ঢাকা: ভয়াল সেই গ্রেনেড হামলার পর পেরিয়ে গেছে ১৪ বছর। বিচারের অপেক্ষায় আছেন ওই ঘটনায় নিহতদের স্বজন ও আহতরা। ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে করা মামলার বিচারকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। মামলার বিচারিক কার্যক্রমের সব শেষ ধাপ যুক্তিতর্কের শুনানি শেষ হতে চলেছে। এ মামলার অন্যতম আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়েছে। আগামী ২৭, ২৮ ও ২৯শে আগস্ট আবারো যুক্তিতর্কের শুনানির দিন ধার্য আছে।
এর মধ্য দিয়ে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হবে। এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আইনি যুক্তি উপস্থাপন শেষে চাঞ্চল্যকর এ মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসবে। সেপ্টেম্বরেই এই রায় হতে পারে বলে সরকারের আইনমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্যে আভাস পাওয়া গেছে।
২০০৪ সালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা হয়। হামলায় আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। আহত হন কয়েক শ নেতাকর্মী ও বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। নিহতদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট মো. জিল্লুর রহমানের স্ত্রী, মহিলা আওয়ামী লীগের তখনকার সভাপতি আইভি রহমান, হামলার সময় ওই সময়ের বিরোধী দলীয় নেতা, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানবঢাল তৈরি করে রক্ষা করেন দলের নেতাকর্মীরা।
অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান শেখ হাসিনা। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) সহ তিনটি জঙ্গি সংগঠন নারকীয় এ হামলা চালায় যা মামলার তদন্তে উঠে আসে। হামলার নেপথ্যে রাজনৈতিক দলের ইন্ধন ও ষড়যন্ত্র ছিল বলেও তদন্তে বলা হয়। এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে করা দুই মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিলের পর ২০১২ সালের মার্চে দ্বিতীয় দফায় অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এরপর সাড়ে ছয় বছর ধরে বিচারকাজ চলছে। নাজিমউদ্দিন রোডের পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের পাশে স্থাপিত বিশেষ এজলাসে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক শাহেদ নূর উদ্দিনের আদালতে এ বিচারকাজ চলছে। চাঞ্চল্যকর এ মামলায় উল্লেখযোগ্য আসামি হিসেবে রয়েছেন, বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান, চারদলীয় জোট সরকারের তখনকার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক ভূমি উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব হারিছ চৌধুরী।
নৃশংস এই ঘটনায় যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের স্বজন ও আহতরা বলছেন- বিচারের জন্য তাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। একে একে পার করেছেন ১৪টি বছর। এখন সেই অপেক্ষার অবসান তারা চান। ২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট নৃশংস ওই হামলায় নিহত হয়েছিলেন কবি নজরুল কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র মামুন মৃধা (১৯)। পটুয়াখালির গলাচিপার আলীপুর গ্রামের মোতালেব মৃধা তার ছেলে মামুনকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু ভয়াল সেই গ্রেনেড হামলা তার সেই স্বপ্ন চূড়মার করে দেয়। মোতালেব মৃধা মানবজমিনকে বলেন, ছেলেকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিল। সে পরিবারের হাল ধরবে। বিগত ১৪ বছর ধরে ছেলে হত্যার বিচারের অপেক্ষায় আছি। শুনেছি বিচারকাজ নাকি শেষ পর্যায়ে।
আমি আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই। তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। বিচার হলে আমার ছেলের আত্মা শান্তি পাবে।’ ওই ঘটনায় গুরুতর আহত হয়েছিলেন রাশেদা আক্তার রুমা (৪০)। এখনো তিনি ক্রাচে ভর করে হাঁটেন। বর্তমানে তিনি বংশাল থানা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, ‘বিচারের আশায় দীর্ঘ সময় পার করেছি। বিচার কবে শেষ হবে, সেই আশায় বুক বেঁধে আছি। আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই আমরা।’ তিনি বলেন, ‘এই দেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার আসামিদের বিচার শেষ হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজও হচ্ছে। ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচারকাজও আশা করি শেষ হবে এবং আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা হবে।’
মামলা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, এ মামলার অন্যতম আসামি সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের পক্ষে যুক্তিতর্কের শুনানির মধ্য দিয়ে আসামিপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ হবে। এরপরই রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আইনি যুক্তিতে শুনানি করবেন। ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেছেন। শুনানিতে নৃশংস এই হামলার ঘটনায় আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদ-ের দাবি জানান তারা। এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ৪৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে ২২৫ জন সাক্ষ্য দেন। আর এখন পর্যন্ত ১০৮ কার্যদিবস যুক্তিতর্ক কার্যক্রম চলেছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। এর মধ্যে ২৫ কার্যদিবসে রাষ্ট্রপক্ষ ও বাকি কার্যদিবসগুলোতে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান আশা করছেন যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে অচিরেই মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আসবে। অন্যদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বলেছেন, সেপ্টেম্বরেই এ মামলার রায় ঘোষণা হবে। এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সৈয়দ রেজাউর রহমান মানবজমিনকে বলেন, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনের দুটি মামলায় বিচার এবং নিষ্পত্তির দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি আমরা। আসামি লুৎফুজ্জামান বাবরের পক্ষে শুনানি শেষে আমরা হয়তো আইনগত কিছু বিষয় উত্থাপন করবো। এটি একদিনেই হয়ে যাবে। এরপর আশা করি অচিরেই দুটো মামলায় রায়ের তারিখ ধার্য হবে। তিনি বলেন, শুনানিতে আমরা এই মামলার আসামিদের সর্বোচ্চ ও দৃষ্টান্তমূলক সাজার দাবি জানিয়েছি।
আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে, এ মামলায় অধিকতর তদন্তে মোট ৫২ জন আসামির নাম উল্লেখ করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশট) দাখিল করা হয়। তবে, মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা ও অন্য মামলায় তিন আসামির মৃত্যুদ-ের রায় ইতিমধ্যে কার্যকর হয়েছে। এরা হলেনÑ জামায়াতের সাবেক নেতা আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, হরকাতুল জিহাদের মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুর আলম বিপুল। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জানান, এ ঘটনায় হত্যা মামলার আসামি ৫২ জন। আর বিস্ফোরকদ্রব্য আইনের মামলায় ৪১ জন আসামি। বিস্ফোরক আইনের মামলার ৪১ জন আসামির নাম হত্যা মামলাতেও রয়েছে।
৫২ আসামির মধ্যে ৩৪ জন গ্রেপ্তার হন। তাদের মধ্যে ৮ জন জামিনে ও ২৩ জন কারাগারে রয়েছেন। এ মামলায় ১৮ আসামি এখনো পলাতক রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী পলাতকদের অনুপস্থিতিতেই বিচার কাজ চলছে। আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে, এক বছর ১০ মাস ২৯ দিন অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১২ সালের ১৮ই মার্চ দ্বিতীয় দফায় অভিযোগ গঠন করেন সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক। প্রথম দফা অভিযোগপত্রে ২২ জন আসামি থাকলেও অধিকতর তদন্তে বিএনপি নেতা তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ আরো ৩০ জনকে আসামি করা হয়।
২০০৪ সালের ২১শে আগস্ট নৃশংস এই গ্রেনেড হামলার পর নানা কারণে মামলার কার্যক্রম থমকে যায়। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নতুন করে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়। তদন্ত শেষে ২০০৮ সালের ১১ই জুন আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। অভিযোগপত্রে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজি নেতা মুফতি হান্নান (অন্য মামলায় মৃত্যুদ- কার্যকর)সহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর মামলার অধিকতর তদন্ত শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়। তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২রা জুলাই সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল কাহার আকন্দ সম্পূরক অভিযোগপত্র দেন। এতে বিএনপি নেতা তারেক রহমান, বিএনপি চেয়ারপারসনের তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদসহ ৩০ জনকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।