মানুষ কথা বলবে, ভাববে, অন্যের কথা শুনবে। ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা জানাবে। এটাই তো সংবিধান নামক দলিলের কথা। ক্ষমতার বাইরে থেকে আওয়ামী লীগ এ কথাগুলো কতবার বলেছে। লড়াই করেছে রাজপথে। নিকট অতীতে ১২ বছর আগে রাজপথ কাঁপিয়েছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য। জরুরি জমানার বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে কথা বলেছে।
সংবাদপত্রের ফাইল ঘাঁটলে অসংখ্য শিরোনাম দেখা যায়- যা কিনা আজকের আওয়ামী লীগের চরিত্রের মধ্যে বিস্তর ফারাক। ভারতে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনের ৬৬/এ ধারাটি বাতিল করে দিয়েছে সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট। বিচারক রায়ে বলেছেন, ধারাটি অসাংবিধানিক। বাকস্বাধীনতার পরিপন্থি, অস্বচ্ছ ও পরিণামে ভয়ঙ্কর। যাই হোক, ইতিহাস মোটেই শাসকদের পক্ষে থাকে না। বাংলাদেশেও দেখেছি। বিদেশেও ভূরি ভূরি নজির রয়েছে। যে সব দেশ মৌলিক অধিকারকে স্বীকৃতি দেয় না- ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করে না- সে সব দেশ মুখ থুবড়ে পড়েছে। নিকট অতীতে ইরাক-লিবিয়ার ইতিহাস সবার জানা। আগে উন্নয়ন- পরে গণতন্ত্র চর্চা করতে গিয়ে অনেক দেশের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়েছে। ভিন্নমতকে দমন করা সহজ। বন্দুক পারে না এমন কিছু নেই এই দুনিয়ায়। কিন্তু বন্দুকের তো কোনো দিক নেই। জনগণের প্রতি আস্থা হারিয়ে পৃথিবীতে অনেক শাসকই বন্দুকের প্রতি আস্থাশীল হয়ে পড়েন। আখেরে তাদের দু’কূলই যায়। ক্ষমতা দীর্ঘ করার জন্য বিএনপি অনেক কূটচালের আশ্রয় নিয়েছিল। এর অন্যতম রূপকার ছিলেন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া জোটের দুই নেতা। খালেদা জিয়া নিজের ইচ্ছায় অনেক ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। এখনো একই প্রবণতা। অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ায় ভুলের মিছিল লম্বা হচ্ছে। বিশেষ ক্ষমতা আইন চালু করে আওয়ামী লীগ বরাবরই নিন্দিত হয়েছে। কখনো প্রশংসা পায়নি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তারাই। আজ যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় তাদের অনেকেই বারবার এই আইনে বন্দি হয়েছেন। নির্যাতিত হয়েছেন।
২০০৬ সালের ৮ই অক্টোবর তথ্যপ্রযুক্তি আইন চালু করেছিল বিএনপি। এখন মূল্য দিচ্ছে কড়াভাবে। তাদের জন্য সামনে কি অপেক্ষা করছে কে জানে। স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতার পক্ষে কেউই কথা বলবেন না। অনেকেই অবশ্য ভুলে যান সবকিছুর একটা সীমারেখা আছে। বা থাকতে হবে। শাসকেরা এর সুযোগ নিয়ে ভিন্নমতকে কব্জা করতে চান। বিপত্তিটা সেখানেই। একটা সমাজ কি ভিন্নমত ছাড়া চলতে পারে? ক্ষমতা চিরস্থায়ী ভাবলে অবশ্য কথা নেই। এই পথটা সর্বনাশা। আজ আমাকে আপনি দমন করতে পারেন। ভাবতে পারেন সামনে সব আমার। আমি সবকিছু দমন করবো। কার কি এসে যায়! ইতিহাস বড় নিষ্ঠুর। কাউকেই ক্ষমা করে না। এক সময় বাংলাদেশের উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রশংসা করতো সবাই। বিশেষ করে পশ্চিমা দুনিয়া। বলা হতো বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র মুসলিম দেশ যেখানে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্র চর্চা হয়। এখন তারা কি বলছে কারো না জানার কথা নয়। প্রতিদিনই কোনো না কোনো বিদেশি সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্র আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য সরকারের কড়া সমালোচনা করছে।
কথা বললেই রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এক ধরনের রোগে পরিণত হয়েছে। মামলার প্রতিও মানুষের আস্থা কমছে। ভয়ের সংস্কৃতি অন্য এক ভয়ের জন্ম দেয়। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি গণভোটে দেন। জনগণ গ্রহণ করলে কেউ আপত্তি জানাবে না। আর যদি কোনো সমালোচনাতেই সরকার কান না দেয় তাহলে ফিল্মী দুনিয়ার সুপারস্টার শাহরুখ খানের বিখ্যাত একটি উক্তির কথা স্মরণ করবো। তার কথায়, সময় বদলে গিয়েছে। মনে যা আছে সেটা বলা বা প্রকাশ না করাই ভালো। কারণ সবাই জানেন। এই মনের কথা বলতে হলে বাথরুমে গিয়ে বরং বলাই ভালো। শাহরুখ খান জিন্দাবাদ।