কূটনৈতিক রিপোর্টার: ভিন্নরকম আয়োজন। শান্তির জন্য প্রার্থনা। শিশুরা শপথ পড়ালেন দেশের বিভিন্ন স্তরের রাজনীতিকদের। বিভিন্ন জেলা থেকে আগত আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রায় ৪০০ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ছিলেন এক কাতারে। তারা শান্তিপূর্ণ ও অহিংস নির্বাচনের শপথ করলেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে এ শপথ হলো। ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটিশ উন্নয়ন সংস্থার সহায়তায় ‘শান্তিতে বিজয়’ ক্যাম্পেইনের জাতীয় উদ্বোধনীতে রাজনীতিকরা সহিংসতা মুক্ত শান্তিপূর্ণ রাজনীতি ও নির্বাচনের অঙ্গীকার করলেন। ঘোষণা দিলেন নিজেরা সংঘাত মুক্ত থাকবেন, সহযোগী-সহকর্মীদেরও এতে উৎসাহ যোগাবেন। ছোট শিশুদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে রাজনৈতিক নেতারা বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, একমাত্র সহনশীল ও শান্তিপূর্ণ রাজনীতিই দেশের মানুষের কল্যাণ আনতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, যারা শান্তিপূর্ণ রাজনীতি চর্চা করবে দেশের মানুষ তাদেরই সমর্থন করবে।
তাই আমি অঙ্গীকার করছি, আমি সহনশীল ও শান্তিপূর্ণ রাজনীতির চর্চা করবো। ভবিষ্যতের যেকোনো নির্বাচনে আমি শান্তিপূর্ণভাবে প্রচারণা করবো এবং দলের সহকর্মীদেরকেও নির্বাচনে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে উৎসাহিত করবো। আমি অঙ্গীকার করছি, আমি সব সময় শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ গড়তে সচেষ্ট থাকবো। শান্তিতে বিজয় বাংলাদেশের ষোলো কোটি মানুষের বিজয়। শান্তি জিতলে জিতবে দেশ।’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মইন খান ছাড়াও ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট ও বৃটিশ হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেক বক্তব্য রাখেন। আয়োজকদের তরফে জানানো হয়- দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সহনশীল রাজনীতির চর্চা বাড়াতে সচেতনতা তৈরিই এ ক্যাম্পেইনের উদ্দেশ্য।
ওই ক্যাম্পেইনের আওতায় শোভাযাত্রা, নির্বাচনী প্রার্থীদের সঙ্গে মুখোমুখি সংলাপ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠক ও কর্মশালা হবে। সেই সঙ্গে দেশের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সাড়ম্ব্বরে পালিত হচ্ছে শান্তিতে বিজয় কর্মসূচি। অনুষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় নাগরিকবৃন্দ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ একত্রিত হয়ে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক চর্চার স্বপক্ষে একসঙ্গে কাজ করার জন্য তরুণ প্রজন্ম ও রাজনৈতিক নেতাদেরকে উদ্বুদ্ধ করছেন। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, দোরগোড়ায় থাকা বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যে কোনো মূল্যে সহিংসতা বন্ধের বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরিতে ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল শান্তিতে বিজয় ক্যাম্পেইন শুরু করেছে। অনুষ্ঠানস্থলে প্রদর্শিত ব্যানার ফেস্টুনেও সহিংসতাকে না বলার পক্ষে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সেখানকার স্লোগানগুলো ছিল এমন- কোমরে অস্ত্র গুঁজে ডর দেখাইবেন, আমার ভোট পাবেন না’ অথবা ‘সামনা সামনি কোলাকুলি, পিছে ফিরলেই পিঠে ছুরি, এমন নেতা হলে আমার ভোট পাবে না।’ ‘চোখ রাঙালে, আমার ভোট পাবেন না।’ ‘জ্বালাও-পোড়াও করবেন, ভোট পাবেন না।’ তবে ওই স্লোগানের বিষয়ে আয়োজকরা বলেন- কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীকে আঘাত করার জন্য তাদের এ স্লোগান নয়। বরং বাস্তব সত্যটা রাজনীতিবিদদের কাছে পৌঁছে দিতেই এই উদ্যোগ।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করলেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। তার ভাষ্য মতে, ‘শান্তি, পারস্পরিক সহনশীলতা ও অংশগ্রহণমূলক মনোভাব- বাংলাদেশে এ সবকিছুরই রয়েছে এক জোরালো ঐতিহ্য। একটি গণতান্ত্রিক দেশের জন্য অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বিশেষ করে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে থাকা একটি রাষ্ট্রের জন্য।’ বার্নিকাট বলেন, ‘হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করার মাধ্যমে আমরা একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলায় অবদান রাখতে পারবো। সরকার, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, মিডিয়া এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা-বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে মিলে এ কাজ করতে সক্ষম হবো। সব রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও ব্যক্তির জন্য নির্বাচনের প্রাক্কালে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় পরিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা থাকা উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মী-সমর্থকদের অবশ্যই নিজেদের রাজনৈতিক মতামত প্রকাশ, প্রচারণা চালানো এবং ভয়ভীতি, প্রতিশোধ বা জবরদস্তিমূলক বিধিনিষেধ ছাড়া শান্তিপূর্ণ সভা সমাবেশ করার স্বাধীনতা থাকতে হবে।
ইস্যু বা নীতির বিষয়ে মতপার্থক্য থাকলেও রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার বৈধ অংশগ্রহণকারী এবং পরবর্তী সরকারের সম্ভাব্য নেতা হিসেবে মেনে নিতে হবে। নির্বাচন চলাকালে এবং আগে ও পরে সহিংসতা এড়াতে আহ্বান জানিয়ে বার্নিকাট বলেন, ‘বাংলাদেশিদের অবশ্যই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়ে- নির্বাচনের আগে, চলাকালে এবং পরে- সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে অহিংস আচরণ করার আহ্বান জানাতে হবে। সহিংসতা শুধু তাদেরই কাজে আসে যারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং বাংলাদেশ ও তার নাগরিকদের স্বার্থহানি করতে চায়। তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সংবিধানগুলোতে এ ধারণাটি গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছে যে, সব মানুষ জন্মগতভাবে সমান এবং চিন্তা, উদ্ভাবন ও নিজেকে মেলে ধরার সুযোগ আর স্বাধীনতা দেয়া হলে প্রতিটি মানুষের রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। আমার প্রত্যাশা, আজকের এ অনুষ্ঠান বাংলাদেশে শান্তি বজায় রাখা এবং সব নাগরিকের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ ও আসন্ন সংসদ নির্বাচনে শান্তিপূর্ণভাবে অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সবাইকে আরো বেশি অঙ্গীকারবদ্ধ হতে উৎসাহিত করবে। অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জানান, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী প্রচারণা বিষয়ক কর্মসূচি ‘শান্তিতে বিজয়ের’ অনুষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্র সরকার, যুক্তরাজ্য সরকার এবং সবার অর্থাৎ বাংলাদেশি সহযোগীদের অনন্য সহযোগিতার ফসল। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেছে উন্নয়ন আর প্রগতির আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চাভিলাষ। অনুষ্ঠানে বৃটিশ হাইকমিশনার অ্যালিসন ব্লেইকও প্রায় অভিন্ন বার্তা দেন।
সাফ জানান, বাংলাদেশের বন্ধু হিসাবে বৃটেন এখানে সহিংসতামুক্ত নির্বাচনই দেখতে চায়। এখানকার প্রত্যেকটি মানুষের শান্তিপূর্ণ পরিবেশে রাজনীতি করার অধিকার আছে উল্লেখ করে ব্লেইক বলেন, আশা করি, সকল রাজনৈতিক দল, কর্মী ও জনগণ শান্তির পক্ষে দাঁড়াবে এবং সহিংসতাকে না বলবে। সর্বজনীন মানবাধিকার সনদের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক ওই সনদে মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। এটি অর্জন করতে হলে নিয়মিত নির্বাচন অপরিহার্য। তাই ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের এ উদ্যোগে আমরা অংশ নিয়েছি। বাংলাদেশের মানুষের পাশে এ যাত্রায় থাকতে পেরে আমরা আনন্দিত। আমরা দেখেছি বাংলাদেশের মানুষ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চায়। বৃটিশ দূত বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বাস করেন শান্তিপূর্ণ নির্বাচন এবং রাজনীতি দেশের সবার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে। আজকে আমরা সবাই এখানে একত্রিত হয়েছি কারণ আমরা সবাই একই আকাঙ্ক্ষা ধারণ করি। বৃটিশ দূত এ-ও বলেন, রোববার ছিল আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। গণতন্ত্র এখন অনেক শক্তিশালী।
এটাকে আরো শক্তিশালী করতে আমরা কাজ করবো। এ লক্ষ্যে আমরা তৃণমূল পর্যায়ের মানুষকে যুক্ত করবো। এভাবে আমরা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার আরো উপায় খুঁজে বের করবো। তার নিজের দেশের গণতন্ত্রকে আরো শক্তিশালী করার জন্য কাজ করবেন জানিয়ে বৃটেনের দূত বলেন আমরা এখানে যারা আছি তারা শান্তির পক্ষে। কারণ শান্তি জিতলে জিতবে বিশ্ব, জিতবে বাংলাদেশ। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম তার দীর্ঘ বক্তৃতায় বলেন, আমরা উন্নত আধুনিক বাংলাদেশ চাই। সেই সঙ্গে চাই গণতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ এমন একটি দেশ যে দেশ সারাবিশ্বের আদর্শ হবে। এটি আমাদের লক্ষ্য। আমরা সুষ্ঠু, অবাধ, সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য ও স্বচ্ছ নির্বাচন চাই। সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন আমাদের প্রতিজ্ঞা। আমরা আশা করি, আমাদের দলের এবং আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে আমরা কখনো পিছপা হবো না। অতীতেও হইনি, ভবিষ্যতেও হবো না। অনুষ্ঠানে স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের নির্বাচনী পরিবেশ ধীরে ধীরে শান্তিপূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন দিক ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের পদক্ষেপগুলো তুলে ধরেন এইচ টি ইমাম। বলেন, ‘এই যে অগ্রগতিগুলো ধীরে ধীরে হয়েছে। এগুলো আমরা খুব সচেতনভাবে লক্ষ করি না। কিন্তু আমি যেহেতু এগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। তাই লক্ষ করি এবং দেখি আমরা কতদূর এগিয়ে গেছি। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সবসময়েই আক্রান্ত হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আক্রান্ত হয়েছে। আমি সেই সমস্ত ঘটনাগুলো বলতে চাই না। কিন্তু আমরা কখনো কাউকে পাল্টা আক্রমণ করিনি। সকল দলের সকল নেতা সবাইকে আমি দাবি করতে পারি যে, ‘আমি একজন বর্ষীয়ান মানুষ। কাজেই এদিক থেকে সবার কাছে অনুরোধ করতে পারি, আমরা ভুল মিথ্যা, প্রচারণা থেকে বিরত থাকি। বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণা থেকে বিরত থাকি। আমরা সত্য কথা বলি। সত্যকে সত্য বলব। সাদাকে সাদা বলব।
কালোকে কালো বলবো। যিনি অন্যায় করছেন সেটি তুলে ধরবো। সেই সঙ্গে অনর্থক আমরা কাউকে গালি দেব না। কারও প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ কথাও বলবো না এবং মিথ্যা প্রচারও করবো না। এগুলো যদি আমরা পালন করি, বাস্তবে প্রয়োগ করি তাহলে আমি বিশ্বাস করি আমার দৃঢ় প্রত্যয় আছে, আমরা ইনশাআল্লাহ আগামীতে যে নির্বাচন হবে, সেই নির্বাচনটি শান্তিতে করতে পারবো, আনন্দে করতে পারবো, বাংলাদেশে যেমন উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হয় সেই রকম অতীতে হয়েছে আমরা এবারও করতে পারবো আশা করি।
আয়োজকরা অত্যন্ত আন্তরিকভাবে কাজ করছেন যেজন্য কাজ করছেন এজন্য অভিনন্দনও জানান আওয়ামী লীগের জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান বলেন, আমরা রাজনীতিতে শান্তির কথা বলছি। শান্তি খুব প্রয়োজন। কিন্তু সুবিচার ছাড়া শান্তি সম্ভব না। আমরা একটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চাই। শুধু তাই নয়, আমরা একটা শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী পরিবেশ চাই। এটাই তো আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য ছিল।’ গণতন্ত্রণের গুরুত্ব উল্লেখ করে মঈন খান বলেন, ‘গণতন্ত্র না থাকলে উন্নয়ন সম্ভব না। আমরা এ কথাই বলতে এসেছি। আমরা সামাজিক সুবিচার, রাজনৈতিক সুবিচার দাবি করি, এগুলো ছাড়া মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের কথা ভাবা যায় না। আমরা রাজনৈতিক দল, সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের হাতে হাত ধরে এগুতে চাই। কারণ একসঙ্গে কাজ করলে আমরা গণতন্ত্র ও উন্নয়ন আনতে পারবো।