আতঙ্কের মধ্যেই ছিলেন শাহজাহান বাচ্চু। গ্রামের আড্ডার সঙ্গীদের প্রায়ই সে কথা বলতেন। ভয়ে রাজধানী ছেড়ে গ্রামে অনেকটা অবসরজীবন কাটাচ্ছিলেন। আড্ডা ও লেখালেখির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল দৈনন্দিন কাজকর্ম।
গত সোমবার সন্ধ্যায় মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার কাকালদি গ্রামে আড্ডা দেওয়ার সময় শাহজাহান বাচ্চুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি মুন্সিগঞ্জ জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সাধারণ সম্পাদক। বিশাকা প্রকাশনী নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা চালাতেন, সেখান থেকে অন্তত ছয় শ কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। ফেসবুকে লিখে তিনি নিজের মতাদর্শও প্রকাশ করতেন।
শাহজাহানের আড্ডার সঙ্গী, স্বজনদের ধারণা, মতাদর্শগত কারণেই তাঁকে হত্যা করেছে প্রতিক্রিয়াশীল কোনো চক্র। পরিবারও সন্দেহ করছে, মৌলবাদী গোষ্ঠীই তাঁকে হত্যা করেছে। আর পুলিশ মনে করছে, এটা জঙ্গিদের কাজ। ময়নাতদন্ত শেষে গতকাল বিকেলে কাকালদি কবরস্থানে শাহজাহান বাচ্চুকে দাফন করা হয়।
শাহজাহানের মেয়ে দূর্বা জামান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাবার সঙ্গে কারও ভূসম্পত্তি, ব্যবসা বা ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ ছিল না। আগে তিনি বিশাকা প্রকাশনীর ব্যবসা চালালেও কয়েক বছর আগে প্রকাশনীটি তাঁকে (দূর্বা) দিয়ে দেন। গ্রামে খুব সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। বাংলাবাজারে তাঁর বিশাকা প্রকাশনীর অফিসের একটি অংশ ভাড়া দিয়ে যে টাকা পেতেন, তা দিয়েই তিনি চলতেন। পঞ্চগড়ে তিনি একটি বাড়ি করেছিলেন। গত বছর সেটিও বিক্রি করে দেন। তাঁর সঙ্গে মতাদর্শ ছাড়া অন্য কোনো কিছু নিয়ে কারও বিরোধ নেই বলে দূর্বা মনে করেন।
শাহজাহান বাচ্চুর গ্রামসম্পর্কের ভাগনে আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রায়ই আড্ডায় তিনি হুমকির কথা বলতেন। সব সময়ই চাপা আতঙ্কে থাকতেন। প্রকাশও করতেন। প্রায়ই হুমকি দিয়ে ফেসবুকে বার্তা আসত। সেগুলো তিনি আড্ডায় পড়ে শোনাতেন। বলতেন, ‘শোনো, আমারে পাইলে ক্যামনে কাটব, কী করব—কত কিছু যে লিখছে।’ তিনি প্রায়ই বলতেন, তিনি জঙ্গিদের হিটলিস্টে রয়েছেন। একই রকম তথ্য দিলেন তাঁর গ্রামসম্পর্কের ভাই মঞ্জুর রহমান।
গ্রামবাসী বলেন, বৈষয়িক বিষয় নিয়ে তিনি তেমন মাথা ঘামাতেন না। আগে মাঝেমধ্যে পঞ্চগড়ে দ্বিতীয় স্ত্রীর গ্রামে গিয়ে থাকতেন। সেখানে তিনি নিজের মতো করে একটি আশ্রম গড়ার চেষ্টা করেছিলেন। পরে আবারও সিরাজদিখানে কাকালদি গ্রামে ফেরেন। পড়াশোনা, আড্ডা, লেখালেখি—এসব নিয়েই থাকতেন। আগে সিরাজদিখান থেকে ঢাকায় গিয়ে প্রকাশনীর ব্যবসা দেখভাল করতেন। ২০১৫ থেকে ভয়ে তা-ও বাদ দেন। নিজের বাড়ি, ইছাপুরা বাজারের জয়ন্ত ঘোষের মিষ্টির দোকান, পূর্ব কাকালদি মোড়ে আনোয়ার হোসেনের ওষুধের দোকান বা এসব বাজারে আরও কিছু দোকানেই সীমিত ছিল তাঁর আনাগোনা।
স্বজন ও গ্রামবাসী বলছেন, সম্প্রতি আনোয়ারের দোকানে আড্ডা দেওয়াও কমিয়ে দিয়েছিলেন শাহজাহান। তিনি থাকলে বেচাবিক্রি কম হয়, দোকানমালিকের এমন অনুযোগের পর আনোয়ারের দোকানে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছিলেন। সোমবার সন্ধ্যায় তিনি নিজেই ফোন করে কাকালদি মোড়ে আনোয়ার হোসেনের ওষুধের দোকানে আড্ডা দিতে যান। এখানেই তিনি হত্যার শিকার হন।
ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ক থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে কাকালদি মোড়। রাস্তার দুই পাশে ২০টির মতো টিন-কাঠ-বাঁশের টংদোকান, যার বেশির ভাগই বন্ধ পড়ে রয়েছে। ওই মোড়ে তিনটি রাস্তা এসে মিলেছে। এখান থেকে মুন্সিগঞ্জ, নিমতলী (মাওয়া মহাসড়ক) ও ইছাপুরার দিকে চলে গেছে পাকা সড়কটি।
যেভাবে ঘটনা
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে আনোয়ারের দোকানে বসে চা পান করেন শাহজাহান বাচ্চু। চা পান শেষে সিগারেট কিনতে পাশের দোকানের সামনে যাওয়ামাত্রই হেলমেট পরা দুই আততায়ী তাঁর বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। এরপর তারা দুটি বোমা ফাটিয়ে দুটি মোটরসাইকেলে করে নিমতলীর দিকে চলে যায়।
কাকালদি মোড়ে প্রতিদিন তরুণদের ক্যারম খেলার আড্ডা বসে। ক্যারম বোর্ড ঘিরে সব সময়ই ২০-২৫ জনের ভিড় থাকে। গত সোমবারও এ রকম ভিড় ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, ক্যারমের আড্ডায় থাকা তরুণদের ভয় দেখাতেই বোমা ফাটায় হামলাকারীরা।
ঘটনাস্থলের পাশের চা-দোকানের মালিক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শাহজাহান আগে প্রায় প্রতিদিনই মোড়ে আসতেন। কিছুদিন ধরে তা কমিয়ে দেন। সোমবার সন্ধ্যার দিকে নিজের দোকানে বসে পরপর দুটি বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনেন নজরুল। এরপর শোনেন হত্যাকাণ্ডের খবর।
প্রতিবেশী মনির হোসেন বলেন, গত সোমবার বেলা তিনটার দিকে তিনি শাহজাহানের বাড়ির লাগোয়া একটি ছোট সেতুর ওপর লাল রঙের মোটরসাইকেল থামিয়ে সুবেশী তিন যুবককে বসে থাকতে দেখেন। মনিরসহ গ্রামবাসী ধারণা করেন, ওই লোকগুলো হয়তো শাহজাহানের গতিবিধি অনুসরণ করছিল।
সন্দেহে জঙ্গিরাই
শাহজাহানের দ্বিতীয় স্ত্রী আফসানা জাহান বলেন, তিনি অনেক দিন ধরেই বিশেষ কিছু করতেন না। সম্প্রতি ‘আমাদের বিক্রমপুর’ নামে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করার চেষ্টা করছিলেন। তিনি যেকোনো সময় হত্যার শিকার হতে পারেন, এমন আশঙ্কার কথা দীর্ঘদিন থেকেই বলতেন। ফেসবুকে লেখালেখির কারণে তিনি প্রায়ই হুমকি পেতেন। তবে কখনো পুলিশের কাছে যাননি। মাঝেমধ্যে ভারতে বন্ধুদের কাছে যেতেন। আফসানা বলেন, মৌলবাদী কোনো গোষ্ঠীই তাঁকে হত্যা করেছে।
মুন্সিগঞ্জের পুলিশ সুপার (এসপি) জায়েদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ফেসবুকের পোস্টগুলো ঘেঁটে দেখা হচ্ছে। তাঁর ব্যক্তিগত কোনো বিরোধের খবর জানা যায়নি। তবে পারিবারিক কিছু বিরোধ রয়েছে। সব কটি বিষয় খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, তাঁর লেখালেখির ধরন বা প্রোফাইল থেকে ধারণা করা যায়, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বা আনসার আল ইসলামের টার্গেট হতে পারেন তিনি। তবে আনসারুল্লাহর জঙ্গিরা সাধারণত হত্যার ক্ষেত্রে ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে। হামলায় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ও ব্যবহৃত হাতে তৈরি গ্রেনেডের (আইইডি) ধরন দেখে মনে হচ্ছে, এটা জেএমবির (পুরোনো) কাজ। পুরো বিষয়টা নিয়ে এখনো ধন্দে রয়েছেন তাঁরা। তারপরও এটাকে জঙ্গিদের কাজ বলেই ভাবছেন তাঁরা।
উদ্বেগ-প্রতিবাদ
শাহজাহান বাচ্চু হত্যার ঘটনায় নিন্দা ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংগঠন। প্রতিবাদে গতকাল মঙ্গলবার ‘বিক্ষুব্ধ মুন্সিগঞ্জবাসী’ ব্যানারে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ হয়েছে।
লন্ডনভিত্তিক লেখক-সম্পাদকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন পেন ইন্টারন্যাশনাল ১১ জুন রাতেই তাদের ওয়েবসাইটে এ হত্যাকাণ্ডে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং ঘটনার তদন্ত ও বিচার চেয়ে বিবৃতি দিয়েছে।
পেন ইন্টারন্যাশনালের রাইটার্স ইন প্রিজন কমিটির চেয়ার সলিল ত্রিপাঠী বিবৃতিতে বলেন, ‘লেখক-প্রকাশকদের জন্য বাংলাদেশ এক ভয়ংকর জায়গা হয়ে উঠছে।’ আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ঘটনার বিচার দাবি করে বলেছে, আগের হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার না হওয়ায় ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের উসকে দেওয়া হচ্ছে।
সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক মো. শাহ আলম এক বিবৃতিতে শাহজাহান বাচ্চু হত্যায় খুনিদের গ্রেপ্তার করে বিচারের দাবি জানান। সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী তাদের অপতৎপরতা থেকে সরে আসেনি উল্লেখ করে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানায়। বাংলাদেশ প্রগতি লেখক সংঘ এ হত্যার বিচার দাবি করেছে।