আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। আমি বাবাবে ফেরত চাই। অন্যদের মতো বাবার হাত ধরে আমিও হাঁটতে চাই। বাবার সাথে ঈদ করতে চাই। আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন, নাহলে আমাদেরও নিয়ে নিন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাবার সন্ধান চাইছে নিখোঁজ ড্রাইভার কাওসারের শিশু কন্যা লামিয়া আক্তার মীম। শুধু বাবা হারানো ছোট্ট মীমই নয় কেউ সন্তান হারিয়ে, কেউবা স্বামী হারিয়ে, কেউ কেউ ভাই হারিয়ে স্বজন হারিয়ে তাদের ফিরে পেতে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে নিখোঁজ হওয়া-গুম হওয়া স্বজনের ছবি বুকে নিয়ে। তাদের একটাই দাবি, ঈদের আগে তাদের সন্তানদের মায়ের কোলে ফিরে পাওয়া।
শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে আন্তর্জাতিক গম সপ্তাহ উপলক্ষে মায়ের ডাক এর উদ্যোগে ঈদ উলফিতরের আগে গুম পরিবারের সদস্যদের মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে এ দাবি জানান তারা। এ সময় নিখোঁজ ও গুম হওয়া ব্যক্তিদের ব্যপারে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি জানান মানবাধিকার কর্মীরা।
গুম হওয়া সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন মারুফা ইসলাম ফেরদৌসির সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন। গুম হওয়া পরিবারের মধ্যে বক্তব্য দেন সাইফুল রহমান সজিবের বাবা শফিকুর রহমান, গুম আব্দুল কাদের মাসুমের মা আয়েশা আলী, তরিকুল ইসলাম তারার স্ত্রী শামসুন্নাহার বেবী, মো. নুর আলমের স্ত্রী রিনা আলম, মাহবুব রহমান সুজনের ভাই জাহিদ খান, কাজী ফরহাদের ভাই আমান, ছাত্রলীগ রামপুরা থানার সভাপতি এস.এম মোয়াজ্জেম হোসেন তপুর মা আলহাজ¦ সালেহা বেগম, মাহবুবুর রহমান রিপনের ভাই মোস্তাফিজুর রহমান শিপন, আমিনুল ইসলাম জাকিরের ভাই আলমগীর হোসেন আলিক, আদনান চৌধুরীর মা কানিজ ফাতেমা-সহ প্রমুখ। উপস্থিত ছিলেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালা সহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ।
এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন গুম পরিবারের পিন্টুর ভাই মোঃ ইসলাম রেজা, গুম আসাদুজ্জামান রানা, গুম জাহিদুল করিম তানভীর, গুম আলামীনের পরিবারের সদস্যরা।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, ৭/৮ বছর ধরে কারও ছেলে, কারও ভাই কারওবা স্বামী নিখোঁজ রয়েছে। কারও বছর খানেক ধরে স্বজন নিখোঁজ রয়েছে। আজও তাদের হদিস মেলেনি। এদের একটাই দাবি, তাদের সন্তানদের ফিরিয়ে দেয়া হোক। প্রশ্ন উঠেছে কারা তাদের সন্তানদের নিয়ে গেছে? বিষয়টি খুবই স্পষ্ট কারা নিয়ে গেছে। যে অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, বাসা থেকে যাদের নেয়া হয়েছে প্রত্যেকের বক্তব্যে এটি স্পষ্ট আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে অথবা তাদের পোশাক পড়ে এসে বাসা থেকে উঠিয়ে নেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, কুমিল্লার সুবেদার মেজর মতিন। যিনি বঙ্গবন্ধুর গার্ড রেজিমেন্টর এজজন সদস্য ছিলেন। তার কাছ থেকে তার সন্তানকে র্যাব নিয়ে গেছে। সেটা উনি প্রকাশ্যে বলেছেন কিন্তু এখন পর্যন্ত তার ছেলে ফিরে আসেনি। শাহিন বাগের ৭জন সন্তানকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিয়ে গিয়েছে। কাউকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তারা পালিয়ে ছিলেন সেখান থেকে। কাউকে বাসা থেকে। তাদের অভিযোগ, বিরোধী রাজনীতির সাথে জড়িত। তার মধ্যে একজন প্রাইভেটকার চালকও ছিলেন। যেভাবে যে পদ্ধতীতে নারায়ণগঞ্জের ৭জনকে উঠিয়ে নিয়েছিলো ঠিক একই পদ্ধতীতে এদেরও নেয়া হয়েছে কিন্তু আজ পর্যন্ত ওই ৭ সন্তান ফিরে আসেনি। সরকারের পক্ষ থেকেও স্পষ্ট কোনো বক্তব্যে দেয়া হয়নি।
আমরা স্পষ্ট করে একটা কথা বলতে চাই। যা হয়েছে যথেষ্ট হয়েছে। এখন নিখোঁজ ও গুম হওয়াদের কি অবস্থা সেটা জানার জন্য একটা কমিশন গঠন করা হোক। যে কমিশন তদন্ত করে দেখবে এই যে লোকগুলো দীর্ঘ দিন ধরে নিখোঁজ বা গুমের শিকার হয়েছে তাদের অবস্থা কি। কি ঘটেছে তাদের জীবনে সেটা জানান চেষ্টা করবেন এবং যারা এই বিষয়গুলোর সাথে যুক্ত যারা গুম খুনের সাথে যুক্ত তাদের বিচারের আওতায় আনবেন।
তিনি আরও বলেন, বেশ কিছু দিন ধরে আমরা দেখছি একটা অভিযানের নামে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। এ হত্যার জবাব একদিন দিতে হবে। তাই প্রত্যেকটি গুম খুনের বিষয়ে নিরপেÿ তদন্ত কমিশন গঠন করার দাবি জানান তিনি।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, বাংলাদেশে একটা মৃত্যুর দ্বীপ। মৃত্যুর উপত্যকা হয়ে গেছে। সম্প্রতি সময়ে একটি অভিযানের নামে ৫৪ জন মানুষকে হত্যা করা হলো অথচ তাদের দোষ কি আমরা জানি না। এই যে মানুষগুলো দাড়িয়ে আছে তাদের স্বজনরা জীবিত না মৃত সেটা জানো না তারা। কারও পুত্র কারও ভাই কারও স্বামী হারিয়ে গেছে। কোথাও খোঁজ পাওয়া যায়নি। কোনো জবাবও পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, গত দশ দিনে ৫৪ জন মানুষ পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। ওনারা বলছেন, বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। মন্ত্রী-র্যাব মহাপরিচালক বলছেন, দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এই রমজান মাসেই যুদ্ধটা শুরু করতে হলো বলে প্রশ্ন করেন মাহমুদুর রহমান মান্না।
তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, যুদ্ধ শুরু করলেন যাদের বিরুদ্ধে সেই বিরোধী পক্ষে করা? পত্র পত্রিকাগুলো নাম আসছে কারা মাদকের সাথে জড়িত। তাদের বাড়ির ঠিকানাও আসছে। কোথা থেকে মাদক আসছে, কোন জায়গায় কোন বাড়িতে বিক্রি হয়। কারা কারা এগুলো পাচার করে। কারা বহন করে তাদের সবার নাই আসছে। কিন্তু এদের বিরুদ্ধে সরকার কোন ব্যবস্থা নেয়নি। একজন এমপির নাম ধরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করা হয়েছে, মন্ত্রী বলেছেন, তার বিরুদ্ধে মেলা অভিযোগ কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই। প্রমাণের জন্য কোথায় কোথায় খুজেছেন। পুলিশ কি তদন্ত করেছে? আমাদের জানানো হোক।
তিনি বলেন, আমি প্রশ্ন করতে চাই যে ৫৪ জনকে হত্যা করলেন তাদের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ এবং অভিযোগের প্রমাণ আপনাদের কাছে কি কি আছে। প্রমাণ না থাকলে একজন এমপিকে যদি গ্রেফতার করতে না পারেন তাহলে প্রমাণ ছাড়া এতগুলো মানুষকে হত্যার অধিকার আপনাকে কে দিয়েছে।
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, রমজান মাস নাকি সংযমের মাস। এই মাসেই মানুষ হত্যায় নতুন করে মেতে উঠেছে সরকার। আর সবকিছুর মূল আগামী একাদশ নির্বাচন। বিনা চ্যালেঞ্জে আবার ক্ষমতায় যাবার জন্য এইসব তালবাহানা করছে। কিন্তু দেশবাসী আর ছাড় দেবে না। যেকোন মূল্যে এই সরকারকে হটিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধভাবে দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার আহ্বান জানান এবং পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের আগে গুম হওয়া স্বজনরা যেন তাদের পরিবারের সাথে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারে সেই আহ্বান জানান।
নিখোঁজ আবদুল কাদের মাসুমের মা আয়শা আলী প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি স্বজনহারা। আপনি বুঝেন স্বজন হারানো বেদনা কেমন। আমরাও মা হিসেবে আপনার কাছে আমাদের সন্তানদের ফেরত চাই। আমরা আশাবাদি আপনি চাইলে আমাদের সন্তান ফিরে পাবো। সন্তানকে ফিরিয়ে দিয়ে আমাদের বাঁচতে দিন। নয়তো আমাদেরও নিয়ে নিন।
সভাপতি মারুফা ইসলাম ফেরদৌসি বলেন, আমার মা ছেলের শোকে কাঁদতে কাঁদতে কুজো হয়ে গেছে। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। তার ছোট্ট নাতি সুমনের ছোট্ট মেয়ে আরোয়াকে বলে, আমি আর তুমি পাসপোর্ট করে ওপারে চলে যাবো। ওখানে যতগুলো কারাগার আছে খুঁজে খুঁজে তোমার বাবাকে বের করে আনবো। আপনারা জানেন সুমনের মতো আজকে এখানে যারা উপস্থিত রয়েছেন সবারই একই অপেক্ষা। কারো বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই।
আমরা আমাদের প্রিয় মানুষকে কাছে পেতে চাই। তাদের সাথে ঈদ করতে চাই। প্রধানমন্ত্রী আপনি তো আপনার স্বজনকে নিয়েই ঈদ করেন। তবে আমাদেরকে কেন ঈদ আনন্দ থেকে বঞ্চিত করবেন। আফরোজা ইসলাম আখি বলেন, হয় গুম হওয়া সবাইকে ফিরিয়ে দিন না হয় আমাদের সবাইকে মেরে ফেলুন। এভাবে তিলে তিলে মৃত্যুবরণ না করে একসাথে মরে যেতে চাই। এত কষ্ট আর সহ্য হয় না।