আসলে কামাল এসেছিলেন আমার অফিসে অন্য একটি কাজে। তখন আমি এটিএন বাংলায়। কাওরান বাজারের ওয়াসা ভবনের দোতলায় অফিস। কামাল আমার হাত দেখে নানা মন্তব্য করছেন। আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে সব শুনছি। সেই সময়ে টেলিফোন করেছিলেন উপমন্ত্রী বন্ধুটি। আমি তাকে আমন্ত্রণ জানালাম। তিনি সোনারগাঁও হোটেলে ছিলেন। ছুটে এলেন ১০ মিনিটের মধ্যে। আমি পরিচয় করিয়ে দিলাম জ্যোতিষের সঙ্গে। তারপর তার হাত নিয়ে গবেষণায় নামলেন জ্যোতিষ কামাল। কিছুক্ষণ পরই ঘোষণা দিলেন মন্ত্রী জেলে যাবেন। হাতে সময়ও বেশি নেই। বিএনপি ক্ষমতা ছাড়লেই জেল। এটাই নিয়তি। মেঘনাদবধ কাব্যে মাইকেল মধুসূধন লিখেছিলেন- রাবণের পরিণতি নিয়তি নির্ধারিত। আমরা সবাই নিয়তির দাস।
জ্যোতিষের কথায় পরিস্থিতি জটিল রূপ নেয়। আমি পরিস্থিতি হালকা করার চেষ্টা করলাম। বললাম, ভাবী ছাড়া অন্য নারীর দিকে মন্ত্রী তাকাবে কিনা সেটা বলুন। প্রেম, ভালোবাসা, কীয়া, পরকীয়া সম্পর্কে জানতে চাই। জ্যোতিষ কাগজ-কলম নিলেন। অাঁকাজোকা করলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, বিপদ অনেক আছে। রোমান্টিক পুরুষ। কিন্তু বাড়ির কর্ত্রীর কথা চিন্তা করে বেশিদূর যাবেন না। ঘরের মানুষ ঘরে ফিরবেন। হেমামালিনীরা আটকে রাখতে পারবেন না।
সবকিছু সামলে নেবেন। বিপদের কিছু নেই। বিপদ অন্যখানে। বিপদ হলো জেলে যেতেই হবে। শনি ও রাহুর যোগসূত্র কঠিন। গ্রহ-নক্ষত্রের জটিলতা চারদিকে। মঙ্গল আর বৃহস্পতি আছে আর এক বছর। তারপর শনির শুরু। জেল-জীবন একাধিকবারও হতে পারে। জ্যোতিষের কথাবার্তায় বিব্রতকর পরিস্থিতি। এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে অফিস থেকে বের হলাম মন্ত্রীর সঙ্গে। ফের সোনারগাঁও হোটেলের সুইমিং পুল সাইডে। স্বর্ণকেশিরা সাঁতার কাটছে। আমরা গভীর নীরবতায় জেল নিয়ে চিন্তা করছি।
হঠাৎ উপমন্ত্রী বললেন, ভাই আমার ধারণা এই জ্যোতিষ ব্যাটা আওয়ামী লীগ করে। তার অনুমান-ক্ষমতা নিয়ে কথা বলছে। আমি সক্রিয় মন্ত্রী। সরকারে সোচ্চার বলেই আমাকে ঘাবড়ে দেওয়ার জন্য এত কথা। আমি বললাম, হতে পারে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি জ্যোতিষ শাস্ত্র বিশ্বাস করি না। আপনার চিন্তারও কিছু নেই। বিজ্ঞান প্রযুক্তির এই যুগে রাশিফল চলে না। তবে একসময় রাজা-বাদশারা জ্যোতিষের পরামর্শ নিয়ে যুদ্ধবিগ্রহে যেতেন। এই যুগে ওসব চলে না।
রাজা-বাদশারা নেই, সেই জ্যোতিষ বিদ্যারও বিদায় ঘটে। আমার কথায় আশ্বস্ত হলেন উপমন্ত্রী। বললেন, ভাই জানি, আপনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে অনেক দিন সম্পৃক্ত। তবু বলি, বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসবে। আওয়ামী লীগ আর ঠাঁই পাবে না। পরিস্থিতি বদলে যাবে কিছুদিন পর। পরিস্থিতি বদলে গিয়েছিল ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে। রাজনৈতিক সংকট গভীর রূপ নিয়েছিল। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের দিন দুপুুরের পর সেই উপমন্ত্রীকে ফোন করেছিলাম। বললাম, কি বুঝছেন? তিনি বললেন, ভাইয়া বলেছে সব ঠিক হয়ে যাবে। বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসবে। জবাবে বললাম, আমার কথা শুনুন, এখনই সরে পড়ুন। রাতে বাড়ি থাকবেন না। সন্ধ্যায় জরুরি অবস্থা জারি হচ্ছে। বিএনপির বন্ধুটি আমার কথায় খুশি হলেন না। সন্ধ্যায় জরুরি অবস্থা জারির পর জামালপুরের নুর মোহাম্মদকে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছি আমি। ফোন করছি বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাকে। এ সময় সেই বন্ধুর ফোন। বললেন, ভাই চিন্তার কিছু নেই। বিএনপিই আসবে। আওয়ামী লীগ সাইজ হবে। জরুরি অবস্থা যাবে বিএনপির পক্ষে। কথা বাড়ালাম না। তর্কে তর্ক বাড়ে। নীরবতায় শান্তি।
এ ঘটনার দুই মাস পরের কথা। আমার রাজনীতিক বন্ধুরা পালিয়ে আছেন। সেই উপমন্ত্রী বন্ধুও বাদ নেই। এক রাতে ফোন করলেন। বললেন, ভাই একটু সামনাসামনি কথা বলতে চাই। পরের দিন আমরা বসলাম। আমি বললাম, জ্যোতিষ তো ঠিকই বলেছেন। ক্ষমতা ছাড়ার দুই মাস পরই আপনাকে জেলে যেতে হচ্ছে। এখন সামনে দুই পথ। এক, জেলে যাওয়া। আরেক পালিয়ে বিদেশ যাওয়া। কোনটা করবেন। উপমন্ত্রী বন্ধু বললেন, জ্যোতিষের কথাই শুনব। রাজনীতি করি। পালাব না। জেলেই যাব। কাল আদালতে আত্মসমর্পণ করব। যথারীতি তিনি আত্মসমর্পণ করলেন। প্রথমে গেলেন ঢাকা জেলে; পরে কাশিমপুর। খাটলেন অনেক দিন। মোটামুটি দুই বছর। ছাড়া পান আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগ মুহূর্তে। কিন্তু আবার জেলে গেলেন বছর তিনেক আগে। খাটলেন বছর খানেক।
প্রিয় পাঠক, আমার এই লেখা পড়ে ভুল বুঝবেন না। আমি মোটেও জ্যোতিষ শাস্ত্রে বিশ্বাসী নই। মাঝে মাঝে হাত দেখিয়ে মজা পেতাম। ছোটবেলা থেকে হাত দেখতেন আমার মেজো বোনের স্বামী এনামুল হক। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর হিসাব বিভাগের অডিটর। হঠাৎ করে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন গ্রামের বাড়ি গিয়ে। আমার হাত দেখানোতে ভাটা পড়ল। তিনিই ছিলেন আমার জ্যোতিষ। আমিও তার একমাত্র মক্কেল। বোনের স্বামীর মৃত্যুর পর হঠাৎ করেই কামালকে আবিষ্কার। কামাল খুব ভালো হাত দেখতেন। ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্বাস কর্মে। ধর্মে বলা আছে, মানুষ নিজের ভাগ্য নিজেই বদল করবেন। সৃষ্টিকর্তা সহায়তা করবেন। এখানে জ্যোতিষের কেরামতির কিছু নেই। মন্ত্রীর জেল কাহিনী শোনানোর কারণ অন্য। ক্ষমতায় থাকাকালে কেউ বাস্তবতায় থাকে না। মনে করে এই ক্ষমতা চিরস্থায়ী। কোনো দিন ছাড়তে হবে না। সব চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। কিন্তু বাস্তবতা কঠিন। আবদুল লতিফ সিদ্দিকীও তা আবার প্রমাণ করলেন। আজকের মন্ত্রী, কালকের কারাবন্দী। ক্ষমতার আরেক পাশে কারাগার। তাই ক্ষমতা নিয়ে দম্ভের কিছু নেই।
শুধু লতিফ সিদ্দিকী নন, গত পাঁচ বছরের দাপুটে অনেক মন্ত্রী এখন নিজ দল ও সরকারের কাছে বিব্রতকর বস্তু। ক্ষমতার মায়াজাল থেকে অনেক দূরে। শেখ হাসিনার দল ও সরকারে কঠোর অবস্থানের প্রশংসা করতে হয়। তবে তা ধরে রাখতে হবে। কোনো বাড়াবাড়িকে আস্কারা দেওয়া যাবে না। কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুইর একটি ঘটনা মনে পড়ল। অনেক দিন ধরে রাজার মন-মেজাজ ভালো না। অর্থমন্ত্রী ফ্যুকের আচরণ ভালো ঠেকছিল না। অহংকার নিয়ে চলতেন। দাম্ভিক ছিলেন পুরোপুরি। এই দাম্ভিকতার কারণ খুঁজলেন রাজা। শুনলেন পুকুরচুরি চলছে রাজকোষে। রাজপ্রাসাদগুলোর নির্মাণ নিয়ে নানা অনিয়মের পাহাড় জমেছে। গোপনে সবকিছুর তদন্ত শুরু করলেন রাজা। গোপন রিপোর্ট চলে যায় অর্থমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। অর্থমন্ত্রী ফ্যুকেকে বাদ দিলেন। শুধু তাই নয়, তিন সপ্তাহ বাদে আটকও করলেন। নতুন অর্থমন্ত্রী নিয়োগ দেন রাজা চতুর্দশ লুই। যুগে যুগে মন্ত্রীদের জবাবদিহিতার বিকল্প নেই। সরকারে থেকে দুর্নীতি-অনিয়মে জড়ালেই জেলে পাঠানো জরুরি। তাতে রাজার সুনাম কমে না। বাড়ে। কিন্তু অতি সম্প্রতি কিছু মন্ত্রীর অতি কথনে প্রশ্ন উঠছে। অকারণে সৈয়দ আশরাফ আক্রমণ করলেন যুক্তরাষ্ট্রকে। কথা বেশি বলছেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রী সৈয়দ মহসিন আলী। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম কেন এত কথা বললেন আমার কাছে বোধগম্য নয়। মন্ত্রী ও নেতাদের অতি কথনে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন জাগছে। অনেক কিছু রহস্যময় বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলা উপন্যাসের মতো। কপালকুণ্ডলায় অনন্ত সমুদ্রের জনহীন তীরে এক রমণী নবকুমারকে বলেছিলেন ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছো?’ এই কণ্ঠস্বরে নবকুমারের হৃদয়বীণা বাজিয়া উঠিল। কিন্তু সরকারের হৃদয়বীণা কেন জাগছে না বুঝতে পারছি না। তবে কি স্থিতিশীল অবস্থা সরকারের নিজেরই ভালো লাগছে না! জগত-সংসার আসলে বোঝা মুশকিল। শান্তি সুস্থিতি মানুষের ভালো লাগে না। নবকুমারের কানে ‘পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছো’ ঠিকই প্রবেশ করেছিল। কিন্তু কি অর্থে কি উত্তর করতে হবে নবকুমারের কিছুই মনে হলো না। এই খামখেয়ালিপনায় রমণী কোনো উত্তর না পেয়ে কহিলেন ‘আইস’। সঞ্চলিত শুভ্র মেঘেরন্যায় ধীরে ধীরে রমণী চলে গেলেন। সরকার বাস্তবতায় না থাকলে জনগণ এক সময় বলে ওঠে ‘আইস’। তাই পথ হারালে চলবে না। পথ চলতে হবে সাবধানতায়। কারণ সিদ্ধান্তহীন পরিস্থিতি মানবজীবনে দুর্ভোগ বয়ে আনে। বিএনপি ভাবতেও পারেনি ক্ষমতার পারদ-বল তাদের কাছ থেকে সটকে পড়বে। বিএনপির ভুল সিদ্ধান্তেই তাদের এখন সর্বনাশা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ২৯ ডিসেম্বর সারা দেশের নেতা-কর্মীদের ঢাকায় আনা ছিল বিএনপির ভুল সিদ্ধান্ত। এরপর আন্দোলন বন্ধ করা নিয়ে খোদ বিএনপিতেই চলছে এজেন্ট বিতর্ক। দলে কে সরকারের এজেন্ট তা তারা বুঝতে পারছে না। বিএনপি এখনো আশা করছে, বিদেশিরা এসে আগামী মার্চের মধ্যে একটা নির্বাচন করে দেবে। কিন্তু বিএনপির সেই বিশ্বাসে আওয়ামী লীগ কেন সাড়া দেবে? বিশ্বাস ও আস্থার ন্যূনতম সম্পর্ক দুই দলের মধ্যে নেই। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়ছে।
এক সুন্দরী রমণীকে তার স্বামী সন্দেহ করতেন। এই সন্দেহের কারণ ছিল। স্বামী সবসময় স্ত্রীকে সতর্ক করতেন, খবরদার ওমুকের দিকে ভুলেও তাকাবে না। স্ত্রী বলত, কেন? স্বামীর জবাব ছিল, তাতে আমার কষ্ট বাড়বে। নিজেকে ছোট মনে হবে। তোমাকেও ছোট মনে হবে। আমাদের সম্পর্কের অবনতি হবে। সন্দেহ, অবিশ্বাস থেকে সংসার ভাঙবে। স্ত্রী স্বামীকে কথা দিলেন তিনি ওসব করবেন না। কিছুদিন পর দেখা গেল মাঝরাতে ফুলবাগিচায় পরপরুষের সঙ্গে কথা বলছেন স্ত্রী। বাড়ির বিশ্বস্ত দাসী এ নিয়ে প্রশ্ন তুলল। জানতে চাইল, নিষিদ্ধ মানুষের সঙ্গে মধ্যরাতে কীসের কথা। স্যারকে কথা দেওয়ার বিষয়টিও দাসী স্মরণ করিয়ে দেন। সুন্দরী নারীর জবাব, তুমি বুঝবে না দাসী নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। নিষেধ করেছে বলেই কথা বলছি। আর তোমার স্যার থাকে কর্মব্যস্ততায়। আমার খোঁজ নেওয়ার সময় নেই। সবসময় খারাপ ব্যবহার করেন। কষ্ট দেন। বন্ধুটি ভালো ব্যবহার করে আমাকে মুগ্ধ রাখেন। আমি বন্ধুর সঙ্গে মধ্যরাতে শুধুই কথা বলি। অন্য কিছু তো করি না। ঠকাচ্ছি না সাহেবকে। দাসী বললেন, একদিন যদি স্যার সব জানেন, আপনি মাঝরাতে বাগানে বসে শুধুই কথা বলেন, তিনি বিশ্বাস করবেন না। সন্দেহের অনলে জ্বলবেন। সে আগুনের অাঁচ আপনাকেও পোড়াবে।
আসলে ভালোবাসার একটা কষ্ট থাকে। আর দুঃখবোধ মানুষকে বদলে দেয়। সম্পর্কের ভিতরে সন্দেহের জাল একবার প্রবেশ করলে তার স্বাভাবিকতা থাকে না। মানুষের মনের ভিতরে দুটি ধারা থাকে। একটা সচেতন, আরেকটি অবচেতন। অনেক সময় অবচেতন মন বাস্তবতাকে তছনছ করে দেয়। মানুষ নিজের অজান্তেই সেই তছনছকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়। সহজ বিষয়কে কঠিন করে তোলে। কি রাজনীতি, কি সমাজনীতি, কি ব্যক্তিগত জীবন সবখানে একই চিত্র। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে সন্দেহের জাল বাসা বেঁধেছে। কেউ কাউকে বিশ্বাস করছে না। রাজনীতিকদের অবচেতন মন সহজ রাজনৈতিক অঙ্ককে অস্বাভাবিক বানিয়ে ছাড়ছে। দুটি দলকে সন্দেহ, অবিশ্বাসের আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করছে। এখানে নতুন করে সংলাপ হলে, আলোচনা হলে এই অবিশ্বাসের দোলা কি দূর হবে?