ঢাকা: রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটির মেয়র ও কাউন্সিলর পদে সংখ্যালঘু প্রার্থী খুব কম। রাজশাহী সিটিতে কোনো পদে সংখ্যালঘু কোনো প্রার্থীই নেই। বরিশালে জনসংখ্যার সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে অংশগ্রহণের হার ১ শতাংশের মতো।
তিন সিটির মধ্যে সিলেটে সাধারণ ওয়ার্ডে সংখ্যালঘু প্রর্থীদের অংশগ্রহণের হার তুলনামূলকভাবে বেশি। তিন সিটিতে অংশ নেওয়া ১৭ জন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে শুধু বরিশালে একজন সংখ্যালঘু প্রার্থী। কাউন্সিলর পদে মোট ৫১২ জন প্রার্থীর মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রার্থী মাত্র ১৭ জন।
সংখ্যালঘু নেতা ও গবেষকেরা বলছেন, রাজনীতি হয়ে উঠছে পেশি ও অর্থনির্ভর। সেখানে পেরে উঠছে না সংখ্যালঘুরা। এই প্রবণতা বদলাতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকেই।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যার মুসলিম শতকরা ৯০ দশমিক ৪ ভাগ, হিন্দু ৮ দশমিক ৫ ভাগ, বৌদ্ধ শূন্য দশমিক ৬ ভাগ, খ্রিষ্টান শূন্য দশমিক ৩ ভাগ ও অন্যান্য শূন্য দশমিক ২ ভাগ। জাতীয়ভাবে সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যার গড় হার ৯ শতাংশের কিছু বেশি হলেও সিলেট ও বরিশালে সংখ্যালঘু জনসংখ্যার হার এর চেয়ে বেশি। আর রাজশাহীতে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা জাতীয় হারের চেয়ে কম।
সিলেট সিটি করপোরেশনে সংখ্যালঘু ভোটের সংখ্যা মোট ভোটের ১৮ শতাংশ বলে জানান সংখ্যালঘুদের সংগঠন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সিলেট মহানগর শাখার সভাপতি মৃত্যুঞ্জয় ধর। তিনি জানান, ওয়ার্ডভিত্তিক ভোটারের তালিকা ধরে তাঁরা এ সংখ্যা পেয়েছেন। এর মধ্যে হিন্দু, খ্রিষ্টান, মণিপুরী আছেন।
সিলেটে মোট ভোটার ৩ লাখ ২১ হাজার ৭৩২। মেয়র প্রার্থীদের মধ্যে সংখ্যালঘু কেউ নেই। ২৭টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১২৬ জন কাউন্সিলর প্রার্থী। এর মধ্যে সংখ্যালঘু প্রার্থী নয়জন। অর্থাৎ,এখানে সংখ্যালঘু ব্যক্তিদের অংশ গ্রহণের হার ৭ শতাংশের কিছু বেশি। নারীদের সংরক্ষিত ১০ ওয়ার্ডে ৫৫ জন প্রার্থী অংশ নিয়েছেন। এর মধ্যে সংখ্যালঘু নারীর সংখ্যা ৫ জন। নারীদের অংশগ্রহণের হার পুরুষের তুলনায় বেশি, ৯ শতাংশ।
মৃত্যুঞ্জয় ধর বলেন, ‘এখানে জনসংখ্যার তুলনায় সংখ্যালঘু প্রার্থী কম হলেও অন্য সিটির চেয়ে অবস্থা ভালো। আমরা সাংগঠনিকভাবে চেষ্টা করেছি সংখ্যালঘুদের অংশ নিতে, উদ্বুদ্ধ করতে। তারপরও বেশি অংশগ্রহণ সম্ভব হয়নি।’
বরিশাল সিটিতে সংখ্যালঘু মানুষের সংখ্যা অনেক আগে থেকে জনসংখ্যার অনুপাতে বেশি ছিল। বিভিন্ন দফায় তাঁদের দেশত্যাগের প্রভাব এ সিটিতেও পড়েছে বলে সিটির একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। বরিশাল সিটিতে মোট ভোটারের ১১ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট। এর মধ্যে সাড় ৯ শতাংশ ভোটার হিন্দু। বাকিটা খ্রিষ্টান। এ তথ্য দিয়েছেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের বরিশাল জেলার সভাপতি মানবেন্দ্র বটব্যাল।
বরিশাল সিটিতে এবারের নির্বাচনে সাধারণ ওয়ার্ডে মোট ৯৪ আর নারী প্রার্থী ৩৫। সাধারণ ৮ নম্বর ওয়ার্ডে সুরঞ্জিত দত্ত লিটুই একমাত্র প্রার্থী। শতাংশের হিসাবে মাত্র ১ দশমিক শূন্য ৬ ভাগ সংখ্যালঘু নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। মোট দুজন সংখ্যালঘু নারী প্রার্থী এবারের নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। দুজনেই ৬ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ড থেকে। এখানে পুরুষের তুলনায় নারীদের অংশগ্রহণের হার বেশি। এখানে নারীদের অংশগ্রহণের হার প্রায় ৬ শতাংশ।
সিটিতে সংখ্যালঘুদের জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে নির্বাচনে অংশগ্রহণ কম কেন? জবাবে বিশিষ্ট সাংবাদিক মানবেন্দ্র বটব্যাল বলেন, ‘স্বাধীনতার পর তৎকালীন পৌরসভায় সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ ছিল। স্থানীয় সরকারের এই প্রতিষ্ঠান রাজনৈতিকীকরণ হয়ে যাওয়ায় সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ কমতে থাকে। রাজনৈতিক দলগুলো চিন্তা করে জেতার বিষয়ে। সংখ্যালঘু প্রার্থীদের তারা প্রার্থী হিসেবে হয়তো জেতার উপযুক্ত মনে করে না।’
তিন সিটির মধ্যে বরিশাল একমাত্র এলাকা, যেখানে সিটির মেয়র পদে একজন সংখ্যালঘু প্রার্থী হয়েছেন। তিনি বাসদ-সমর্থিত প্রার্থী মনীষা চক্রবর্তী। তিনি নিজেকে সংখ্যালঘুদের নয়, গণমানুষের প্রতিনিধি বলতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তবে মনীষা বলেন, নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের কম আসার কারণ এখানে মৌলবাদের বিস্তার ঘটছে। বড় দলগুলো সাম্প্রদায়িকতাকে উসকে দিচ্ছে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে। তারা সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করে না।
উত্তরের জনপদ রাজশাহী সিটিতে ৩০ সাধারণ ওয়ার্ড ও ১০ সাধারণ ওয়ার্ডে একজনও সংখ্যালঘু প্রার্থী নেই। সিটির মোট ভোটার ৩ লাখ ১৮ হাজার ১৩৮। এখানে ৩০টি সাধারণ ওয়ার্ডে মোট প্রার্থী ১৬০ জন। আর নারী কাউন্সিলর প্রার্থীর সংখ্যা ৫২।
রাজশাহী সিটিতে সংখ্যালঘুদের মোট ভোট ২৫ হাজার বলে জানান হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের রাজশাহী জেলা কমিটির সভাপতি অনিল কুমার সরকার। অর্থাৎ, মোট ভোটের প্রায় ৮ শতাংশ ভোটার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের।
অনিল কুমার সরকার বলেন, সিটিতে সংখ্যালঘু প্রার্থী দেওয়ার জন্য শাসক দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও চেষ্টা করা হয়েছিল। তবে যোগ্য প্রার্থীর অভাবে দেওয়া যায়নি। অনিল সরকার মনে করেন, সংখ্যালঘু নেতৃত্ব যে আসছে না, এর কারণ খতিয়ে দেখা দরকার।
তিন সিটিতে সংখ্যালঘুদের কম অংশগ্রহণের প্রবণতাকে ‘শঙ্কাজনক’ বলে মনে করেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজল দেবনাথ। তিনি বলেন, রাজনীতিতে যে দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে, এর একটি বহিঃপ্রকাশ এ চিত্র। শুধু সংখ্যালঘু কেন, একজন সৎ, ত্যাগী মুসলিম প্রার্থীর জন্যও এখন প্রার্থী হওয়া দুষ্কর। সেখানে কিছুটা হলেও প্রান্তিক অবস্থানে থাকা সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ যে কম হবে তাই স্বাভাবিক। কাজল দেবনাথ মনে করেন, রাজনীতিতে সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ বাড়াতে জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ দিতে হবে। এসব প্রতিনিধি নির্বাচনে শুধু সংখ্যালঘু নন, সবাই ভোট দেবেন।
রাজনীতিতে সংখ্যালঘুদের সুষম অংশগ্রহণকে একটি সুস্থ ও গণতান্ত্রিক ধারার পরিচয় বহন করে বলে মনে করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ও সংস্কৃতিকর্মী মলয় ভৌমিক। সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানের ফলেই সংখ্যালঘুদের অংশগ্রহণ কমছে বলে মনে করেন তিনি। মলয় ভৌমিক বলেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাল্টাতে হবে। সাম্প্রদায়িকতা রুখতে হবে। এর বিকল্প নেই।