সেমিনারে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞরা: বাংলাদেশে গণতন্ত্র উল্টোপথে হাঁটছে

Slider বাংলার মুখোমুখি সারাবিশ্ব

122419_Boss

ডেস্ক: বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে দেশটিতে গণতন্ত্র পিছন দিকে হাঁটছে বলে মন্তব্য করেছেন দক্ষিণ এশীয় রাজনীতি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে দেশটির আগামী নির্বাচনে সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। এ লক্ষ্যে নির্বাচনকে প্রতিযোগিতামূলক করে তুলতে সকল দলের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সমান সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। আর এই কাজ বাহির থেকে এসে কেউ করে দিতে পারবে না; দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকেই আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। আগামী নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন না হলে দেশটির গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ দীর্ঘমেয়াদে বাঁধাগ্রস্থ হতে পারে বলে আসা প্রকাশ করেন তারা।

বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় দুপুরে জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোপলি লাউঞ্জ হলে ‘দ্যা গ্লোবাল ডিক্লাইন অফ ডেমোক্রেসি: এ বাংলাদেশ পার্সপেক্টিভ’ বিষয়ক সেমিনারে এমন মতামত ব্যক্ত করেন তারা। নিউইয়র্কভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান ‘আর্চার কে ব্লাড সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি’ আয়োজিত ‘বাংলাদেশ ডেমোক্রেসী কনফারেন্স-২০১৮’ উপলক্ষে ঐ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
সেমিনারে বক্তব্য রাখেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গ্লোবাল ক্রিমিনাল জাস্টিস বিষয়ক প্রাক্তন অ্যাম্বাসাডর স্টিফেন জে র‌্যাপ, প্রখ্যাত থিংকট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের সাউথ এশিয়া সেন্টারের পরিচালক ডঃ ভারত গোপালস্বামী, প্রভাবশালী থিঙ্কট্যাঙ্ক উড্রো উইলসন সেন্টারের সিনিয়র এসোসিয়েটস ও সাউথ এশিয়া বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর মাইকেল কুগেলম্যান, বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয়ের ইন্ডিপেন্ডেন্ট এক্সপার্ট ও বাংলাদেশের নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা বিভাগীয় প্রধান হিদার গোল্ডস্মিথ। সেমিনার সঞ্চালনা করেন জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো ও বিশ্ব ব্যাংকের কনসালটেন্ট ডঃ তামিনা এম. চৌধুরী।
রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র‌্যাপ তাঁর বক্তৃতায় বলেন, শুধু নির্বাচনই একমাত্র গণতান্ত্রিক মানদন্ড নয়। রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী কিনা, এগুলো নিরপেক্ষ ও স্বাধীনভাবে কাজ কাজ করছে কিনা সেটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দেশের বিচার বিভাগ স¤পর্কে তিনি বলেন, ন্যায়বিচারের স্বার্থে বিচার প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হতে হবে। জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের প্রতিবেদন উদ্বৃত করে বাংলাদেশের বিচারবহির্ভুত হত্যা, গুম, খুন ও বিরোধীমত দমনে অত্যধিক শক্তিপ্রয়োগের কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। প্রায় ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে; কিন্তু, নিজ জনগোষ্ঠীর উপর সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি এড়ায়নি।

এটর্নি হিদার গোল্ডস্মিথ বলেন, জনগণের কাছে সরকারের জবাবদিহিতা গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। একটি দেশ গণতান্ত্রিক কিনা দেখতে হলে সেখানে সরকারের জবাবদিহিতা আছে কিনা দেখতে হবে। আর এ সময়ের বাংলাদেশের জন্য এটি আরও বেশী জরুরী। বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্বাধীন নয় বলেও মনে করেন তিনি। বাংলাদেশে নিজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করে, তিনি বলেন, বাধ্য হয়ে সাংবাদিকরা সেলফ-সেন্সরশিপ করছেন। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে মুক্তভাবে মতামত প্রকাশ করলে সাংবাদিকদের শুধু প্রতিষ্ঠান বন্ধ নয়, জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। আদালতকে সরকার মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধেও ব্যবহার করেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
উড্রো উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর মাইকেল কুগ্যালম্যান বলেন, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হওয়া দেশটির রাজনৈতিক স্বার্থেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, প্রথমত, যদি প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে না আসে তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি এমন ধারনাই বেশি যৌক্তিকতা পাবে। এর ফলে সকল রাজনৈতিক দলের জন্যই সামগ্রিক হতাশাজনক পরিবেশ তৈরি হতে পারে। কুগ্যালম্যান বলেন, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ আছে কি না-এ বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণ করতে অনেক ক্ষেত্রে সরকার রাজনৈতিক নিপীড়ন শুরু করে। এতে মানুষের মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদে প্রভাব পড়ে। স্বাভাবিক ভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করতে না পেরে অনেকে চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ে। তাই বাংলাদেশের নিরাপত্তার স্বার্থেই সঠিক নির্বাচন হওয়া জরুরী।
আটলান্টিক কাউন্সিলের সাউথ এশিয়া সেন্টারের পরিচালক ডঃ ভারত গোপালস্বামী বলেন, একটি অবাধ নির্বাচনের জন্য ভয়হীন, মুক্ত পরিবেশ প্রয়োজন। ইকোনমিস্ট এর গবেষণা অনুসারে, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক নয়, বরং একটি হাইব্রিড রেজিম। তিনি বলেন, ঢাকার উপর ওয়াশিংটনের চেয়ে দিল্লীর প্রভাব বেশি। তাই, আঞ্চলিক নিরাপত্তার স্বার্থে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নয়াদিল্লিরও ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। তার মতে, নির্বাচনী প্রক্রিয়া, মৌলিক অধিকার এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ – এই তিন পর্যায়ে সংকট সৃষ্টি হলে সংবিধান বহির্ভূত পরিস্থিতি তৈরি হয়।
অনুষ্ঠান সঞ্চালক ডঃ তামিনা এম চৌধুরী বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সচল থাকাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সামনে সুযোগ এসেছে। নৈতিক অবস্থান থেকে সবাই গণতন্ত্রের পক্ষে থাকতে পারে বলে মত দেন তিনি। এর আগে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন, সেন্টারের ডেমোক্রেসি প্রোগ্রামের পরিচালক আব্দুর রহিম দীপু। অনুষ্টানশেষে স্থানীয় ‘ডেমোক্রেসি টেলিভিশন’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আর্চার কে ব্লাড সেন্টার ফর ডেমোক্রেসীর নির্বাহী পরিচালক কাউসার মুমিন বলেন, গত সপ্তাহেই মার্কিন কগ্রেসের হাউস ফরেন এফেয়ার্স কমিটি বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের অবনতি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার উপর শুনানী করেছেন। এতে অংশ নিয়ে ন্যাশনাল এন্ডোমেন্ড ফর ডেমোক্রেসী, ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট এবং ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট-এর প্রধানগণ একবাক্যে এটাই বলেছেন যে, বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রসার শুধু মার্কিন মূল্যবোধের প্রসারই নয়, বরং গণতন্ত্র প্রসারের ফলে বিশজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ও নিরাপত্তা স্বার্থ নিশ্চিত হয়। কাউসার মুমিন বলেন, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র তাঁর মোট বাজেটের ১ শতাংশ বৈদেশিক সাহায্যের আওতায় ব্যয় করে; যার ৪শতাংশ মাত্র গণতন্ত্র প্রসারে বরাদ্দ হয়। স্বাভাবিকভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থেই এর পরিমান বৃদ্ধি করা উচিত।
এদিকে সেমিনারের প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের ডেপুটি চীফ অফ মিশন মাহবুব হাসান সালেহ বলেন,
সপরিবারে জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার এবং যুদ্ধাপরাধীদর বিচার বাস্তবায়ন করে এবং সর্বোপরি ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয দিয়ে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছে। জাতীয় নির্বাচন পদ্ধতি স¤পর্কে তিনি বলেন, সকল দল ও মতের সঙ্গে আলোচনাপূর্বক সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে কেয়ারটেকার সরকার পদ্বতি বাতিল করা হয়েছে-যা বাংলাদেশের জনগণ মেনে নিয়েছে। বর্তমানে সংবিধানের নির্ধারিত সীমার মধ্যেই আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ সময় দর্শক সারি থেকে চিৎকার করে বলা হয়, তিনি ভুল বলছেন। বাংলাদেশের মানুষ এমনকি শাসকদল আওয়ামীলীগের সমর্থকরাও কেয়ারটেকার সরকার চায়। মাহবুব হাসান সালেহ আরও বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশের সংবিধানের আওতায় একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। এই কমিশনের অধীনে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকটি স্থানীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়েছে -যা বাংলাদেশের মানুষ স্বাগত জানিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *