ঢাকা: দেশব্যাপী চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে ২৩ দিনে নিহত হয়েছে ৮৪ জন। সর্বশেষ গতকাল ১০ জেলায় নিহত হয়েছে আরো ১২ মাদক ব্যবসায়ী। অপরদিকে নিহতের সঙ্গে বাড়ছে গ্রেপ্তারের সংখ্যাও। গত ২৩ দিনে র্যাব, পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে অন্তত ৫ হাজার মাদক বিক্রেতা ও সেবনকারী। প্রথম ৯ দিনে র্যাবের হতেই গ্রেপ্তার হয়েছিল ১ হাজার ৪১৫ জন। গতকাল রাজধানীর জেনেভা ক্যাম্প থেকে ৪৫০ জনের আটকের পর ১৫৩ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
এছাড়া অন্তত কয়েকশ মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীকে বিভিন্ন মেয়াদে করাদণ্ড দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে মোবাইল কোর্ট।
এই অভিযানের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চলবে। দেশে মাদক নিয়ন্ত্রণের প্রধান সংস্থা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. জামাল উদ্দীন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, এই অভিযান হলো তরুণ সমাজকে বাঁচানোর জন্য মাদকের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান। মাদকসেবীদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম আছে। কিন্তু মাদক ব্যবসায়ীদেরকে তো সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম নেই। উপায়ও নেই। তাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান চলবে। মাদক ব্যবসায়ীরাই র্যাব-পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করলে আত্মরক্ষা ও প্রতিরোধ গড়ার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পরে গুলি করতে বাধ্য হচ্ছে। তাতেই মাদক ব্যবসায়ীরা গুলিবিদ্ধ হচ্ছে। কারও কারও মৃত্যু হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আত্মরক্ষার অধিকার তো আইনে দেয়া আছে। আইন মেনেই তারা অভিযান পরিচালনা করছেন। সম্প্রতি নিহতদের সবাই মাদক ব্যবসায়ী বলে দাবি করেন তিনি।
৪ঠা মে থেকে দেশব্যাপী মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ক্রাশ প্রোগ্রাম শুরু করে র্যাব। অভিযানে নামে পুলিশও। বিভিন্ন জেলায় দিনে ও রাতে ব্যাপক মাদকবিরোধী অভিযান শুরু করে। পাশাপাশি যুগপৎ অভিযান শুরু বা জোরদার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, বিজিবি ও কোস্টগার্ড। এদিকে গতকাল ৯ জেলায় র্যাব ও পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ১৩ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
কুমিল্লায় নিহত ২: কুমিল্লায় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বাবুল ও আলমাস নামের ২ মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশের ৪ সদস্য আহত হয়েছেন। শুক্রবার রাত দেড়টার দিকে জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বাগরা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত বাবুল ১৬ মামলার আসামি ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার আশাবাড়ী গ্রামের আবদুল মালেকের ছেলে এবং আলমাস ৮ মামলার আসামি ও একই উপজেলার দক্ষিণ তেতাভূমি গ্রামের আফাজ উদ্দিনের ছেলে।
ব্রাহ্মণপাড়া থানার ওসি শাহজাহান কবির জানান, শুক্রবার রাত দেড়টার দিকে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী বাগরা নামক এলাকায় অভিযানের সময় পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মাদক ব্যবসায়ী বাবুল (৪০) ও আলমাস (৩৬) তাদের সহযোগীদের নিয়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণসহ ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এসময় পুলিশও আত্মরক্ষার্থে ১৬ রাউণ্ড পাল্টা গুলি চালায়। উভয়পক্ষের গুলি বিনিময়ের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত মাদক ব্যবসায়ী বাবুল ও আলমাসকে উদ্ধার করে কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় পুলিশের ৪ সদস্য আহত হন। ঘটনাস্থল থেকে ৪০ কেজি গাঁজা ও একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে।
ঈশ্বরগঞ্জে মাদক ব্যবসায়ী নিহত: ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে এক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে মাদক সহ গুলির খোসা ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করেছে পুলিশ। এ সময় বন্দুক যুদ্ধে আহত হয়েছেন ঈশ্বরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহ তিন পুলিশ। শুক্রবার মধ্যরাতে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠারবাড়ী ইউনিয়নের রায়ের বাজার তেলোয়ারী এলাকার গণ্ডি মোড়ের পশ্চিমে ফাঁকা রাস্তায় কতিপয় মাদক বিক্রেতা মাদক ভাগাভাগি করছিল। এমন সংবাদ পেয়ে ঈশ্বরগঞ্জ থানার ওসি বদরুল আলম, ময়মনসিংহ ডিবি’র ওসি ও আঠারবাড়ী তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশের সমন্বয়ে যৌথ অভিযান চালানো হয়। রাত ১টা ৩০ মিনিটের সময় ওই এলাকা ঘিরে ফেলে পুলিশ। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মাদক বিক্রেতারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপসহ এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। ডিবির ওসি ও ঈশ্বরগঞ্জ থানার ওসির নির্দেশে যৌথটিম আত্মরক্ষার জন্যে পাল্টা গুলি ছোড়ে। গোলাগুলির একপর্যায়ে মাদক বিক্রেতারা পিছু হটলে এলাকাটিতে পুলিশি তল্লাশি শুরু করে। ওই সময় এলাকার শীর্ষ মাদক বিক্রেতা শাহজাহান (৩১) কে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্যে দ্রুত ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার শাহজাহানকে মৃত ঘোষণা করেন।
বরগুনায় নিহত ১: বরগুনা সদর উপজেলার ৪ নং কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের জাকিরতবক এলাকায় বন্দুকযুদ্ধে মো. ছগির খান নামে এক মাদক বিক্রেতা নিহত হয়েছে। গতকাল সকাল সাড়ে ৭টার দিকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত ছগির খান বরগুনা সদর উপজেলার ১ নং বদরখালী ইউনিয়নের কুমড়াখালী এলাকার বাসিন্দা।
ঠাকুরগাঁওয়ে ১ : ঠাকুরগাঁওয়ে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মোবারক হোসেন কুট্টি (৪৪) নামে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। নিহত মোবারক সদর উপজেলার ছিট চিলারং গ্রামের মৃত শফির উদ্দিনের ছেলে। শনিবার ভোররাতে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার পশ্চিম বেগুনবাড়ী গ্রামে পুলিশের মাদকবিরোধী অভিযানে এই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশ ১শ’ পিস ইয়াবা উদ্ধার করে বলে দাবি সদর থানার ওসি আবদুল লতিফ মিয়ার।
কচুয়ায় ১: কচুয়ায় মাদক ব্যবসায়ী পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে ৫ মাদক মামলার আসামি নিহত হয়েছে। ২ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার ১০নং আশ্রাফপুর ইউনিয়নের বনরা গ্রামে শুক্রবার দিবাগত রাত ৩ টার দিকে। নিহত মাদক ব্যবসায়ীর নাম বাবলু (৩৫)। নিহত বাবলু ওই গ্রামের সুলতান মিয়ার ছেলে। তার বিরুদ্ধে কচুয়া থানায় ৫টি মাদক মামলা রয়েছে।
পাবনায় ১: পাবনা সদর উপজেলার মহেন্দ্রপুরে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে। তার নাম আবদুর রহমান (৪৫)। শুক্রবার দিবাগত রাত দু’টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তি সদর উপজেলার দোগাছী ইউনিয়নের কবিরপুর গ্রামের মৃত আছের উদ্দিন শেখের ছেলে। তিনি পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী বলে দাবি পুলিশের।
পাঁচবিবিতে র্যাব-এর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ, মাদকব্যবসায়ী নিহত: শুক্রবার রাত ১২টার দিকে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার ভিমপুর ইটেরভাটা এলাকায় র্যাব’র সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মো. রেন্টু মিয়া (৪০) নামের এক মাদক বিক্রেতা নিহত হয়েছেন। তিনি উত্তরগোপালপুর গ্রামের আবদুুল জলিলের পুত্র।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-৫ জয়পুরহাট ক্যাম্প কমান্ডার শামীম হোসেন জানান, মাদকের একটি বড় চালান কেনাবেচা হচ্ছে- এমন খবর পেয়ে র্যাবের একটি দল রাতে ভিমপুর এলাকায় যায়। টের পেয়ে মাদক বিক্রেতারা র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ সময় র্যাবও পাল্টা গুলি ছুড়লে ওই মাদক বিক্রেতা গুলিবিদ্ধ হয় এবং অন্যরা পালিয়ে যায়। র্যাব ঘটনাস্থল থেকে ফেনসিডিল, একনলা বন্দুক ও দুই রাউন্ড গুলি উদ্ধার করেছে। পরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রেন্টুকে পাঁচবিবি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
দিনাজপুরে ২ মাদক ব্যবসায়ী: দিনাজপুরে র্যাব-এর সঙ্গে এবং মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পৃথক পৃথক বন্দুকযুদ্ধে ২ জন শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছে।
এ সময় আহত হয়েছে র্যাব’র দু’সদস্য। উদ্ধার করা হয়েছে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য, বিদেশি আগ্নোয়স্ত্রসহ, গোলাবারুদসহ দেশীয় অস্ত্র।
দিনাজপুরের বীরগঞ্জে র্যাব’র সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী’র নাম ডলার সাবদারুল (৪৭)। তিনি বীরগঞ্জ উপজেলার পলাশবাড়ী ইউনিয়নের নন্দাইগাঁও গ্রামের মৃত মজিবর রহমানের ছেলে।
কুড়িগ্রামে মাদক ব্যবসায়ীর মৃত্যু: কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলার দক্ষিণ বাঁশজানি সীমান্তে শনিবার ভোরে পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ইব্রাহিম হোসেন (৩৭) নামে এক মাদক চোরাকারবারী নিহত হয়েছেন। তিনি ওই এলাকার নাওডোর উত্তরপাড়া গ্রামের মৃত: ইউসুফ ওরফে ইনসাফের পুত্র। পুলিশ এ সময় ৫ কেজি গাঁজা, দেশীয় অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধার করেছে বলে জানায়। এ সময় এএসআই নাদের ও আইয়ুব নামে দুই পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে বলে জানা গেছে।
মাদকবিরোধী অভিযান চাই, হত্যাকাণ্ড নয়
– কাজী রিয়াজুল হক
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (জামাকন) চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেছেন, মাদকের নেশা মরণ নেশা। তা যুব সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। মধ্যবয়সী এবং বৃদ্ধরাও তা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। আমরা মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চাই। কিন্তু হত্যাকাণ্ড নয়। পুলিশ ও র্যাবের মতো সুশৃঙ্খল বাহিনী নিয়মতান্ত্রিকভাবে আইনের মধ্য দিয়ে অভিযান পরিচালনায় সক্ষম। তাদের অভিযানে হত্যাকাণ্ড ঘটলে তা কাম্য নয়। গ্রহণযোগ্যও নয়। এতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়।
গতকাল শনিবার মানবজমিনকে তিনি এসব কথা বলেন। রাষ্ট্রায়ত্ত মানবাধিকার সংগঠনটির এই প্রধান আরো বলেন, মাদক ব্যবসায়ী বা যে ধরনের অপরাধীই হোক না কেন, তাদেরকে ধরে বিচারের আওতায় আনতে হবে। আদালতে সোপর্দ করতে হবে। এটাই হালো র্যাব-পুলিশের দায়িত্ব। কিন্তু আমরা প্রায় সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে শুনছি অভিযানে অপরাধী তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়লে তারা আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরোধ গড়তে গিয়ে পাল্টা গুলি ছোড়ছে। তাতে অপরাধীরা মারা যাচ্ছে। কিন্তু এসব কথা তো গ্রহণযোগ্য নয়। হলি আর্টিজান অভিযানে আমাদের সেনা সদস্যরাও আহত হয়েছিলেন। সেখানে জঙ্গিরা আত্মাহুতি দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে হামলা চালিয়েছিল। তাদের জীবনের মায়া ছিল না। তাই তাতে অভিযান পরিচালনাকারীদেরও আর কোনো উপায় ছিল না। ওই অভিযান তো সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। কিন্তু এখন মাদক ব্যবসায়ীদের তো জীবনের মায়া আছে। তারা তো বাঁচতে চায়। এখানে অভিযানে তাদের মৃত্যু হবে কেন? তাই এসব বন্দুকযুদ্ধে নিহতের গ্রহণযোগ্যতা নেই। তাদেরকে ধরে আইনের হাতে সোপর্দ করে বিচার করতে হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কাম্য নয়।