মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া কিশোরকে জীবনের স্বাদ দিয়েছিলেন রোনালদো

Slider খেলা

092309_bangladesh_pratidin_skysports-cristiano

তিনি উদ্ধত। অহং চুঁইয়ে পড়ে তার জার্সি থেকে! স্বার্থপরতার সংজ্ঞা লেখেন তিনি নিয়মিত।

ইউরোপের সংবাদ মাধ্যমে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ডস স্যান্টোস আভেইরোকে নিয়ে প্রতিদিন যা লেখা হয়, তার নির্যাস- মাঠে বড় ফুটবলার হতে পারেন পর্তুগিজ সুপারস্টার কিন্তু আত্মম্ভরিতা, দর্পে তার সমকক্ষ কেউ নেই। দাম্ভিকতায় ফুটবলকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছেন তিনি।
তবে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ‘গুরু’ ড্যান গ্যাসপার বলেছিলেন, রোনালদোর মতো ভালো মনের মানুষ খুব কমই আছেন! কার্লোস কুইরোজ থেকে লুই ফেলিপে স্কোলারি- ড্যান গ্যাসপারের বায়োডেটায় ঝলমলে সমস্ত নাম। কিংবদন্তিদের সাহচর্যে বছরের পর বছর কেটেছে মার্কিন বংশোদ্ভূত এই পর্তুগিজের। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ফুটবল বিশ্বকাপে পর্তুগাল কোচ কার্লোস কুইরোজের সহকারী ছিলেন ড্যান।

রোনালদোকে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন। তাকেও গুরুর মর্যাদা দিয়েছেন ‘সিআর সেভেন’। সেই স্যারই এবার ছাত্রের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। তিনি জানিয়েছেন, রোনালদো সামাজিক দিক থেকেও অনুপ্রেরণা হতে পারেন।

কীভাবে?
নিজের অতীত খুঁড়ে ড্যান জানালেন ছাত্রের কীর্তি, ‘২০০৬ সালের ঘটনা। আমি তখন হার্টফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কোচ। আমার নিজস্ব অ্যাকাডেমির কর্মী ছিলেন জন মোরেইরা। তার ছেলে ব্রেন্ডন ছিল প্রতিশ্রুতিমান ফুটবলার। ওর হাঁটুতে একটা সমস্যা হয়েছিল। পরে চিকিৎসায় জানা যায়, ফুটবল সংক্রান্ত চোট নয়, হাড়ের মজ্জায় ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্রেন্ডন।

karloes

কার্লোস কুইরোজের (ডান দিকে) সঙ্গে ড্যান গ্যাসপার (বাঁ দিকে)

ড্যান বলেন, ওদের সামনে দুটো রাস্তা খোলা ছিল- হয় পা কেটে বাদ দেওয়া নয়তো কেমোথেরাপি দেওয়া। তবে ফুটবল পাগল কিশোরটি পা হারাতে রাজি না হওয়ায় কেমোথেরাপির পথ বেছে নেওয়া হয়। দুর্ভাগ্যবশত, কেমোথেরাপি ব্যর্থ হয়। শরীরের অন্যান্য অংশেও ছড়িয়ে পড়ে কর্কট রোগের মারণ থাবা। সেই সময়ে টরোন্টোতে বন্ধু জনের কাছে পৌঁছে শুনি মৃত্যুর প্রহর গুণছে বন্ধুর ১৬ বছরের ছেলে।

বছর বারো আগের কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মন খারাপ হয় গ্যাসপারের। তিনি বলতে থাকেন, বেনফিকা, ম্যাঞ্চেস্টারের ভক্ত ব্রেন্ডনের শেষ জীবনের ইচ্ছে ছিল ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে গিয়ে রোনালদোকে অনুশীলন করতে দেখা। তবে ওর শারীরিক কথা বিবেচনা করে অন্য পথ নেওয়া হয়। আমি সরাসরি কার্লোস কুইরোজকে (তৎকালীন পর্তুগালের কোচ) ফোন করি। ওকে সমস্ত পরিস্থিতি জানাই। আসলে রোনালদো তখনই এত বিখ্যাত যে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে-এজেন্ট, আইনজীবী, কোচ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে হত। আমি কুইরোজের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলাম। রোনালদো ব্রেন্ডনের কথা শুনে দেরি করেনি। সরাসরি ফোন করেছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী বালককে। সেই সপ্তাহে চেলসির বিরুদ্ধে যে জার্সি পরে খেলেছিলেন, তা সই করে বুটসহ বন্ধু জনের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন রোনালদো।

প্রিয় তারকার কাছ থেকে টেক্সট, ফোন কল কিংবা উপহার পেয়েও বেশিদিন বাঁচেনি ব্রেন্ডন। তবে শেষের সময়ে মৃত্যুপথযাত্রী বালকের মুখে হাসি দেখে তৃপ্তি পেয়েছিলেন ড্যান। অনুভব করেছিলেন, এভাবেও হৃদয় ছোঁয়া যায় বহু সীমান্ত অতিক্রম করে!

বন্ধু ছেলে হারিয়ে গিয়েছেন কালের অতল গহ্বরে! ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের রোনালদো এখন বার্নাব্যুর একচ্ছত্র সম্রাট! ফুটবল ঈশ্বরের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত। যাই হোক, যুব পর্যায়ে ড্যান গ্যাসপারের কোচিংয়ে খেলা রোনালদোর সঙ্গে পরে পুরনো শিক্ষকের পুনর্মিলন হয় ২০১০-এ বিশ্বকাপের সময়।

গ্যাসপার বলছিলেন, হঠাৎ একদিন কুইরোজের ফোন পাই। উনি আমাকে সহকারী হিসেবে পর্তুগালের বিশ্বকাপগামী স্কোয়াডে চাইছিলেন। বিশ্বকাপের সময়েই রোনালদোকে কাছ থেকে দেখি।

আট বছর আগের সেই কথা মনে করতে গিয়ে এখনও বিহ্বল হয়ে পড়েন ষাটোর্ধ্ব কোচ, নিজেকে শৃঙ্খলার চাদরে মুড়ে রাখে ও। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে ঘুমোতে যাওয়া পর্যন্ত রোনালদো বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়া এক পা-ও চলে না। যেদিন অনুশীলনে প্রত্যেকের ছুটি থাকত, সেদিনও মিস করত না। একা একাই কঠোর অনুশীলনে নিজেকে ডুবিয়ে দিত। নিজেকে নিংড়ে দিত জিমে।

নিজের সতীর্থদের উদ্বুদ্ধ করতে অ্যারিস্টটলের বাণী, আমরা যা করি, তাই প্রতিফলিত হয় আমাদের মধ্যে। শ্রেষ্ঠত্বের অনুশীলন তাই কর্ম নয় আমাদের অভ্যাসে পরিণত হওয়া উচিত। ঝুলিয়ে রাখত প্রত্যেকের রুমে।

তর্কাতীতভাবে তিনি শ্রেষ্ঠ। সর্বকালের সেরা কিনা, তা নিয়ে বিতর্ক প্রতিনিয়ত। ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো থামতে জানেন না। তার জীবনের মন্ত্র, বলছিলেন তার এককালের দ্রোণাচার্য।

কিছুদিন আগেও ড্যানের সঙ্গে টেক্সটে কথা হয়েছে কিংবদন্তির। ড্যান জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘প্রত্যেকদিন ভাল খেলার অনুপ্রেরণা কী?’’ রোনালদো জবাব দিয়েছিলেন, জীবনের প্রতিটি লড়াইয়ে জিততে চাই। পাল্টা বার্তা পাঠান তিনিও, তুমি তো ক্যারিয়ারে সবকিছুই অর্জন করেছো। এখনও কোথা থেকে মোটিভেশন পাও? ছোট জবাব এসেছিল, পৃথিবীর সেরা ফুটবলার হতে চাই। শুধু এই প্রজন্ম নয়, সর্বকালের।

kk rool

প্রিয় ছাত্রের সঙ্গে ড্যান

পর্তুগালের যুব পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় দলে ড্যান সংস্পর্শে এসেছেন আরও দুই চ্যাম্পিয়নের- কার্লোস কুইরোজ ও লুই ফেলিপে স্কোলারি। বিশ্ব ফুটবলের দুই চাণক্যের কথা বলতে গিয়ে তিনি বাঁধনছাড়া, কুইরোজ নিজের জায়গায় কিংবদন্তি। মাঠ ও মাঠের বাইরে খুঁটিনাটি নজরে থাকে। ওর দৃষ্টিভঙ্গী ভীষণ পরিষ্কার। দলে তারকা নয়, একশো শতাংশ যারা দিতে পারবেন, তাদেরই উনি জায়গা দেন।

২০০২ সালে স্কোলারির প্রাক্তন সহকারী এরপরে বলেন, কোচ স্কোলারি আবার অনেকটা ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ক্যারেক্টার। ফুটবলারদের দারুণভাবে উদ্দীপ্ত করেন। দলের মধ্যে খোলামেলা পরিবেশ বজায় রাখেন। প্রতিদ্বন্দ্বী যেই থাকুক না কেন, স্কোলারির পর্তুগাল কাউকে ভয় করতো না।

বর্তমানে ইরানের কোচের দায়িত্বে কার্লোস কুইরোজ। টানা সাত বছর কুইরোজের সঙ্গে ইরানে থাকার পরে পারিবারিক সমস্যায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন গত বছরে। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাড়িতে বসেই দেখছেন রোনালদো, কুইরোজদের বিক্রম! আর মহাতারকা ছাত্র গোল করলেই চিৎকার করে উঠছেন ড্রয়িংরুমে! শিষ্যের সাফল্যের রামধনুতে তিনি নিজেও যে রঙিন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *