ঢাকা:ব্যালটের বিচিত্র অভিজ্ঞতা এ দেশের মানুষের। কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা কৌক এখনোতু তরতাজা। এই যখন অবস্থা তখন দরজায় কড়া নাড়ছে আগামী সংসদ নির্বাচন। কেমন হবে সে নির্বাচন। শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, এ দেশ সফরে আসা বিদেশি মুরব্বিদেরও কমন প্রশ্ন এটা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নুরুল হুদা অবশ্য তাদের কৌতূহল অনেকটাই মিটিয়ে দিয়েছেন।
তার সাফ কথা, বড় নির্বাচনে অনিয়ম হবে না এমন গ্যারান্টি দেয়া সম্ভব নয়।
বুধবার দেয়া সিইসির বক্তব্য ইতিমধ্যে বিপুল বিতর্ক তৈরি করেছে। পাঁচ সিটি নির্বাচনের পর এমনিতেই তার প্রতি জনগণের একাংশের অনাস্থা তৈরি হয়ে ছিল। এখন খোদ চার সহকর্মীই এক ধরনের অনাস্থা জানালেন সিইসির প্রতি। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম এবং শাহাদাত হোসেন চৌধুরী একযোগে সিইসির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন ঘটনা। অতীতে নানা ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনে বিভক্তি দেখা গেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে তার মীমাংসাও হয়েছে। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কোনো একটি বক্তব্যের সঙ্গে অন্য সব কমিশনারের দ্বিমত পোষণ করা একেবারেই নজিরবিহীন। মাহবুব তালুকদার বলেছেন, এই ধরনের বক্তব্য আগামী জাতীয় নির্বাচনে যারা অনিয়ম করতে চায় তাদের উস্কে দেবে। শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, সংবিধানের আলোকে ভালো নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য আমি শপথ নিয়েছি। আমি সেটাই ধারণ করি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এ প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার বলেছেন, আমাদের দেশের বাস্তবতায় সিইসি হয়ত মনে করেছেন- এটাই সত্যি। কিন্তু তার বক্তব্যে আরো সংযত হওয়া দরকার, একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে মূল দায়িত্বে তিনি আছেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, সিইসি সত্য কথাই বলেছেন। মওদুদ আহমদ সিইসির পদত্যাগও দাবি করেছেন।
এই পরিস্থিতিতে কী করবেন কেএম নূরুল হুদা। তিনি অবশ্য এখনো অনঢ়। অনলাইন সংবাদ মাধ্যম বিডিনিউজকে তিনি বলেছেন, ‘আমি তো বাস্তব কথাটা বলেছি। সত্য কথা বলেছি। যদি কোথাও অনিয়ম হবে না বলি-মিথ্যা বলা হবে; আমি তো মিথ্যা কথা বলি না। এখন এ নিয়ে কেউ কিছু বললে বলতে পারে।’ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, কেএম নূরুল হুদার বক্তব্যে হয়তো বাস্তবতার স্বীকৃতি আছে। কিন্তু তিনি স্পষ্টতই তার সাংবিধানিক দায়িত্ব অস্বীকার করেছেন। ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতিরা একমত হতে পারেন নি। তবে একটি বিষয় তারা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন যে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত। বস্তুত সংবিধানের একটি প্রধানতম কাঠামো রক্ষায় প্রকাশ্যেই অস্বীকৃতি জানালেন নূরুল হুদা। এই পরিস্থিতিতে তার নৈতিকভাবে এই পদে থাকা উচিত হবে না বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এই সময়ে সিইসির এ ধরনের কথা না বলাই উচিত ছিল। এখন কি কারণে তিনি এ ধরনের মন্তব্য করেছেন তা তিনিই ভালো জানেন। আর তার বক্তব্যের বিষয়ে চারজন নির্বাচন কমিশনার দ্বিমত পোষণ করেছেন। এটি তারা করতেই পারেন। তবে, চারজন যেহেতু দ্বিমত পোষণ করেছেন এটি তাদের মেজরিটি মতামত।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান গণমাধ্যমকে বলেন, নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করা ইসির সাংবিধানিক দায়িত্ব। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্বাচন সুষ্ঠু করার কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। সিটি করপোরেশন নির্বাচনগুলোতে গা-ছাড়া ভাব দেখা গেছে। সিইসি যদি মনে করেন, নির্বাচনে অনিয়ম হবে না, এ নিশ্চয়তা দেয়া যাবে না, তাহলে নৈতিকভাবে তাঁর পদে থাকা ঠিক হবে না।
এমনিতে পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে এ দেশের মানুষ। কিছু কৌতুকের কথা আগেই বলা হয়েছে। ফেসবুকে এক সাংবাদিকের লেখা কৌতুক অনেকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে-নতুন এক ভোটার কেন্দ্রে এসে শুনলেন তার ভোট দেয়া হয়ে গেছে। সরল প্রশ্ন তার- প্রথমবার ভোটার, ভোট দিতে আসলাম, এখন আমি কি করবো? ভোটগ্রহণ কর্তা: কি আর করবেন, আসেন আঙুলে একটু কালী মাখায়ে দিই। সিটি নির্বাচনের পর চালু হওয়া এইসব কৌতুকে সিইসিও যোগ দেন। তিনি বলেছিলেন, কিছু অনিয়ম ছাড়া বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। আমরা সন্তুষ্ট।
পাঠকের মৃত্যুর মতো এখানে ব্যালটও বারবার নিহত হয়েছে। যদিও এ রাষ্ট্রের জন্মের নেপথ্যে ব্যালটের ঐতিহাসিক ভূমিকা রয়েছে। ’৭০ এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে নৌকার পক্ষে রায় দিয়ে মূলত ভোটাররাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। প্রয়াত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস বিউকানানের ঐতিহাসিক উক্তিও আমরা স্মরণ করতে পারি- মুক্ত মানুষের মধ্যে বিরোধ নিষ্পত্তির সবচেয়ে উত্তম মাধ্যম ব্যালট। কিন্তু বাংলাদেশে সাম্প্রতিক অতীতে ব্যালট কোনো কিছুতেই কোনো ভূমিকা রাখছে না। এই পরিস্থিতিতে সিইসি হুদার বক্তব্য নতুন করে বিতর্ক উস্কে দিয়েছে। এখন তিনি কী করবেন? গণ-অনাস্থার মুখে পদত্যাগ করবেন? নির্বাচনী অনিয়ম বন্ধে কঠোর হবেন? নাকি অনিয়ম মেনে নিয়ে চেয়ার আঁকড়ে ধরে রাখবেন? বাংলাদেশের ইতিহাস নানা ধরনের সিইসি দেখেছে। কেউ কেউ গায়েবি ভোটের রেকর্ড গড়েছেন। এম এ আজিজের মতো কেউ আবার নির্বাচনের আগেই বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিদায় নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ অবাধ নির্বাচনের জন্য লড়াই করে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। কেএম নূরুল হুদা অবশ্য এরই মধ্যে স্পষ্ট বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছেন।