শ্রদ্ধাঞ্জলি কুলদীপ নায়ার: সাংবাদিকতার আলোকবর্তিকা

Slider ফুলজান বিবির বাংলা বিনোদন ও মিডিয়া


মাহ্ফুজ আনাম: কুলদীপ নায়ারের মৃত্যুতে বাংলাদেশ একজন আন্তরিক ও বিশ্বস্ত বন্ধুকে হারাল, ভারত হারাল ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের একজন বিবেকবান রক্ষাককে। পাকিস্তান হারাল দুই প্রতিবেশীদের মধ্যে বৃহত্তর বোঝাপড়ার অতন্দ্র কণ্ঠস্বর। দক্ষিণ এশিয়া হারাল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সর্বত্র সর্বাধিক জোরালো বক্তব্যের অধিকারী ব্যক্তিত্বকে। সাংবাদিকতা হারাল এই পেশার নীতি-আদর্শের জন্য অতুলনীয় উদাহরণকে। আর মানবতা হারাল মানুষের শুভবোধে ওপর প্রকৃত আস্থাশীল একজনকে।

কুলদীপ নায়ার ১৯৪৭ সালে দুই দেশ (ভারত-পাকিস্তান) ভাগের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন; এ ঘটনা তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে শরণার্থী করে ফেলে। এর ফলশ্রুতিতে দক্ষিণ এশিয়ার দুই বড় দেশের মধ্যে সন্দেহ, তিক্ততা ও ঘৃণা দেখেছেন। দেখেছেন দেশ দুটির মধ্যে যুদ্ধ এবং যুদ্ধাবস্থার পরিস্থিতি। তারপরও নেতিবাচক প্রভাবের বিপক্ষে ভালোকিছুর আশায় জীবনভর কাজ করে গেছেন। তিনি দুই দেশের ভাগ হয়ে যাওয়াকে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু মানতে পারেননি এর ফলে যে ঘৃণার জন্ম হয়েছে তা। তিনি জীবনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সমৃদ্ধি, শান্তি ও উন্নয়নে কাজ করে গেছেন।

কুলদীপ নায়ার জীবনভর এমন একজন সাংবাদিক, যিনি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা ও ঘৃণার বিরুদ্ধে সর্ব শক্তি দিয়ে লড়াই করে গেছেন। তিনি সব সময় প্রতিবেশীদের বিকাশ এবং তাদের মধ্যে বৃহত্তর উন্নয়নে সাহায্য করার জন্য ভারতে অধিকতর দায়িত্বের কথা বলতেন। একজন সাংবাদিক হিসেবে সারা জীবন এ পেশার মৌলিক নীতি ও আদর্শের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা ছিল অতুলনীয়। তরুণদের সাংবাদিকতা পেশায় আসার ক্ষেত্রে উৎসাহ দিতে গিয়ে তিনি বলতেন, শেষ বিচারে তাদের সাফল্য নির্ভর করবে ‘জনস্বার্থে’র বিষয়গুলো তুলে ধরার মধ্যে। তিনি গণমাধ্যমের করপোরেট সংস্কৃতিকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি মনে করতেন লাভের পেছনে ছুটে চলা গণমাধ্যমের জন্য মৌলিক মূল্যবোধের জন্য হুমকি স্বরূপ।

নিজের লেখনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সক্রিয় সমর্থক ছিলেন কুলদীপ নায়ার। জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের মধ্যে তিনি অন্যতম যিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত নিজের আগ্রহ ধরে রেখেছেন। তিনি নিয়মিত বাংলাদেশে আসতেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নতির বিষয়ে নিজের সূক্ষ্ম দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিশ্লেষণ করে লিখেছেন। আমাদের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রায় তিনি উল্লসিত হতেন। আবার তা হুমকির মুখে পড়লে সতর্ক করতেন। এ বিষয়ে তিনি সাবধানও করেছেন।

তাঁর সর্বশেষ লেখাটি ‘ডেইলি স্টার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ১৪ আগস্ট ২০১৮-তে। মৃত্যুর অল্প কিছুদিন আগে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে এ লেখার শিরোনাম ছিল ‘৭১ বছর চলেছে, শীতল সম্পর্ক অব্যাহত’। লেখাটিতে তিনি নিজের চেষ্টা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে না পৌঁছানোয় বেদনা গোপন করেননি। কিন্তু তিনি কখনো হাল ছেড়ে দেননি। লেখাটিতে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাঁর সারা জীবনের সংগ্রামের কথা স্মরণ করেছেন। তিনি ভারত ও পাকিস্তানের ওয়াগা সীমান্তে মোমবাতি প্রজ্বলনের ঘটনাটিও তুলে এনেছেন, যা তিনি প্রায় ২০ বছর আগে শুরু করেছিলেন।Eprothomalo

প্রতি বছরের আগস্টে সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার অন্যান্য সহকর্মীদের নিয়ে ওয়াগা গিয়ে সীমান্তে দু পারের মানুষের শান্তির প্রতীক হিসেবে মোমবাতি জ্বালান। অল্প কজন মানুষ নিয়ে শুরু করা এ অনুষ্ঠানে এখন হাজারো মানুষের অংশগ্রহণ করে বলে তিনি কলামে লেখেন। ওয়াগা সীমান্ত ছাড়াও আরও বেশি কিছু সীমান্তেও এমন অনুষ্ঠান চালু আছে। দুই প্রতিবেশির মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়াকে আরও শক্তিশালী করতে এটাই ছিল তাঁর প্রয়াস। এখন এ জন্য মোমবাতি হাতে নিয়ে কে দাঁড়াবে?

দ্য ডেইলি স্টারের জন্য কুলদীপ নায়ার ছিলেন উদ্দীপক পথ প্রদর্শক, এই পেশার মূল্যবোধের সর্বোত্তম প্রতীক। কুলদীপ নায়ারের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের ভান্ডার থেকে শেখার জন্য মাঝেমধ্যে তাঁর এ দেশে আসাটা আমাদের জন্য ছিল শেখার সুযোগ। তাঁর মহত্ত্ব, নম্রতা ও দ্য ডেইলি স্টারের জনগণের পাশে থাকবে, এমন তাঁর ইচ্ছা আমাদের এই কাজকে সহজ করে দিয়েছিল। তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে শিশুর মতো লালন করতেন ও আগলে রাখতেন যাতে পত্রিকাটি গুনে, মানে ও বিশ্বাসযোগ্যতায় জাতীয়ভাবে এবং এ অঞ্চলে জায়গা করে নিতে পারে।
তাঁর আত্মা শান্তি পাক।

মাহ্ফুজ আনাম, ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক ও প্রকাশক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *