হজ পালন শেষে দেশে ফিরে আসা মাকে আনতে হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন সহোদর শিক্ষানবিশ আইনজীবী শাফিউল আলম ও বেসরকারি কোম্পানির চাকরিজীবী মনিরুল আলম। বিমানবন্দরে সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মায়ের লাগেজ গাড়িতে তুলছেন দুই ভাই।
হঠাৎ করেই একদল লোক এসে শাফিউল আলমের নাম-পরিচয় জানতে চান। তাদের প্রশ্নের জবাবে নিজের নাম-পরিচয় দেওয়ার পরই শাফিউল আলম, তার ভাই মনিরুল আলম এবং তাদের এক বন্ধু আবুল হায়াতসহ তিনজনকে জাপটে ধরে অন্য একটি গাড়িতে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেন ডিবি পরিচয় দেয়া ওই ব্যক্তিরা। এ সময় তাদের বৃদ্ধা মা পরিচয়ধারী পুলিশদের কাছে অনুনয়-বিনয় করতে থাকেন। নিজের ছেলেদের জাপটে ধরে রাখার চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু ওই ব্যক্তিরা মায়ের হাত থেকে তার সন্তানদের টেনে হিঁচড়ে তাদের গাড়িতে তুলে নেন। এর পরই গাড়ি লাপাত্তা। এর পর থেকে খোঁজ নেই ওই তিন যুবকের। শুধু ওই তিন যুবকই নয়, তাদের সঙ্গে নিয়ে ডিবি পরিচয় দেওয়া লোকেরা যাত্রাবাড়ীর মিরহাজারীবাগ এলাকার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী শফিউল্লাহ এবং ডগাইরের একটি মাদ্রাসার নবম শ্রেণির ছাত্র মোশারফ হোসেইন মায়াজ নামে আরও দুই ছাত্রকেও তুলে নিয়ে যন। ঘটনার চার দিন পার হলেও এখন পর্যন্ত তাদের খোঁজ মেলেনি।
নিখোঁজ এই পাঁচজনের পরিবারের স্বজনরা গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনে (ক্র্যাব) এক সংবাদ সম্মেলনে এসব অভিযোগ করেন। তাদের সন্তানরা বেঁচে আছেন, নাকি তাদের গুম করে মেরে ফেলা হয়েছে এ খবরও জানতে পারছেন না তারা। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন শাফিউল আলম ও মনিরুল আলমের মা রমিছা খানম, নবম শ্রেণির ছাত্র মোশারফ হোসাইন মায়াজের মা, বাবা ও বোন এবং ঢাকা কলেজের ছাত্র শফিউল্লাহর ছোট ভাই নাছিরুল্লাহ। সংবাদ সম্মেলনে রমিছা খানম বলেন, হজ পালন শেষে ১২ সেপ্টেম্বর রাত ৮টায় হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরে নামেন তিনি। তাকে নেওয়ার জন্য বিমানবন্দরে গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন তার ছেলে শাফিউল আলম, মনিরুল আলম এবং তাদের বন্ধু আবুল হায়াত। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে ছেলেরা তার ব্যাগ, ল্যাগেজ গাড়িতে তুলছিলেন। হজ শেষে তিনি ক্লান্ত ও অসুস্থ ছিলেন। গাড়িতে মালপত্র তোলা শেষ হওয়ার মুহূর্তে কয়েকজন লোক এসে তার ছেলে শাফিউল আলমের কাছে জানতে চান, তার বাড়ি টাঙ্গাইলের গোপালপুর থানার বাঁধাই গ্রামে কি না। জবাবে হ্যাঁ বলার পরই একজন শাফিউলকে জাপটে ধরেন। পরপর পাশে থাকা আরেক ছেলে মনিরুল আলম এবং তাদের বন্ধু আবুল হায়াতকে অন্যরা ধরে ফেলেন। তিনি গাড়ি থেকে চিৎকার করে জানতে চান, কেন তাদের ছেলেদের ধরা হয়েছে, তাদের কী অপরাধ। এ সময় পাশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন ছিল। তারা এগিয়ে এলে ওই ব্যক্তিরা নিজেদের ডিবির লোক পরিচয় দিয়ে আইডি কার্ড দেখান। এরপর পুলিশ চলে যায়। এর পরই তিনজনকে একটি গাড়িতে তুলে দ্রুত নিয়ে চলে যান ডিবি পরিচয়ধারী লোকেরা। পরে তিনি একাই গাড়িতে করে বাড়িতে ফেরেন।
রমিছা খানম বলেন, রাতেই তার ছেলে শাফিউল আলমকে সঙ্গে নিয়ে ডিবির লোকজন যাত্রাবাড়ীতে একটি বাসায় অভিযান চালান। সেখান থেকে ঢাকা কলেজশিক্ষার্থী শফিউল্লাহ এবং মাদ্রাসাছাত্র মোশারফ হোসেন মায়াজকেও তুলে নিয়ে যান। এর পর থেকে পাঁচজনের কোনো খোঁজ মিলছে না। তুলে নিয়ে যাওয়ার পরদিন নিখোঁজ দুই সন্তানসহ পাঁচজনের খোঁজে তারা ডিবি কার্যালয়, থানা পুলিশের বিভিন্ন কার্যালয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ডিবির লোকজন কেউ স্বীকার করছে না।
রমিছা খানম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, তার দুই ছেলে কোনো রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ছেলে শাফিউল আলম গ্রামের বাড়িতে স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে ঢাকায় বেসরকারি বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করেছেন। এরপর একটি ল’ কলেজ থেকে আইন বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে কাজ করছিলেন। তার আরেক ছেলে মনিরুল আলমও টাঙ্গাইলের স্থানীয় কলেজ থেকে পড়াশোনা শেষ করে উত্তরার আবদুল্লাহপুরের বেসরকারি আইডিবি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। এরপর একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি নেন। যাত্রাবাড়ী এলাকায় একটি মেসে তারা দুই ভাই থাকতেন। তাদের বন্ধু আবুল হায়াতও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। সংবাদ সম্মেলনে মায়াজের বাবা সাইদুল ইসলাম বলেন, তার ছেলে মায়াজ ডেমরার ডগাইর ফাজিল মাদ্রাসার নবম শ্রেণির ছাত্র। পরিবারের সঙ্গে ডগাইর পশ্চিমপাড়ার বাসায় থাকত সে। ঘটনার দিন বাসা থেকে বের হয়ে কী প্রয়োজনে যাত্রাবাড়ীর মীরহাজিরবাগে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী শফিউল্লাহর রুমে যায় সে। পরে তারা খবর পান ডিবির লোকজন শফিউল্লাহর সঙ্গে তার ছেলেকেও নিয়ে গেছেন। এরপর তারা যাত্রাবাড়ী থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গিয়েছেন। কিন্তু থানা পুলিশ জিডি নিচ্ছে না। শফিউল্লাহর ভাই নাছিরুল্লাহ জানান, তার ভাই শফিউল্লাহ ঢাকা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। নিখোঁজের পর থেকে তার ভাইয়ের রুমটি কে বা কারা তালা মেরে রেখেছে। ভাইয়ের খোঁজে তিনি বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন। কিন্তু তার ভাইকে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে পুলিশ কিছুই বলছে না।