খেলা: ভেন্যু নিয়ে একটা খটকা লেগেছিল ব্রাজিল সমর্থকদের মনে। আসরে এই কাজান ভেন্যুতেই দর্শকরা বিদায় দেখতে পায় দুই জায়ান্ট দল জার্মানি-আর্জেন্টিনার। বিষয়টি নিজের এক নিবন্ধে মনে করিয়ে দেন ব্রাজিলিয়ান গ্রেট জিকোও। লাতিন ছন্দ বনাম ইউরোপিয়ান গতি। ম্যাচের আগে ব্রাজিল ও বেলজিয়ামের লড়াইকে এমন আখ্যাই দেন ফুটবল বোদ্ধারা। আর শেষ পর্যন্ত বল পায়ে ব্রাজিলিয়ান সাম্বাকে স্তব্ধ করে দিয়ে জয়োৎসব করলো গোল্ডেন জেনারেশনের বেলজিয়ানরা।
গতরাতে কাজান অ্যারেনায় শেষ ষোলো রাউন্ডের খেলায় ব্রাজিলকে ২-১ গোলে হারায় বেলজিয়াম। ব্রাজিলের বিপক্ষে বেলজিয়ামের এটি ৫৫ বছরে প্রথম জয়। ম্যাচে ব্রাজিলের একটি ছিল আত্মঘাতী গোল। অপরটি গোলটি পান ম্যানচেস্টার সিটি তারকা কেভিন ডি ব্রুইনা। ৬১তম মিনিটে এক গোল শোধ দেন রেনাতো অগাস্তো। ম্যাচে ৬০% বল-দখলসহ প্রতিপক্ষ গোলবারে ব্রাজিলিয়ানরা নেয় চলতি আসরের রেকর্ড ২৭টি শট। এর ৯টি ছিল অনটার্গেটে। ম্যাচের যোগ করা সময়ের চতুর্থ মিনিটে নেইমারের দারুণ চিপ বেলজিয়ান গোলরক্ষক থিবো কুরতোয়া শূন্যে ঝাঁপিয়ে আঙুলের টোকায় বার উঁচিয়ে বাইরে পাঠালে বিলীন হয় সেলেসাওদের ম্যাচে ফেরার সম্ভাবনা। ব্রাজিলের বিদায়ে রাশিয়ায় অল-ইউরোপিয়ান সেমিফাইনাল নিশ্চিত হলো। প্রথম কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে হারে তল্পিতল্পা গুটায় অপর লাতিন জায়ান্ট উরুগুয়ে। আগামী ১০ই জুলাই আসরের প্রথম সেমিফাইনালে ফ্রান্সের মুখোমুখি হবে বেলজিয়াম। এই কাজান ভেন্যুতে ‘এফ’ গ্রুপের শেষ ম্যাচে দক্ষিণ কোরিয়ার কাছে পরিষ্কার ২-০ গোলে হার নিয়ে আসর থেকে বিদায় নেয় শিরোপাধারী জার্মানি। আর কাজানের একই মাঠে শেষ ষোল রাউন্ডে ফ্রান্সের কাছে হার দেখে গতবারের অপর ফাইনালিস্ট সুপার স্টার লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা। কাজানে রচিত হলো আরো একটি অভিশপ্ত গল্প।
ব্রাজিলের দায়িত্বে কোচ লিওনার্দো বাচ্চি তিতের পরসিংখ্যানটা ঝলমলে। ২৫ ম্যাচে মাত্র একবার হার দেখেন ব্রাজিল কোচ তিতে। ২০টিতে জয় ও চার ম্যাচ ড্র। আর ২৫ ম্যাচের ১৯টিতে কোনো গোল হজম না করেই মাঠ ছাড়ে তিতে শিষ্যরা। তবে বেলজিয়ানদের এমন রেকর্ডটা এককাঠি উপরে। টানা ২৩ ম্যাচে অপরাজিত থেকে গতরাতে ব্রাজিলের বিপক্ষে মাঠে নামে বেলজিয়ানরা। আর ম্যাচ সদর্পে পা রাখে সেমিফাইনালে। এবারের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালের টিকিট পাওয়া আর কোনো দলের এমন কৃতিত্ব নেই। আর কোচ রবার্তো মার্টিনেজের অধীনে তারা সর্বশেষ হার দেখে সেপ্টেম্বর ২০১৬তে।
কোয়ার্টার ফাইনালে মাঠে নামার আগে ভিন্ন খবরের শিরোনাম হন ব্রাজিলিয়ান সুপার স্টার নেইমার। খেলার মাঠে প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়ের ট্যাকলে চোটপ্রাপ্ত হওয়ার ‘অভিনয়ের’ কারণে নেইমারের সমালোচনায় মুখ খোলেন লোথার ম্যাথিউস, দিয়েগো ম্যারাডোনার মতো ফুটবল গ্রেটরা। যদিও ব্রাজিলিয়ান গ্রেট রোনাল্ডো-রিভালদোরা এতে জানান ভিন্নমত। যদিও চলতি আসরে সর্বাধিক ২৩বার ফাউলের শিকার হওয়া খেলোয়াড় নেইমারই। গতরাতে প্রথমার্ধের শেষ দিকে ও দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে নেইমারের পেনাল্টি দাবি নাকচ করেন ম্যাচের সার্বিয়ান রেফারি মিলোরাদ মাজিচ। তবে হলুদ কার্ড থেকে বেঁচে যান নেইমার। ৫২তম মিনিটে জেসুস প্রতিপক্ষ ডি বক্সে পড়ে গেলে ভিএআর-এর সহায়তা নেন সর্বশেষ ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লীগের ফাইনাল খেলা পরিচালনাকারী রেফারি মাজিচ। তবে ভিএআর জানায় তা ফাউল ছিল না। দ্বিতীয়ার্ধের শুরু থেকেই মুহুর্মুহূ আক্রমণে বেলজিয়ান ডিফেন্সকে ব্যতিব্যস্ত রাখেন সেলেসাওরা। তবে কাজের কাজটি হয়নি। উলটো ৬১তম মিনিটে দ্রুত রচিত এক প্রতি-আক্রমণে বেলজিয়ান অধিনায়ক এডেন হেজার্ড পোস্টের বাইরে মেরে সুযোগ নষ্ট না করলে ব্যবধানটা বাড়তো।
একাদশে দুটি করে পরিবর্তন নিয়ে একাদশ সাজান দু’দলের কোচ। ইনজুরিফেরত মার্সেলোর সঙ্গে একাদশে সুযোগ নেন ম্যাানচেস্টার সিটির ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ফারনানদিনহো। হলুদ কার্ডের খাড়ায় বেলজিয়ামের বিপক্ষে ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়েন কাসেমিরো। শেষ ষোলো রাউন্ডে দেখানো নৈপুণ্যের পুরস্কার পান মারুয়ান ফেলাইনি ও নাসের চাদলি। গতরাতে ব্রাজিলের বিপক্ষে আগুনে ম্যাচে শুরুর একাদশে এ দু’জনকে সুযোগ দেন বেলজিয়ামের স্প্যানিয়ার্ড কোচ রবার্তো মার্টিনেজ। জাপানের বিপক্ষে শেষ ষোলো রাউন্ডের নাটকীয় ম্যাচের শেষ দিকে বদলী খেলতে নেমে গোল আদায় করেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড তারকা ফেলাইনি ও টটেনহ্যাম হটস্পারের সাবেক উইংগার নাসের চাদলি। ম্যাচে ২-০তে পিছিয়ে ম্যাচের শেষ ২১ মিনিটে তিন গোল করেন বেলজিয়ানরা। আর দারুণ এক প্রতি-আক্রমণ থেকে নাসের চাদলি জয়সূচক গোল আদায় করেন শেষ বাঁশির মাত্র ৩১ সেকেন্ড বাকি রেখে। গতরাতে লড়াইয়ে নামার আগে একটি করে হলুদ কার্ড নিয়ে খড়গের নিচে ছিলেন দু’দলের চার শীর্ষ খেলোয়াড় নেইমার, ফিলিপ্পে কুটিনহো, কেভিন ডি ব্রুইনা ও ইয়ান ভার্টোংগেন। বিশ্বকাপের নতুন নিয়মে কোনো খেলোয়াড় কোয়ার্টার ফাইনাল পর্যন্ত দুটি হলুদ কার্ড দেখলে সেমিফাইনালে নিষেধাজ্ঞা পাবেন।
কাজান অ্যারেনায় দু’দল প্রথমবার সুযগো তৈরি করে ম্যাচের অষ্টম মিনিটে। থিয়াগো সিলভার প্রচেষ্টা বেলজিয়ামের গোল বারে প্রতিহত হয়। আর গোলরক্ষক থিবো কুরতোয়ার হাত ঘুরে বল নিয়ে প্রতিআক্রমণে ব্রাজিলের গোলবারের বাইরে শট নেন নাসের চাদলি। দশম মিনিটে গ্যাব্রিয়েল হেসুসের প্রচেষ্টা কর্নারের বিনিময়ে প্রতিহত করে বেলজিয়ানরা। আর কর্নার থেকে পাওয়া দারুণ সুযোগ নষ্ট করে পাউলিনহো। ১৩তম মিনিটে কেভিন ডি ব্রুইনার শট ফারনানদিনহোর পায়ে লেগে বাই লাইনের বাইরে গেলে কর্নার পায় বেলজিয়াম। আর আত্মঘাতী গোল হজম করে বসে ব্রাজিল। কর্নার থেকে উড়ে আসা বল হেডে ক্লিয়ার করতে গিয়ে নিজেদের জালে জড়ান ফারনানদিনহো। চলতি বিশ্বকাপে গোলে নাম ওঠা ১০০তম খেলোয়াড় তিনি।
১৫তম মিনিটে উইলিয়ানের ক্রসে ঝাঁপিে হাত লাগিয়ে বল ডি বক্সে বাইরে পাঠান কুরতোয়া। তবে ফিরতি বলে বল পায়ে কারিকুরি শেষে ছোট ডি বক্সে ঢুকে পড়েন নেইমার। তার কাটবেকে কাছ থেকে গোল করতে ব্যর্থ হন জেসুস। পরে কুটিনহোর দূরপাল্লার শট আশ্রয় নেয় কুরতোয়ার গ্রিপে। তবে ঝটিকা প্রতি-আক্রমণে ব্রাজিলের ডিফেন্সকে ব্যতিব্যস্ত রাখেন বেলজিয়ানরাও। ২০ ও ২১তম মিনিটে ডি ব্রুইনা ও রমেলু লুকাকু সুযোগ তৈরি করলেও রক্ষা পায় ব্রাজিল। ২৬তম মিনিটে দলের আক্রমণেও নিজের উপস্থিতি জানান দেন ইনজুরিফেরত মার্সেলো। ব্রাজিলিয়ান লেফট-ব্যাকের জোরালো দূরপাল্লার শট ডানদিকে ঝাঁপিয়ে প্রতিহত করেন বেলজিয়ান গোলরক্ষক। আর ৩২তম মিনিটে নিজেদের অর্ধ থেকে ভয়ঙ্কর এক প্রতি-আক্রমণে আগুয়ান লুকাকুর পাসে ফের সমর্থকদের উল্লাসে মাতান কেভিন ডি ব্রইনা। ব্রাজিলের জালে জড়ায় ডি বক্সের বাইরে থেকে নেয়া ডি ব্রুইনার কোনাকুনি শট। ৫০তম মিনিটে বল পায়ে কারিকুরি শেষে ছোট ডি বকে দারুণ ক্রস ফেলেন মার্সেলো। কিন্তু জায়গা মতো দেখা যায়নি ব্রাজিলের কোনো খেলোয়াড়কে। ৭৫তম মিনিটে গোল নিয়ে ব্রাজিলের আশা জাগান বদলি খেলোয়াড় রেনাতো অগাস্তো।
আগের চারবারের দেখায় তিন ম্যাচে ব্রাজিল ও একটিতে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে বেলজিয়াম। তবে পাঁচবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে প্রথম সাক্ষাতেই দুর্দান্ত জয় পায় ইউরোপিয়ান ডার্কহর্স বেলজিয়াম। সেটি অবশ্য ৫৫ বছর আগের কথা। ব্রাসেলসে ১৯৬৩ সালের এক প্রীতি ম্যাচে জ্যাক স্টোকম্যানের হ্যাটট্রিকে ব্রাজিলকে ৫-১ গোলে বিধ্বস্ত করে বেলজিয়াম। দুই বছর পর মারাকানায় এর বদলা নেয় হলুদ জার্সিধারীরা। সে ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেন পেলে। এরপর ১৯৮৮ সালে তৃতীয়বার দেখা মেলে দুইদলের। এটিও ছিল প্রীতি ম্যাচ। এবার আর একপেশে খেলা দেখতে হয়নি দর্শকদের। বেলজিয়ামে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচটিতে ২-১ গোলের জয় দেখে দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল জায়ান্টরা। ব্রাজিলের দুইটি গোলই করেন মিডফিল্ডার জিওভানি সিলভা।
বিশ্বকাপে এর আগে একবারই মুখোমুখি হয় ব্রাজিল ও বেলজিয়াম। ২০০২’র আসরে দ্বিতীয় রাউন্ডে রিভালদো ও রোনাল্ডোর গোলে বেলজিয়ামকে ২-০ ব্যবধানে হারায় ব্রাজিল। বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের সেরা সাফল্য ১৯৮৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল। মেক্সিকোয় সেবার সেমিফাইনালে দিয়েগো ম্যারাডোনার জোড়া গোলে আর্জেন্টিনার কাছে ২-০ ব্যবধানে হার দেখে বেলজিয়ানরা।