ঢাকা: ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ক্রয়ের প্রকল্প প্রস্তাবই এখনো অনুমোদন হয়নি। সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করার জন্য আইনও সংশোধন করা হয়নি। কিন্তু গত জুলাই থেকে হাজার কোটি টাকার ইভিএম কেনার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।
বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে। বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করার মতো প্রস্তুতিও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নেই। আবার সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে হলে নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশও (আরপিও) সংশোধন করতে হবে।
ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যেই আরপিও সংশোধনের থেমে যাওয়া উদ্যোগ হঠাৎ করে সচল করেছে ইসি। আরপিও সংশোধনী প্রস্তাব চূড়ান্ত করতে আজ বেলা ১১টায় বৈঠকে বসছে ইসি। জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার মাস দু-এক আগে ইভিএমের জন্য আরপিও সংশোধনে ইসির এই তোড়জোড় নিয়ে রাজনৈতিক মহলে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। বড় পরিসরে ব্যবহার করার মতো সক্ষমতা ও দক্ষ জনবল তৈরি না করেই দেড় লাখ ইভিএম কেনা এবং আইন সংশোধনের উদ্যোগ শুধু কেনাকাটার জন্য কি না, সে প্রশ্নও সামনে এসেছে।
নির্বাচন কমিশনের তাড়াহুড়োর এ উদ্যোগ নিয়ে খোদ ইসিতেই প্রশ্ন আছে। নির্বাচন কমিশনারদের কেউ কেউ মনে করেন, এই মুহূর্তে ইভিএমের আলোচনা সামনে আনা বা বিপুলসংখ্যক ইভিএম ক্রয় করা অনাবশ্যক। এতে বিতর্ক বাড়বে। কারণ, ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক দ্বিমত যেমন আছে এবং এটা ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষিত জনবল নেই।
গত বছর অংশীজনদের সঙ্গে ইসির সংলাপে আলোচিত বিষয় ছিল ইভিএম। ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশ নিয়েছিল। ২৩টি দল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম নিয়ে নিজেদের মতামত জানিয়েছিল। এর মধ্যে বিএনপিসহ ১২টি দল ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে মত দেয়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ সাতটি দল ইভিএমের পক্ষে, তিনটি দল পরীক্ষামূলক ও আংশিকভাবে এবং একটি দল শর্ত সাপেক্ষে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছিল। ইসি এত দিন বলে এসেছে, সব দল না চাইলে জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে না। এখন তারা বলছে, সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা তাদের আছে, তবে এখনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি।
কিন্তু এর মধ্যে দেড় লাখ ইভিএম কেনার জন্য ৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে ইসি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইসিকে ইভিএম সরবরাহ করবে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ)। ‘নির্বাচন-ব্যবস্থায় অধিকতর স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ক্রয়, সংরক্ষণ ও ব্যবহার’ শীর্ষক একটি পাঁচ বছর মেয়াদি প্রকল্পের অধীনে দেড় লাখ ইভিএম সংগ্রহ করতে চায় ইসি। অবশ্য ১৯ আগস্ট এ প্রকল্পটি নিয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।
এই হযবরল অবস্থার মধ্যেই গত জুলাই থেকে ইভিএম আমদানির প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ জন্য ঋণপত্র খুলতে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদন নিয়েছে ট্রাস্ট ব্যাংক। চীন, হংকংসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকে ইভিএম ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি এনে বিএমটিএফ তা নির্বাচন কমিশনকে সরবরাহ করবে বলে নথিপত্রে উল্লেখ রয়েছে। ইতিমধ্যে ৭৯৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকার ঋণপত্র খোলা হয়েছে। যন্ত্রপাতি আমদানিতে মোট ব্যয় হবে ২ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকা।
আইন অনুযায়ী, ব্যাংক তার মূলধনের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত সরাসরি (ফান্ডেড) কোনো গ্রাহককে ঋণ দিতে পারে। আর নন ফান্ডেডসহ ৩৫ শতাংশ দেওয়ার সুযোগ আছে। নন ফান্ডেড হলো ঋণপত্র, গ্যারান্টিসহ সরাসরি নয়, এমন দায়। এ হিসাবে ট্রাস্ট ব্যাংক সর্বোচ্চ ৭১৫ কোটি টাকা ঋণ ও ঋণসুবিধা দিতে পারে। কিন্তু ইভিএম কিনতে বিএমটিএফকে ২ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকার সুবিধা দিতে হবে ট্রাস্ট ব্যাংকে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদন চায় ট্রাস্ট ব্যাংক। গত ৫ জুলাই ট্রাস্ট ব্যাংক এ অনুমোদন চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেদিনই বিশেষ এ অনুমোদন দিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘ইভিএম আমদানিতে নন ফান্ডেড সুবিধা দেবে ট্রাস্ট ব্যাংক। এ জন্য বিশেষ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।’
নথিপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত ১৯ জুলাই ট্রাস্ট ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় বিএমটিএফের ২ হাজার ৬৯৬ কোটি টাকার আমদানি ঋণপত্র খোলার সিদ্ধান্ত হয়। এর আওতায় চীন, হংকংসহ আরও কয়েকটি দেশ থেকে আনা হবে অটোমেটেড ভোট কাউন্টিং মেশিন, ই-ইংক ডিসপ্লে উইথ সফটওয়্যার অ্যান্ড ইন্টিগ্রেশন সাপোর্ট অব ব্যালট, পাওয়ার ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ইউনিট ও ৮ ইঞ্চি টাচ মডিউল ভোটিং মেশিন।
তবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় অনুমোদনের আগেই ৫ জুলাই বিএমটিএফকে এসব সুবিধা দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদন করে ট্রাস্ট ব্যাংক। তখন বলা হয়, ট্রাস্ট ব্যাংকের পরবর্তী পরিচালনা পর্ষদের সভায় বিষয়টি অনুমোদন করা হবে।
জানতে চাইলে সাবেক মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এম হাফিজউদ্দীন খান বলেন, প্রকল্প অনুমোদনের আগে ঋণপত্র খোলা বেআইনি। আগে প্রকল্প অনুমোদন হতে হবে, এরপর তা জাতীয় অর্থনীতি পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাস হয়ে ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির অনুমোদন নিতে হবে। এরপর কার্যাদেশ হবে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘ইভিএম কেনার জন্য এই তাড়াহুড়া কেন, তাদের (ইসি) উদ্দেশ্য কী?’