
কিন্তু যারা লেখক না হয়েও কোনো সময় কোনো বিষয় পাঠকদের জানানোর জন্য লিখতে বাধ্য হন তখন যে কত কষ্ট হয়, তা বলারই অপেক্ষা রাখে না।
২. গত ৫ ডিসেম্বর কযেকটি দৈনিক পত্রিকায় অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটি লেখা ছাপা হয়েছে। তিনি আমাদের শিক্ষা পরিবারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সদস্য, জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী ও দক্ষ যোগ্য শিক্ষক হিসেবে তিনি সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। জনপ্রিয় লেখক। আমরা শিক্ষা পরিবার তার জন্য গৌরবান্বিত ও সম্মানিত। তার লেখাটি পড়ে আমি খুবই আনন্দিত ও উৎসাহিত হয়েছি। তিনি দেশের অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, তা আমাদের মানুষকে বিশেষ করে আমাদের নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করবে এবং আরও আশাবাদী হয়ে কাজ করতে অনুপ্রাণিত করবে। আমি তাকে শ্রদ্ধা ও ধন্যবাদ জানাই।
৩. তিনি যে সকল সমস্যার কথা বলেছেন, সেগুলো আমাদের বিশেষভাবে বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে দেখা জরুরি এবং দ্রুতই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া, ভুল-ত্রুটি শুধরে সঠিক পথে অগ্রসর হওয়া কর্তব্য। যে সকল বিষয় আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে যে কোনোভাবে সম্পর্কিত সেগুলো নিয়ে শীঘ্রই আমার সহকর্মীদের সাথে আলোচনা করবো এবং যথাসময় আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শিক্ষাবিদ ও সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আলোচনা করব। প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণ ও কাজের সাথে অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালসহ আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষাবিদদের সম্পৃক্ত করে আমরা তাদের পরামর্শ নিয় চলি। তারাও হাসিমুখে আমাদের পরামর্শ ও উপদেশ দেন এবং নিজেরাও কাজ করেন। অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি, অন্যান্য নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তব কাজে অসামান্য অবদান রাখেন।
৪. অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তার প্রবন্ধের ৫নং বিষয়ে লিখেছেন- ‘জোট সরকার সরে যাওয়ার পর এই দেশে শিক্ষা ব্যবস্থাটা বেশ ভালোভাবে শুরু হয়েছিল। পাঠ্যবইয়ে মুক্তিযুদ্ধের যে বিষয়গুলো সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেগুলো সঠিকভাবে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। শিক্ষানীতি করা হয়েছিল, সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল – সব মিলিয়ে দেশে শিক্ষা নিয়ে একটা উৎসবের ভাব ছিল। যখনই জরিপ করা হতো দেখা যেতো জনপ্রিয়তার শীর্ষে আমাদের শিক্ষামন্ত্রী। আমি নিজেও পুরো বিষয়টা নিয়ে খুব উৎসাহী ছিলাম।’
এর পরবর্তী প্যারাগ্রাফ বা অনুচ্ছেদে লিখেছেন- ‘তারপর ধীরে ধীরে কোথায় জানি এই গোলমালটা শুরু হয়েছে, আমরা দেখতে পাচ্ছি চোখের সামনে পুরো লেখাপড়ার বিষয়টিতে একটা গোঁজামিল দেওয়া শুরু হয়েছে। শিক্ষানীতিতে নেই তারপরও এই দেশের ছেলেমেয়েদের ওপর জোর করে বাড়তি পাবলিক পরীক্ষা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে জন্য দিনরাত সবার কাছে গালাগালি শুনি, ছোট ছোট শিশুর বাবা-মায়েরা আমাকে অভিশাপ দেন। যদি এটা অনেক সুফল নিয়ে আসত তা হলে কেউ কিছু বলত না, সবাই মেনে নিত। কিন্তু তা ঘটেনি। বাড়তি পরীক্ষার চাপে ছোট শিশুদের জীবনের সব আনন্দ মাটি হয়ে গেছে।
৫. প্রবন্ধে তিনি আরও অনেক বিষয়ে সুন্দরভাবে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখেছেন। শিশুরা স্কুলে আসছে, বিশাল সংখ্যক ছেলেমেয়েরা স্কুলে পড়ছে। ছেলেমেয়ে সমতা অর্জন হয়েছে। তিনি লিখেছেন- ‘আমাদের যে কী বিশাল একটা সম্ভাবনা একেবারে দরজায় কড়া নাড়ছে সেটি কী সবাই জানে?
‘শুধু কি তাই ? আমাদের এই ছাত্র ছাত্রীদের মাঝে ছেলে আর মেয়ের সংখ্যা সমান। লেখাপড়া জানা এই মেয়েরা যখন ছেলেদের পাশাপাশি সব জায়গায় কাজ করবে, সিদ্ধান্ত নেবে, নেতৃত্ব দেবে তখন যে বিপ্লবটুকু ঘটবে সেটা কী কেউ অনুভব করতে পারছে ? আমরা সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে দুশ্চিন্তা করি, জঙ্গি বাহিনী নিয়ে দুর্ভাবনা করি, একটা শিক্ষিত মা কী কখনো তার সন্তানকে নারী বিদ্বেষী, ধর্মান্ধ জঙ্গি দেশদ্রোহী হতে দেবে ? দেবে না। কাজেই দেশের অনেক মানুূষ যখন নানা ধরণের দুশ্চিন্তায় হতাশাগ্রস্থ হয় আমি তখন ফুরফুরে মেজাজে ঘুরে বেড়াই। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার কোনো দুর্ভাবনা নেই।’
৬. মুহম্মদ জাফর ইকবাল লিখেছেন, ‘পাঠ্যবই নিয়ে কথা বলতে হলে আমি সব সময়ই এক জায়গায় এসে খুব আনন্দ পাই, সেটি হচ্ছে বছরের শুরুতে সব ছাত্রছাত্রীর হাতে নতুন বই তুলে দেওয়া। প্রতি বছর যে পরিমান পাঠ্যবই ছাপানো হয়, আমি হিসাব করে দেখেছি সেগুলো একটার পর আরেকটা বসানো হলে পুরো পৃথিবীটা তিনবার পাক খেয়ে আসবে। ছোট ছোট শিশু কিশোররা যখন তাদের নতুন বইগুলো বুকে চেপে ধরে হাসিমুখে বাসায় যায় তার থেকে সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারে না। ’
৭. তাছাড়া তিনি প্রবন্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় – পাঠ্যপুস্তকের মান, পাঠদানের মান, সৃজনশীল পদ্ধতি সঠিকভাবে কার্যকর করতে না পারা, শিক্ষকদের দক্ষতা ও মান, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস, পরীক্ষা গ্রহণ ত্রুটি, বেশি নম্বর দেয়া প্রভৃতি বিষয়ে তার মতামত তুলে ধরে আমাদের ভুল ত্রুটি বিশ্লেষণ করেছেন। ভবিষ্যতের জন্য চমৎকার পাঠ্যপুস্তক তৈরী, দক্ষ শিক্ষক ও উন্নত পাঠদান পদ্ধতির কথা বলেছেন, যে বিষয়গুলো নিয়ে আমরা এখন রাতদিন কাজ করছি -কারণ এখন গুণগত মান বৃদ্ধি আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। তেল-গ্যাস-সমুদ্রসহ আমাদের অনেক সম্পদের কথা জানা আছে। আমাদের নতুন প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রীরা হলো সবচেয়ে সম্ভাবনাময় খাটি সম্পদ। এসব কথা বলে তিনি আমাকেসহ পুরো জাতিকে আশ্বান্বিত করেছেন উজ্জীবিত করেছেন।
৮. তবে প্রথমেই আমি তার লেখার যে অংশের উদ্বৃতি দিয়েছি তাতে তিনি সকল কথাই সঠিকভাবে বলেছেন শুধু -যখনই জরিপ করা হতো দেখা যেত জনপ্রিয়তার শীর্ষে আমাদের শিক্ষামন্ত্রী’ – এই অংশটুকু আমার জন্য বিব্রতকর। শিক্ষাক্ষেত্রে যে সাফল্য তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সমগ্র শিক্ষা পরিবারের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। সকলের সাথে আমি একজন কর্মী হিসেবে কাজ করেছি।
৯. অধ্যাপক জাফর ইকবাল যে সকল ভুলত্রুটির বিষয়ে উল্লেখ করেছেন এবং যে সকল পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছেন-আমরা তা শ্রদ্ধার সাথে বিবেচনা করে আমাদের সাধ্যমত পদক্ষেপ গ্রহণ করব, আমাদের সকল সীমাবদ্ধতার মধ্যেও।
১০. তবে একটি বিষয়ে কিছু ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন, কারন এটাকেই তিনি শিরোনাম করেছেন এবং শেষ করেছেন এই বিষয় দিয়েই। শেষ লাইনগুলো এরকম ‘আমাদের শিক্ষাপদ্ধতির কিছু কিছু ঘোড়া (পিএসসি পরীক্ষা, জেএসসি পরীক্ষা) মরে গেছে, শুধু তাই নয়, মৃতদেহ থেকে রীতিমত দুর্গন্ধ বের হতে শুরু করেছে। এখন যত দ্রুত সম্ভব এগুলোকে কবর দিতে হবে। ’
পঞ্চম শ্রেণী ও অষ্টম শ্রেণীর পর দুটি পরীক্ষা পাবলিক পরীক্ষা হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে, তা চিরস্থায়ী নয়, তা প্রয়োজন না হলে পরিবর্তন করা যায়। এটা কোনো চিরস্থায়ী বিষয় নয়। যে প্রেক্ষাপটে পিএসসি ও জেএসসি পাবলিক পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে সে সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে দু’কথা বলার চেষ্টা করছি। অনেকে বলেন আমরা পরীক্ষা বাড়িয়ে দিয়েছি – তা ঠিক নয়। আমরা পরীক্ষা কমিয়ে দিয়েছি। তবে এই দুই পরীক্ষা জাতীয়ভাবে গ্রহণের পদ্ধতি আমরা চালু করেছি। বছরের শেষে পরের শ্রেণীতে উঠার জন্য বার্ষিক পরীক্ষা সকল শ্রেণীতেই সব সময় বাধ্যতামূলক। কিন্তু পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণী শেষে আমাদের দেশে দুটি পরীক্ষা প্রচলিত ছিল। একটি হলো বৃত্তি পরীক্ষা, আরেকটি হলো বার্ষিক পরীক্ষা। বাছাই করা শিক্ষার্থীরা প্রথম বৃত্তি পরীক্ষা দেয়, পরে সকলে মিলে বার্ষিক পরীক্ষা দেয়, পরবর্তী শ্রেণীতে উঠার জন্য। কোন স্কুল কয়টা বৃত্তি পেল তা দিয়ে স্কুলের সাফল্য, মান বা সুনাম বিবেচনা করা হতো। তাই শিক্ষকরা নিজের স্কুলের সাফল্য বা সুনামের জন্য ২০%-২৫% মেধাবী শিক্ষার্থীকে বাছাই করে আলাদা করে পড়াতেন। বাকী ৮০%-৭৫% এর ছুটি। কিন্তু আমাদের তো সকল শিক্ষার্থীকে ক্লাশ করতে হবে এবং গুরুত্ব দিয়ে পড়াতে হবে। তাই আমরা দুইটি পরীক্ষার পরিবর্তে একটি পরীক্ষা চালু করেছি-যারা সবার চেয়ে বেশি নম্বর পাবে তারা বৃত্তি পাবে। আরেকটি বিষয় হলো আমরা যখন দায়িত্ব নেই তখন ৯% শিশু স্কুলেই ভর্তি হতো না। যারা ভর্তি হতো তাদের ৪৮% পঞ্চম শ্রেণীর আগেই স্কুল ত্যাগ করতো বা ঝরে পড়তো। যারা মাধ্যমিক পর্যায়ে যেতো তাদের মধ্যে নবম শ্রেণীর আগেই ৪২% ঝরে পড়তো। তা হলে অনুমান করেন মোট শিশুর ক্ষুদ্র একটি অংশ মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত টিকতে পারতো। দশম শ্রেণীর পূর্বে তাদের কোনো জাতীয় স্বীকৃত সার্টিফিকেট ছিল না। তাই তৃতীয়, পঞ্চম, সপ্তম বা নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়া সবই তাদের কাছে সমান বা স্বীকৃতিহীন।
তাছাড়া সকল শিশু স্কুলে আনার জন্য আমরা বিনামূল্যে বছরের প্রথম দিন পাঠ্যপুস্তক দিচ্ছি, ৪০% দরিদ্র শিশুদের উপবৃত্তি দিচ্ছি, এরকম স্কুলে শিশুদের স্কুলে আসা এবং অভিভাবকের স্কুলে পাঠানো উৎসাহিত করার জন্য আমাদের নানা কার্য্যক্রমের মধ্যে এই পরীক্ষাকেও আমরা আকর্ষনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার জন্য জাতীয় পরীক্ষায় রূপান্তরিত করলাম। এতে একটি সার্টিফিকেট পাওয়ার আশায় পঞ্চম শ্রেণী বা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত টিকে থাকার একটা আকর্ষণ সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়া এই সকল পর্যায়ে পরীক্ষা দিয়ে শিশুরা আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে। জাতীয়ভাবে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতে একটি সমমান অর্জনের প্রক্রিয়া শুরু হবে, গ্রামে-শহরে বিরাজমান বিরাট পার্থক্য কমে আসবে।
বড় শহরের উচ্চ বিত্তদের সন্তানদের হয় তো এরকম পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমাদের গ্রাম-হাওড়-বাওড়, পাহাড়, নদী ভাঙ্গণ-চরাঞ্চল, পশ্চাদপদ অঞ্চলের শিশুদের জন্য পরীক্ষা দু’টি উৎসব। সন্তানরা পাবলিক পরীক্ষা দিচ্ছে এজন্য তাদের পিতা-মাতার জন্য গৌরব হিসেবে তারা উৎসাহিত। এক সময় হয় তো এ পরীক্ষা প্রয়োজন হবে না – কিন্তু স্কুলে আসতে, টিকে থাকতে, একটি সমমান অর্জনে এবং সর্বোপরি শিশুদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে যদি এই পরীক্ষা সাহায্য করে তা হলে পরীক্ষাগুলোর যে সকল সমস্যা বা ত্রুটি আছে তা দূর করে এগিয়ে যেতে পারি। কারণ পরীক্ষার্থী ও তাদের পিতা-মাতা আমাদের কাছে তাদের আনন্দ প্রকাশ করেন।
১১. তারপরও যেহেতু এরকম একজন ব্যক্তিত্ব এই পরীক্ষা দুটোকে ‘মৃত পচা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে’ বলে আখ্যায়িত করেছেন, তখন আমরা নিশ্চয়ই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও শিক্ষাবিদদের দিয়ে তদন্ত করে এ সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করে করণীয় নির্ধারণ করব।
অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালকে শিক্ষার ক্ষেত্রে ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে, সমালোচনা, সুপারিশ ও পরামর্শ দেয়ার জন্য এবং প্রশংসা করার জন্য ধন্যবাদ।