মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি ও মাঝিরকান্দি ঘাটে চলাচলকারী ৪০০ স্পিডবোটের মধ্যে ২৭৫টিরই নিবন্ধন নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মৌসুম বলে সন্ধ্যার পর পদ্মা নদীতে স্পিডবোট চলাচলে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অথচ রাতেও কিছু স্পিডবোট চলাচল করছে।
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, মাওয়ার শিমুলিয়া ঘাট থেকে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ি এবং শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার মাঝিরকান্দিতে মোট ৪০০ স্পিডবোট চলাচল করে। এর মধ্যে ২৭৫টির নিবন্ধন নেই। বেশির ভাগ স্পিডবোটই ঝুঁকিপূর্ণ। কখনো মাঝনদীতে বন্ধ হয়ে যায়। অনেক স্পিডবোট রয়েছে, যেগুলো ঠিক কোন ডকইয়ার্ডে তৈরি হয়েছে, তা-ও জানা যায় না।
অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগ গত এপ্রিলে সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত স্পিডবোট চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু এক দিনের জন্যও এই নিষেধাজ্ঞা মানা হয়নি। গত সোমবার সন্ধ্যার পরও স্পিডবোট চলেছে। সরেজমিনে দেখা যায়, সন্ধ্যা সাতটার দিকে সাময়িক বন্ধ করা হয়। কিন্তু সাড়ে সাতটার দিকে আবার চালু করা হয়। অন্তত ৫০টি স্পিডবোট চলাচল করে।
শিমুলিয়া লঞ্চঘাটের পাশেই স্পিডবোট ঘাট। সেখানে মাইকে প্রচার করা হচ্ছিল, ‘যাত্রী ভাইয়েরা, স্পিডবোটে যাতায়াত করুন, ১০ মিনিটেই পদ্মা পার। সময় বাঁচান, নিশ্চিন্তে পদ্মা পার হোন।’ আবার কিছু যুবক যাত্রীদের উদ্দেশে বলছিলেন, ‘লঞ্চে গেলে এক ঘণ্টা লাগবে। বোটে জলদি চইলা যান।’
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ৩০টির মতো স্পিডবোট ঘাটে বাঁধা ছিল। সাইনবোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা আছে, বিভিন্ন বোটের অশ্বশক্তি অনুযায়ী যাত্রীধারণের তথ্য। এর মধ্যে ১১৫ অশ্বশক্তির বোটে ২৪ জন এবং সবচেয়ে কম ৪০ অশ্বশক্তির বোটে ১০ জন নেওয়ার কথা। কিন্তু প্রায় সবগুলো বোটে বেশি যাত্রী তোলা হচ্ছে।
স্পিডবোটগুলো কত অশ্বশক্তির? জানতে চাইলে ইজারাদারের লোকজন সঠিক তথ্য দিতে পারেননি। তবে তাঁরা দাবি করেন, সব স্পিডবোটই নিবন্ধিত।
একটি বোটে যাত্রী ভর্তি হলেই ছেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু যাত্রীদের বেশির ভাগই লাইফ জ্যাকেট পরছে না। আবার কাঁঠালবাড়ি ঘাট থেকে যে বোটগুলো আসছে, সেগুলোতেও সব যাত্রীর শরীরে লাইফ জ্যাকেট নেই। জানতে চাইলে ইজারাদারের তত্ত্বাবধায়ক ইলিয়াছ আলী বলেন, যাত্রীদের লাইফ জ্যাকেট দিলে তারা না পরে হয় রোদ ঠেকাতে মাথার ওপর দেয়, অথবা সেটা পেতে বসে।
লঞ্চঘাটে গিয়ে দেখা যায়, কিছু লঞ্চের পেছনে স্পিডবোট। একটি লঞ্চে উঠে দেখা যায়, স্পিডবোট থেকে যাত্রীদের দ্রুত পৌঁছে দেওয়া এবং টাকা কম নেওয়ার প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। কয়েকজন যাত্রী ঝুঁকি নিয়ে স্পিডবোটে নেমেও যাচ্ছে।
সন্ধ্যার পরও এ ধরনের প্রলোভন আসে বলে কয়েকজন সচেতন যাত্রী জানান। নদী পার হয়ে বাসযোগে ফরিদপুরের ভাঙ্গা যাবেন যাত্রী শরাফত আলী। তিনি বলেন, তাড়া থাকায় তিনি নিজেও একবার এভাবে লঞ্চ থেকে নেমে স্পিডবোটে উঠেছিলেন। পথে বোট বন্ধ হয়ে যায়। আর ভাড়া কম নেওয়া হবে বলা হলেও নেওয়া হয়নি। আরেকজন যাত্রী অভিযোগ করেন, সন্ধ্যার পর স্পিডবোটে ভুয়া যাত্রী বসিয়ে রাখা হয়। এতে সাধারণ যাত্রীরা সাহস করে বোটে উঠে যায়। কিন্তু অনেক সময় মাঝনদীতে নিয়ে সাধারণ যাত্রীদের টাকাপয়সা ও মালামাল লুট করা হয়। যাত্রীকে নদীতে ফেলে দেওয়ার কথাও তিনি শুনেছেন বলে অভিযোগ করেন।
স্পিডবোটের ভাড়া ১৩০ টাকা হলেও গত ঈদুল ফিতরে ১৮০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করে কিছু যাত্রী। ঈদুল আজহায়ও বেশি ভাড়া আদায়ের আশঙ্কা করছে তারা।
জানতে চাইলে শিমুলিয়া ঘাটের ইজারাদার ও মেদিনীমণ্ডল (মাওয়া) ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফ হোসেন খান বলেন, বিষয়টি তাঁদের অজান্তে ঘটতে পারে। রাতে তিনি বলেন, সন্ধ্যায় ঘাট বন্ধ করে দিলেও দু-একটা স্পিডবোট চলাচল করতে পারে। তারা কথা শোনে না।
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর সৈয়দ আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘স্পিডবোটগুলোকে নিয়মশৃঙ্খলার আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগে মোটেই নিবন্ধন ছিল না, আমরা স্পিডবোটের মালিকদের কাছে গিয়ে বোটগুলো নিবন্ধনের অনুরোধ করে কিছুসংখ্যক নিবন্ধন করিয়েছি। বাকিগুলোকেও নিবন্ধনের আওতায় আনা হচ্ছে।’
শিমুলিয়া ঘাটের ইজারাদার আশরাফ হোসেন খান বলেন, তাঁরা যত দূর সম্ভব স্পিডবোটগুলো নিবন্ধন করছেন। তিনি বলেন, সব নিয়ম এপারে-ওপারে, কাঁঠালবাড়িতে কোনো বোট নিবন্ধন হয়নি। এ বিষয়ে জানতে কাঁঠালবাড়ি ঘাটের ইজারাদার আবদুল হাই শিকদারের মুঠোফোনে কল দিলে তিনি ধরেননি।