বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে নায়কের বড়ই অভাব। এই খরা বহু সময় ধরে চলছে।
কেন এই খরা, কেন এই সংকট? এই সংকট নিয়ে আলোচনা করলে প্রথমে যার কথা আসে, তিনি হলেন- লেখক।
সৃজনশীল এবং দায়িত্বশীল লেখকের অভাব রয়েছে এই বাংলায়! আমাদের দেশের একজন লেখক সাহিত্যিক সব বিষয়েই লিখে থাকেন। আমার সহজ প্রশ্ন হলো-কেন? একজন লেখককে সব বিষয়ে লিখতে হবে কেন? তাকে সব বিষয়ে না লিখলে কি হয় না? চলমান সময়ে গা ভাসিয়ে কত দূর যাওয়া যায়? জোর করে আর কিছু হোক বা না হোক, সৃজনশীল কিছু হবে না- এটা নিশ্চিত।
এই সময়ের লেখকেরা আরেকটি কাজ করে, তা হলো যে কোন কিছু সৃষ্টিতে খুব তাড়াহুড়ো করা। তাদের উপর এমন একটি ফরমায়েশি চাপ থাকে যে- রাতদিন খেটে রাজমিস্ত্রিদের মতো শব্দের পর শব্দ বসিয়ে একটি ইটের বাড়ি বানানোর মতো করে একটি রচনা লিখে ফেলে। যেনো, কোন রকমে এই লেখা শেষ করাটাই তার বড় সাফল্য। এই বড় সাফল্যতে তাদের মন ভরে না। তাদের মন, পঁচা ডোবা বদ্ধপুকুরের পানির মতো বুদবুদ করে। তখন তাদের প্রয়োজন আরও সাফল্যের।
শুরু হয় উকিঁ ঝুঁকি, সাফল্যের পেছনে দিকবিদিক দৌড়।
মজাপুকুরের ডোবা পানির মতো নষ্ট রচনাটাকে এখনই প্রকাশ করতে হবে। প্রিন্ট বা অনলাইন-যে কোন মাধ্যমে প্রকাশিত হলেই হবে, এখনই লাইক কমেন্টের মতো প্রচুর প্রশংসা পেতে হবে, শুধু প্রশংসা পেয়ে বসে থাকলে চলবে না, নগদ নগদ একটা তাজা পুরস্কার পেতে হবে। হতে হবে একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদক অথবা নিদেনপক্ষে বাঙলা একাডেমি পদক। এর নিচে হলে লেখকের ইজ্জত থাকে না।
এই যে সব কিছু দ্রুত পেতে চাওয়া, এখনি পেতে চাওয়া, এই প্রবণতা একটা অসুখ। এই অসুখের নাম ‘জলদি ম্যানিয়া’। এই জলদি ম্যানিয়া যাকে পায়, তার না হয়ে ওঠে লেখা, না হয় শিল্প। আর এই কারণে আমাদের শিল্প সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে নায়ক খুঁজে পাওয়া যায় না। নির্বোধ আর কপট লোকদের কলমে নায়ক হয়ে ওঠে না কেউ। আবার বিপরীত দিকে যদি তাকাই। এখন, এই জনপদে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন দায়িত্বশীল লেখক থাকার কথা, আছে নিশ্চয়ই। তারা থাকার পরও কেনো এই সংকট বাড়তে থাকবে? তবে কি সমস্যা অন্যখানে? তাহলে কি বলবো যে, নায়ক হওয়ার মতো কোন উপকরণ, উপাদান নেই এই জনপদে? এই কথাটা কি বিশ্বাস করতে হবে?
কী নেই আমাদের! এখানে আছে রাজনৈতিক চর্চা, আছে সাহিত্যিক, কবি, শিল্পী, গায়ক, সংগঠক, বুদ্ধিজীবী। আছে সহজ সরল দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ভালো মানুষ, পায়ে হেঁটে বই পড়ানোর আলোর কারিগর পালান সরকার, আছে বই নাবিক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। উপকরণ বা উপাদান নেই, এই কথাটা এখন তাহলে টিকলো না। তাহলে সমস্যা কোথায়?
তবে কি বলবো, সমস্যা প্রথিত রয়েছে আমাদের চিন্তায়, চেতনায় আর ভালোবাসায়? একজন লেখক যে বিষয় নিয়ে লিখবে, সে বিষয়টি ভালো মতো গবেষণা না করে, না জেনে না বুঝে লিখতে বসলে যা হবার তাই হবে। না হবে চরিত্র নির্মাণ, না হবে সঠিক ভাবে উপস্থাপন, তখন গোটা শ্রমটাই হবে পণ্ডু।
একজন লেখককে চরিত্রের গহীনে প্রবেশ করতে হয়। যে লেখক চরিত্রের যত গভীরে প্রবেশ করবে, চরিত্র নির্মাণে সে তত সফল হবে। সফল ভাবে চরিত্র নির্মাণ আর উপস্থাপন করতে পারলে সেই কাজটি কালোর্ত্তীণ হতে বাধ্য। আমাদের এই সংকট সময়ে কালোর্ত্তীণ হবার পথে প্রথম পদক্ষেপ নিলেন নাট্যকার আনন জামান।
দীর্ঘ গবেষণায় তিনি রচনা করেছেন মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর জীবনী আশ্রিত উপাখ্যান ‘শ্রাবণ ট্র্যাজেডি’। তিনি বাংলার মহানায়ককে তুলে ধরেছেন ইতিহাস আর বাস্তবতার নিরিখে। কড়াল স্রোতস্বিনী নদীর মতো গভীর আবেগ দিয়ে নির্মাণ করেছেন মঞ্চ নাটক -শ্রাবণ ট্র্যাজেডি। হত্যা, ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাস ঘাতকতাই এই নাটকের মূল উপজীব্য।
এক দঙ্গল লোক ষড়যন্ত্র করছে, তারা কারা? আর কার সাথেই বা ষড়যন্ত্র করছে? যে মানুষটা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মতো প্রশস্ত, সবচেয়ে উঁচু আর কঠিন শিলা পাহাড়ের মতো অটল আর দৃঢ়। যে মানুষটা বাংলার সবগুলো নদীর সমান দীর্ঘ, যে মানুষটা এই জনপদের বৃষ্টিভেজা সবুজ আর শ্যামল ফসলের মতো সজীব। যার প্রাণ বাংলা লোকায়ত গানের মতো দরদী আর আবেগী-তার সাথে যড়যন্ত্র করছে?
বাংলার এই চিহ্নিত বেঈমান, যারা নিজের নেতাকে হত্যা করতে যাদের বিবেক একবারও কেঁপে ওঠেনি, কালের বিচারে সেই অসভ্য ইতর মানুষগুলো আজ নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে। যারা বঙ্গবন্ধুর বুকের লাল রক্তের ধারা বইয়েছে তারই গড়া শ্যামল বাংলায়, তারা কি বিনা বিচারে পার পেয়ে যাবে? অবশ্যই না। ইতিহাসের এই মহানায়ককে হত্যার অপরাধের পিশাচ খুনিদের বিচার করেছে এই বাংলার সাধারণ মানুষ। ‘শ্রাবণ ট্র্যাজেডি’ সেই মহানায়ক নিয়ে ষড়যন্ত্র, হত্যা আর বিচারের মহাকাব্যিক অাখ্যান। অত্যন্ত দরদ আর পরম মমতা দিয়ে এই মহানায়ককে পরম যত্নে বুনেছেন নবীন এই নাট্যকার।
নাটকের গল্প কি ভাবে দর্শকদের কাছে পৌঁছাবে, তার রীতি ঠিক করেন নাট্যকার। সে ক্ষেত্রে নাট্যকারের নিজস্ব ঢং থাকতে পারে। থাকা উচিতও। তা না হলে সব নাট্যকার একই ধারায়, এই ভাবে গল্প বলে যেতো। শ্রাবণ ট্রাজেডি নাটকের বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে নায়কের বড়ই অভাব। এই খরা বহু সময় ধরে চলছে।
কেন এই খরা, কেন এই সংকট? এই সংকট নিয়ে আলোচনা করলে প্রথমে যার কথা আসে, তিনি হলেন- লেখক।
সৃজনশীল এবং দায়িত্বশীল লেখকের অভাব রয়েছে এই বাংলায়! আমাদের দেশের একজন লেখক সাহিত্যিক সব বিষয়েই লিখে থাকেন। আমার সহজ প্রশ্ন হলো-কেন? একজন লেখককে সব বিষয়ে লিখতে হবে কেন? তাকে সব বিষয়ে না লিখলে কি হয় না? চলমান সময়ে গা ভাসিয়ে কত দূর যাওয়া যায়? জোর করে আর কিছু হোক বা না হোক, সৃজনশীল কিছু হবে না- এটা নিশ্চিত।
এই সময়ের লেখকেরা আরেকটি কাজ করে, তা হলো যে কোন কিছু সৃষ্টিতে খুব তাড়াহুড়ো করা। তাদের উপর এমন একটি ফরমায়েশি চাপ থাকে যে- রাতদিন খেটে রাজমিস্ত্রিদের মতো শব্দের পর শব্দ বসিয়ে একটি ইটের বাড়ি বানানোর মতো করে একটি রচনা লিখে ফেলে। যেনো, কোন রকমে এই লেখা শেষ করাটাই তার বড় সাফল্য। এই বড় সাফল্যতে তাদের মন ভরে না। তাদের মন, পঁচা ডোবা বদ্ধপুকুরের পানির মতো বুদবুদ করে। তখন তাদের প্রয়োজন আরও সাফল্যের।
শুরু হয় উকিঁ ঝুঁকি, সাফল্যের পেছনে দিকবিদিক দৌড়।
মজাপুকুরের ডোবা পানির মতো নষ্ট রচনাটাকে এখনই প্রকাশ করতে হবে। প্রিন্ট বা অনলাইন-যে কোন মাধ্যমে প্রকাশিত হলেই হবে, এখনই লাইক কমেন্টের মতো প্রচুর প্রশংসা পেতে হবে, শুধু প্রশংসা পেয়ে বসে থাকলে চলবে না, নগদ নগদ একটা তাজা পুরস্কার পেতে হবে। হতে হবে একুশে পদক বা স্বাধীনতা পদক অথবা নিদেনপক্ষে বাঙলা একাডেমি পদক। এর নিচে হলে লেখকের ইজ্জত থাকে না।
এই যে সব কিছু দ্রুত পেতে চাওয়া, এখনি পেতে চাওয়া, এই প্রবণতা একটা অসুখ। এই অসুখের নাম ‘জলদি ম্যানিয়া’। এই জলদি ম্যানিয়া যাকে পায়, তার না হয়ে ওঠে লেখা, না হয় শিল্প। আর এই কারণে আমাদের শিল্প সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে নায়ক খুঁজে পাওয়া যায় না। নির্বোধ আর কপট লোকদের কলমে নায়ক হয়ে ওঠে না কেউ। আবার বিপরীত দিকে যদি তাকাই। এখন, এই জনপদে শুভবুদ্ধি সম্পন্ন দায়িত্বশীল লেখক থাকার কথা, আছে নিশ্চয়ই। তারা থাকার পরও কেনো এই সংকট বাড়তে থাকবে? তবে কি সমস্যা অন্যখানে? তাহলে কি বলবো যে, নায়ক হওয়ার মতো কোন উপকরণ, উপাদান নেই এই জনপদে? এই কথাটা কি বিশ্বাস করতে হবে?
কী নেই আমাদের! এখানে আছে রাজনৈতিক চর্চা, আছে সাহিত্যিক, কবি, শিল্পী, গায়ক, সংগঠক, বুদ্ধিজীবী। আছে সহজ সরল দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ভালো মানুষ, পায়ে হেঁটে বই পড়ানোর আলোর কারিগর পালান সরকার, আছে বই নাবিক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। উপকরণ বা উপাদান নেই, এই কথাটা এখন তাহলে টিকলো না। তাহলে সমস্যা কোথায়?
তবে কি বলবো, সমস্যা প্রথিত রয়েছে আমাদের চিন্তায়, চেতনায় আর ভালোবাসায়? একজন লেখক যে বিষয় নিয়ে লিখবে, সে বিষয়টি ভালো মতো গবেষণা না করে, না জেনে না বুঝে লিখতে বসলে যা হবার তাই হবে। না হবে চরিত্র নির্মাণ, না হবে সঠিক ভাবে উপস্থাপন, তখন গোটা শ্রমটাই হবে পণ্ডু।
একজন লেখককে চরিত্রের গহীনে প্রবেশ করতে হয়। যে লেখক চরিত্রের যত গভীরে প্রবেশ করবে, চরিত্র নির্মাণে সে তত সফল হবে। সফল ভাবে চরিত্র নির্মাণ আর উপস্থাপন করতে পারলে সেই কাজটি কালোর্ত্তীণ হতে বাধ্য। আমাদের এই সংকট সময়ে কালোর্ত্তীণ হবার পথে প্রথম পদক্ষেপ নিলেন নাট্যকার আনন জামান।
দীর্ঘ গবেষণায় তিনি রচনা করেছেন মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর জীবনী আশ্রিত উপাখ্যান ‘শ্রাবণ ট্র্যাজেডি’। তিনি বাংলার মহানায়ককে তুলে ধরেছেন ইতিহাস আর বাস্তবতার নিরিখে। কড়াল স্রোতস্বিনী নদীর মতো গভীর আবেগ দিয়ে নির্মাণ করেছেন মঞ্চ নাটক -শ্রাবণ ট্র্যাজেডি। হত্যা, ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাস ঘাতকতাই এই নাটকের মূল উপজীব্য।
এক দঙ্গল লোক ষড়যন্ত্র করছে, তারা কারা? আর কার সাথেই বা ষড়যন্ত্র করছে? যে মানুষটা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মতো প্রশস্ত, সবচেয়ে উঁচু আর কঠিন শিলা পাহাড়ের মতো অটল আর দৃঢ়। যে মানুষটা বাংলার সবগুলো নদীর সমান দীর্ঘ, যে মানুষটা এই জনপদের বৃষ্টিভেজা সবুজ আর শ্যামল ফসলের মতো সজীব। যার প্রাণ বাংলা লোকায়ত গানের মতো দরদী আর আবেগী-তার সাথে যড়যন্ত্র করছে?
বাংলার এই চিহ্নিত বেঈমান, যারা নিজের নেতাকে হত্যা করতে যাদের বিবেক একবারও কেঁপে ওঠেনি, কালের বিচারে সেই অসভ্য ইতর মানুষগুলো আজ নিক্ষিপ্ত হয়েছে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে। যারা বঙ্গবন্ধুর বুকের লাল রক্তের ধারা বইয়েছে তারই গড়া শ্যামল বাংলায়, তারা কি বিনা বিচারে পার পেয়ে যাবে? অবশ্যই না। ইতিহাসের এই মহানায়ককে হত্যার অপরাধের পিশাচ খুনিদের বিচার করেছে এই বাংলার সাধারণ মানুষ। ‘শ্রাবণ ট্র্যাজেডি’ সেই মহানায়ক নিয়ে ষড়যন্ত্র, হত্যা আর বিচারের মহাকাব্যিক অাখ্যান। অত্যন্ত দরদ আর পরম মমতা দিয়ে এই মহানায়ককে পরম যত্নে বুনেছেন নবীন এই নাট্যকার।
নাটকের গল্প কি ভাবে দর্শকদের কাছে পৌঁছাবে, তার রীতি ঠিক করেন নাট্যকার। সে ক্ষেত্রে নাট্যকারের নিজস্ব ঢং থাকতে পারে। থাকা উচিতও। তা না হলে সব নাট্যকার একই ধারায়, এই ভাবে গল্প বলে যেতো। শ্রাবণ ট্রাজেডি নাটকের পথম শো দেখে গুণীজনদের দু’একজন বলেছেন, নাটকে কাব্যিক দিকটা একটু কমাতে, যাতে অনেকই বুঝতে পারে। এই কথায় যুক্তি আছে। তবে এই দিকটাও খেয়াল রাখতে হবে- সব নাটক কি সরল আর সহজ ভাবে উপস্থাপন হয়? হয়েছে আগে? হোক না এইটা তার নিজের রীতি। কৃষক মানুষ যদি সমাজতন্ত্র বুঝতে পারে, লালনের গানের ভেদ খুঁজে বেড়ায়, মারফতি গানের মর্ম অনুধাবন করে মাথা নাড়াতে পারে। তাহলে আনন জামানের এই নাটকটিও সাধারণ মানুষ বুঝতে পারবে।
সৈয়দ শামসুল হকের ‘ইর্ষা’, ‘নুরুলদিনের সারা জীবন’ অথবা সেলিম আল দীনের ‘চাকা’, ‘কীর্তনখোলা’সহ আরো অনেক নাটকের বর্ণনারীতি আর গল্প বলার ঢং আলাদা আলাদা। কারো সাথে কারো মিলে না। সেখানে একজন নবীন নাট্যকার তার নিজের মতো করে গল্প বলবে বলুক, সংলাপে কারুকাজ করবে, করুক। তাতে কিন্তু নাটকের মান কমবে না বরং নাটকের মান ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছি।
কথা বলছিলাম-শিল্প সাহিত্যে নায়ক নিয়ে, নায়ক না হয়ে ওঠার সংকট নিয়ে। যতদুর মনে পড়ে- সত্তর দশক থেকে বাংলা সাহিত্যে নায়ক খরা চলছে, এই বদ হাওয়া সংস্কৃতির অন্যান্য মাধ্যমেও লেগেছে। সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস’, তারাশংকরের ‘হাসুলি বাঁকের উপকথা’ ছাড়া অন্য কোন উপন্যাসে নায়ক হয়ে উঠতে দেখেনি অনেকেই।
গল্পের প্রধান চরিত্র বলতেই কিন্তু নায়ক বুঝি না। সেইতো নায়ক, যে সময়ের দাবি মিটাতে পারে, সমাজ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে। যিনি সংগ্রাম করবেন সমাজের মানুষের জন্য, বিপ্লব করবেন সময়ের প্রয়োজনে। নায়কের স্বার্থক রূপ আমরা দেখতে পাবো লেখকের ব্যক্তিগত দক্ষতা আর চেতনায়। পদ্মা নদীর মাঝি’র কুবের কিন্তু সে অর্থে নায়ক হয়ে ওঠতে পারে নাই।
আশির দশক থেকে শুরু, বিশেষ করে নব্বই দশক থেকে সাহিত্যে দেখে আসছি, কতগুলো নীতিহীন, নির্বোধ, দায় দায়িত্বহীন, অপদার্থকে নায়ক বানানোর চেষ্টা করেছে কেউ কেউ। যাদের না আছে কোন আদর্শ, না আছে কোন চেতনা- শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ আবার হুমায়ূন আহমেদের ‘হিমু’। এই চরিত্রগুলো এতো জনপ্রিয়, কিন্তু সত্যিকারের নায়ক না।
এখনকার, এই সময়ের অনেকে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে বেকুব আর বিকৃত মানুষদের নিয়ে ট্রোল করে মজা পায়। বিষয়টা এমন যে, ওদের নিয়ে সব সময় কিছু নিয়ে হাসাহাসি করতে হবে, আর হাসাহাসি করাটাই তাদের কাছে সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
আরও কিছু পাঠক আছে, এরা চলমান পাঠক, তারা শুধু পাঠ করে ‘ফেসবুক’। তাদের কাজ হলো ফূর্তি করা, মজা নেওয়া। এইটা আরেকটা রোগ। এর নাম হলো ‘চলৎ মেনিয়া’। তারা সমসাময়িক চলমান বিষয় নিয়ে সারাদিন সময় মজা নেয় আর মূল্যবান সময় ব্যয় করে। তারা একটা কিছু পেলেই হলো, তা নিয়ে হাসাহাসি করে, ট্রল করে, রশিকতা করে।
সম্প্রতি সময়ে কয়েকজন মানুষকে নিয়ে চলৎ মেনিয়ারা মজে ছিল। যে বিষয়গুলোতে তারা মজা নিয়েছে, তাদের মধ্যে মাহফুজুর রহমানের গান, হিরো আলমের অভিনয়, হেলেনা জাহাঙ্গীরের উপস্থাপনা, আর এখন চলছে সিফাত উল্লার ওরফে সেফুদা’র অশ্লীল অঙ্গ-ভঙ্গির কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা।
ভাবতেই অবাক লাগে, মানুষ কাদের নিয়ে পড়ে আছে! কেনো পড়ে আছে? এর উত্তর কি কেউ জানে? অথচ এই সময়ের সেরা মানুষগুলোকে নিয়ে তাদের কোনই আগ্রহ নেই। বলা যেতে পারে, পাটের জিন আবিষ্কারক মাকসুদুল আলমের কথা, পাটের পলিথিন আবিষ্কারক ড. মোবারক আহমদ খানের কথা, এমন আরও কতশত অখ্যাত মানুষ আমাদের সমাজকে পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে, তাদের কথা আমরা জানিই না। অথচ তারাই আমাদের সত্যিকারের নায়ক হতে পারতো-সাহিত্যে, নাটকে, চলচ্চিত্রে তথা গোটা সংস্কৃতিতে।
এখানে পাঠকেরও কাণ্ডজ্ঞান আর রুচিবোধ নিয়ে প্রশ্ন করা যায় কি না ভাবা উচিত। যদিও পাঠককে দোষ দেওয়ার পক্ষে আমি না, তারপরও পাঠকের সচেতনতা আশা করতেই পারি। কারণ একজন পাঠককেই নির্ধারণ করতে হবে, তিনি কি পড়বেন আর কি পড়বেন না। সমাজ পরিবর্তন চাইবেন, কিন্তু সমাজ পরিবর্তনে কোন ভূমিকা রাখবেন না, তাতো হয় না। আকাশ থেকে তো আর সমাজ পরিবর্তন হয় না।
চলমান অনেক অনায়কদের ভীড়ে এই সময়ের তরুণ নাট্যকার আনন জামান মহানায়কের জীবনী আশ্রয়ে লিখেছেন- ‘শ্রাবণ ট্রাজেডি’- নিঃসন্দেহে এটি একটি ভালো উদ্যোগ। নাটকের প্রথম শো দেখে খুব একটা মন্তব্য করা ঠিক হবে না। মঞ্চ নাটকটির কারিগরী দিকসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে আলোচনা অন্য কেউ হয়তো করবে, কিন্তু আমার আগ্রহের দিক হলো- নাটকের বিষয়বন্তু। আমরা কি লিখবো, কেনো লিখবো, কি নিয়ে লিখবো-এইটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গত দুই দশকে অনেক লেখা বের হয়েছে- অনেকেই মনে করেন, সে লেখার বেশির ভাগই ব্যক্তি বা গোষ্ঠিকে খুশি করার জন্য, পুরস্কার বাগিয়ে নেওয়ার জন্য অথবা লিখতে হবে, তাই লেখা। গবেষণাধর্মী লেখা খুব কমই হয়েছে। আমরা যদি আমাদের নায়ককে সঠিক ভাবে সাহিত্যমান বজায় রেখে লিখতে না পারি, তাহলে সে লেখা কয়েক বছর পর ইতিহাসের ভাগাড়ে জমা হবে-তখন কিন্তু সেই দায় পাঠক নিবে না।
লেখককে সৎ হতে হয় চিন্তায়, চেতনায় আর ভালোবাসায়। তাহলে গ্রামের অনেক সাধারণ চরিত্রও অসাধারণ হয়ে আসবে লেখকের মাথায়, লেখকের পাতায়, আর রয়ে যাবে ইতিহাসে অমর খাতায়।
লেখক, পরিচালক ও নাট্যকার
(পাঠক কলাম বিভাগে প্রকাশিত মতামত একান্তই পাঠকের, তার জন্য কৃর্তপক্ষ দায়ী নয়)