আমার গুরু প্রয়াত সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী একটি বিশেষ সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, ঈষান কোণে কাল মেঘ। আজকে আমি যুক্ত করলাম আকাশে গ্রীষ্ম-বসন্তের সংঘর্ষ। আজকে আমার শিরোনামের পুরো বাক্যটি হল ঈশান কোণে কাল মেঘ, আকাশে গ্রীষ্ম-বসন্তের সংঘর্ষ।
সাম্প্রতিক সময়ে প্রকৃতি আকস্মিকভাবে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। অসময়ে প্রকৃতির এই ধরণের বুহমুখি আচরণ, আমাদেরকে আতঙ্কে ফেলে দেয়। প্রকৃতির এই ধরণের বে-খেয়ালী বিমূর্তপনা প্রকৃতির রীতিকে আক্রমন করে ভেঙে ফেলতে চায়।
জানালায় বৃষ্টির ছটা
হৃদয়ের কপাট খোলা,
তুমি আমি বসি মখোমুখি
কিছু কথা যায়না বলা।
এটা কবিতা। কবিতার ভাষা সরল সহজ হলেও অর্থ বুঝা কঠিন। আমি বুঝিনা বলেই মনে হয়।
সম্পাদকীয় কোন রিপোর্ট নয়। সামারী করে আবেদন করা হয় বা দাবী করা হয়। দাবীটি যার বা যাদের কাছে তারাই পূরণ করতে পারেন। আবার নাও পারেন। তবুও বলা হয়, এটাই সম্পাদকদের কাজ।
সাম্প্রতিক সময়ের বাংলাদেশ নিয়ে আমরা যেমন ব্যাস্ত, বিশ্ববাসীও তেমনি ব্যাস্ত। কারণ আমরা নিজেরা মিলে মিশে থাকতে না পারার কারণে সকলের কাছেই মাথা ব্যাথার কারণ। ফলে যে কোন অশান্তি যে কোন সময় আসতে পারে এমন আশংকায় আছি আমরা।
আমরা জানি, ১৯৯০ সালে সকল রাজনৈতিক দল মিলে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হয়। তৎকালীন সেনা শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পদত্যাগ করায় নির্বাচনকালীন অস্থায়ী সরকার নির্বাচন করেন। ক্ষমতায় আসা বিএনপি ক্ষমতা নিজেদের দখলে রেখে ৪৮ আসনে ভোট ছাড়া নির্বাচিত হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সহ বেশ কিছু দল আন্দোলন করে বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে নামায়। আর শুরু হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যাত্রা। ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন হয়। ২০০৬ সালে বিএনপি নিজেদের লোক দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করায় আওয়ামীলীগ আন্দোলন করে। দুই দলের আন্দোলনের কারণে ২০০৭-২০০৮ সালে আসে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার। বন্দি হয় দুই প্রধান নেত্রী। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ওই সরকার একটি নির্বাচন দেয় এবং আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী আওয়ামীলীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে নিজেদের সরকার দিয়ে একটি নির্বাচন দেয় আর ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহন না করে আন্দোলন করে। ওই আন্দোলনে মানুষ ও দেশ জ্বলে উঠে। ওই নির্বাচনে ১৫৪ আসনে বিনাপ্রতিদ্বন্ধিতায় পাশ করে আওয়ামীলীগ।
চলতি বছর আরেকটি নির্বাচন হবে। বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার বলছে, তাদের অধীন নির্বাচন করতে হবে সকল দলকে। বিএনপি বলছে, তারা নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া নির্বাচনে আসবে না। অবশ্য এরই মধ্যে বিএনপির প্রধান কারাগারে চলে গেছেন। ফলে বিএনপি দলীয় প্রধানের মুক্তি ছাড়া নির্বাচনে আসবে না বলে বলছে।
এদিকে আওয়ামীলীগ জনগনের ভোট ছাড়া ক্ষমতায় থাকার কারণে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। একটি সরকার দুটি জিনিসের উপর নির্ভর করে। রাষ্ট্রের মালিক জনগন ও রাষ্ট্রের কর্মচারীর উপর। জনগনের ভোট না থাকায় বর্তমান সরকার কর্মচারী নির্ভর হয়ে গেছে সঙ্গত কারণে। আর নিজেদের একমাত্র ভরসা মনে করে কর্মচারীরা নিজেদের খেয়াল-খুশিমত কাজ করছে।
যে কর্মচারী জনগনের সেবা করার কথা, সে কর্মচারী জনগনকে হত্যা করছে। যে কর্মচারী জনগনের নিরাপত্তা দেয়ার কথা, সে কর্মচারী জনগনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে। যে কর্মচারী অপরাধী ধরার কথা, সে কর্মচারী নিজেরাই অপরাধ করছে। যে কর্মচারী বর্তমান প্রজন্মকে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস ও মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর বর্বরতার লোমহর্ষক স্মৃতি জানানোর কথা, সে কর্মচারী হানাদার বাহিনীর মত আচরণ করে ফেলেছে। মানে হল. সরকার জনগনকে পাশ কাটিয়ে চলার কারণে কর্মচারীরা বেসামাল হয়ে গেছেন। পরিস্থিতি এমন যে, মালিকের হাত পা বেঁধে পাহারাদার এমন মধ্যযুগীয় নির্যাতন করছেন যে, মনে হয় কর্মচারীই মালিক হয়ে গেছেন বা যাচ্ছেন।
রাষ্ট্রের মালিক জনগন আর কর্মচারীরা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের মালিককে সেবা করবে। এই ক্ষেত্রে সরকার হল মডারেটর। রাষ্ট্রের মালিক মডারেটর বানাবে। খারাপ কাজ করলে মডারেটর পরিবর্তন করবে মালিক। আর মডারেটর কর্মচারীদের পরিচালনা করবে যেন, রাষ্ট্রের মালিক জনগনের আর রাষ্ট্রের সেবায় ত্রুটি না হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য হল, মডারেটর, রাষ্ট্রের মালিককে অপ্রয়োজনীয় করে ফেলায় মডারেটর কর্মচারী নির্ভর হয়ে গেছে সঙ্গত কারণে। আর কর্মচারীরা একমাত্র ভরসা হওয়ার উল্লাসে পড়ে মডারেটরের কথাও মানছে না, তেমন ভাবে।
সর্বশেষ পরিস্থিতি এমন যে, কর্মচারীরা রাষ্ট্রের মালিকের সঙ্গে এমন আচরণ করছেন যে, মনে হয় রাষ্ট্রের মালিক কর্মচারীদের কাছে ভয়ঙ্কর অপরাধী। তাই কর্মচারীরা ভয়ঙ্কর অপরাধী হিসেবে রাষ্ট্রের মালিককে এমনভাবে নির্যাতন ও নিপীড়ন করছেন যে, কর্মচারীরা দেশের সকল অপরাধীদের অপরাধকে পরাজিত করে ফেলছে।
সুতরাং দেশ এখন প্রতিনিয়তই দুদুল্যমান। কারণ মানবতা, মানবিকতা ও মৌলিক অধিকার ভুলন্ঠিত হওয়ায় সৃষ্ট সুয়োগ সুবিধাবাদীরা নিতে পারে এমন আশংকা বর্তমান। কারণ আমাদের দেশ জন্মের ৪৬ বছর পার করলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গনতান্ত্রিক মডারেটর দ্বারা পরিচালিত হয়েছে অনেক কম সময়। আমরা বিপদে পড়েছি বেশী সময়। সুখে থেকেছি কম সময়। তাই সব সময় আমরা অজানা আতঙ্কে থাকি। ফলে যে টুকু সুখ পাই তাও দুঃখে আর আতঙ্কে ঘেরা হয়ে থাকে।
বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ও ক্ষমতায় যেতে, বর্তমানে যে লড়াই হচ্ছে, সে লড়াই আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাবে তার ঠিকানা নেই। কারণ ঈশান কোণে কাল মেঘ দেখা যায়। আর এই সময়েই বছরের প্রথম ও শেষ ঋতু আকাশে( গ্রীষ্ম-বসন্তের সংঘর্ষ) নানা সময় সংঘর্ষ করে রঙধনুকেও আঁড়াল করে রাখে। এরপরও আমরা আশাবাদী, মেঘ কেটে গিয়ে একটি জলমল সূর্য্য উঠবেই।
ড. এ কে এম রিপন আনসারী
এডিটর ইনচীফ
গ্রামবাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম