ঢাকাঃ আধ্যাত্মিক শূন্যতা, খ্রিস্ট ধর্মের বিকৃতি, নৈতিক অধপতন ও সামাজিক নানা সংকটে পীড়িত পাশ্চাত্যের নাগরিকদের অনেকেই পবিত্র ধর্ম ইসলামের নানা সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে গ্রহণ করছেন এই মহান ধর্ম। ফরাসি নারী জেনেতও এই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে অন্যতম।
মহান আল্লাহর সঙ্গে মুসলমানদের আন্তরিক ও সহজ-সরল সম্পর্ক এই নারীকে অভিভূত করেছে। আর মূলত এ বিষয়টি জেনেতকে প্রাথমিকভাবে আকৃষ্ট করেছিল ইসলামের দিকে।
জেনেত এ প্রসঙ্গে বলেছেন:
‘আমি জন্ম নিয়েছিলাম এক খ্রিস্টান পরিবারে। খুব শৈশবেই প্রভু বা আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে ভালবাসতাম এবং অনুভব করতাম যে স্রস্টাকে খুব ভালবাসি। যখন বড় হলাম তথা যৌবনে উপনীত হলাম তখন এই বাস্তবতা বুঝতে পারলাম যে পশ্চিমা সমাজে স্রস্টাকে খুব কমই অনুভব করা যায়। পাশ্চাত্যের এই পরিবেশ আমাকে পীড়া দিত। সমাজে খুব কম মানুষকেই দেখতাম যে স্রস্টার স্মরণ তাদের জীবনে গতিশীল রয়েছে।
সব সময় আমি এমন সত্যের সন্ধান করতাম যা আমার ভেতরকার খোদা-প্রেমের চেতনাকে পরিতৃপ্ত করে আমাকে প্রশান্তি দেবে। সে সত্যকে খুঁজতে গিয়ে অবশেষে আমি পরিচিত হলাম ইসলামের সঙ্গে। ইসলাম ও মহানবী (সা.) সম্পর্কে একটি বই পড়ে আমি গভীরভাবে প্রভাবিত হই। এ বই ঘুরিয়ে দেয় আমার জীবনের গতিপথ। আমি এমনভাবে বদলে গেলাম যেন আমার নব-জন্ম হয়েছে। ইসলামের প্রতি বিশ্বাস বা ঈমানই ছিল এর কারণ।’
ইসলাম মানুষের পারলৌকিক জীবন ছাড়াও পার্থিব জীবনের সব দিকের জন্য বিধান দিয়েছে এবং বাতলে দিয়েছে পার্থিব সব সমস্যা সমাধানের উপায়। আর এ বিষয়টিও ইসলামের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। ইসলাম ইহকালীন ও পরকালীন উভয় বিষয়ের ওপরই গুরুত্ব দেয়। যেমন, ইসলাম এটা বলে না যে আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্য বিয়ে বর্জন করতে হবে ও বস্তুগত চাহিদাগুলোকে অগ্রাহ্য করতে হবে।
সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক মর্যাদার অধিকারী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) নিজেও বিয়ে করেছিলেন এবং অন্যদেরও বিয়ে করার উতসাহ দিয়েছেন। আর বিশ্বনবী (সা.)’র জীবনের সব দিকই মানুষের জন্য শ্রেষ্ঠ আদর্শ। তাঁর জীবনের নানা দিক ও বিশেষ করে, জুলুম, বৈষম্য আর কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ফরাসি নওমুসলিম নারী জেনেতকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন:
‘ইসলামের নবীর বক্তব্য ও আচার-আচরণ আমাকে প্রভাবিত করেছে। মহানবী (সা.) বলেছেন: ‘হে মানুষেরা, মহান আল্লাহ বংশীয় আভিজাত্যের অহমিকা ও অজ্ঞতা ধ্বংস করেছেন। সব মানুষই আদমের বংশধর। অনারবের ওপর আরবের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। কেবল তাকওয়া বা খোদাভীতিই হল শ্রেষ্ঠত্বের মাণদণ্ড।’- আমার মতে এই বক্তব্য ভৌগলিক, সাংস্কৃতিক ও জাতিগত পার্থক্যের সীমানাগুলো গুড়িয়ে দিয়েছে। ফলে সবাই ইসলামকে একান্তই আপন বলে অনুভব করে এবং তারা সহজেই এ ধর্মের শিক্ষাগুলোর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারছেন।
বিশ্বনবী (সা.) বাস্তবেও গড়ে তুলেছিলেন বৈষম্যমুক্ত এমন এক সমাজ যেখানে ছিল না সাদা-কালোর তফাত কিংবা ধনী-দরিদ্রের পার্থক্য। সেখানে সাবেক দাস রোমের সুহাইব (রা.), আবিসিনিয়ার কৃষ্ণাঙ্গ বেলাল (রা.) ও ইরানের সালামান (রা.) ছিলেন অন্যদের মতই মর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক। এটা আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় বলে মনে হয়েছে। আর এ জন্যই ইসলাম খুব দ্রুত অন্যান্য জাতিগুলোর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ, জাতিগুলো এ ধর্মের মধ্যে এটা দেখতে পেয়েছে যে এই মহান ধর্মের চিন্তা-আদর্শ কখনও কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, পেশা ও জাতীয়তাকে অগ্রাহ্য করে না বা সেসবকে ছোট বলে মনে করে না।”
ইসলাম জাতিগত অহমিকাকে অস্বীকার করে বলে জাতিগত পরিচয়কে অস্বীকার করে না। কারণ, মহান আল্লাহই মানুষকে নানা জাতি, ভাষা ও বর্ণের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু ইসলামের শিক্ষাগুলো বিশেষ কোনো জাতি বা গোত্রের জন্য সীমিত নয়। মুসলমানরা নানা জাতি, বর্ণ ও ভাষাভাষী হলেও তারা চিন্তাগত বা আদর্শিক ঐক্যের কারণে পরস্পর ভাই ভাই।
পবিত্র কুরআনও ইসলামের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। এ প্রসঙ্গে ফরাসি নওমুসলিম জেনেত বলেছেন: ‘আমি ইসলামের মাধ্যমে স্রস্টা সম্পর্কে গভীরভাবে জানতে পেরেছি। কুরআন অধ্যয়ন আমাকে এক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে সহায়তা করেছে। এ মহাগ্রন্থের কোনো কোনো আয়াতে আকাশমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টির প্রক্রিয়া সম্পর্কে বক্তব্য রয়েছে।
এইসব আয়াত পাঠের সময় আমি আল্লাহর নৈকট্য অনুভব করি ও আল্লাহ সম্পর্কে বেশি চিন্তাভাবনা করি। আমি যখন থেকে মুসলমান হয়েছি ও কুরআন পাঠ করছি তখন থেকে জীবনে আল্লাহর উপস্থিতি আগের চেয়েও বেশি অনুভব করছি। ইসলাম সম্পর্কে যতই পড়াশুনা করছি ততই বিশ্ব জগতের স্রস্টা হিসেবে আল্লাহকে উপলব্ধি করছি ও ততই আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ এবং আন্তরিক হয়ে উঠছে।”
জেনেত মুসলমান হওয়ার পর নিজের নাম হিসেবে মারিয়াম নামটি বেছে নিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন:
আল্লাহ আমাদেরকে এই পৃথিবীতে যেসব সুযোগ দিয়েছেন সেইসব সুযোগকে ভালোভাবে কাজে লাগানো উচিত। মুসলমানরা যদি ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী জীবন-যাপন করেন তাহলে মানুষ আরো বেশি এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হবে বলে আমি নিশ্চিত। যেমনটি আমরা ইউরোপ ও আমেরিকায় দেখতে পাচ্ছি, সেখানে প্রতিদিন মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে। বিশ্বে বিস্তার ঘটছে ইসলামের। আমাদের উচিত ভবিষ্যতের প্রতি আশাবাদী হওয়া।”
ইরানের ইসলামী বিপ্লবও প্রভাবিত করেছে ফরাসি নও-মুসলিম মারিয়াম ওরফে জেনেতকে। তিনি বলেছেন, “সারা বিশ্বের মুসলমানরা জেগে উঠেছে। অন্য কথায় ইসলাম আবারও জীবন্ত হয়েছে। আর এ জন্যই অতীতে মনোবিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা ধর্মের প্রতি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করা সত্ত্বেও ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর অনেকেই ইসলাম সম্পর্কে আবারও গবেষণা শুরু করেছেন। কারণ, তারা দেখছেন যে ইরানের ইসলামী বিপ্লবের ভিত্তি ও শেকড়ই হল ধর্ম। ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ী হওয়ায় অনেকেই এই মহান ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন।