স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, ঢাকা: ষোড়শ সংশোধনী মামলায় আপিল বিভাগের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে সরকারের করা রিভিউ দরখাস্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ বাতিলের(এক্সপাঞ্জ) আবেদন নেই। আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে করা রিভিউ দাখিল করা হলেও এখনো শুনানী হয়নি। ফলে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল রায়ই এখনো বহাল। সুতরাং আপিল বিভাগের রায়ের আলোকে দুই মেয়াদে (২০১৪ সালের দশম এবং আসন্ন একাদশ সংসদ) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হবে শুধুমাত্র অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ছাড়া উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়ে।
বিচারপতি এস কে সিনহা তার রায়ে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ যে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে শর্তসাপেক্ষে দুই মেয়াদে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন করার কথা বলেছিলেন, তার পুনরুল্লেখ করেন। তার রায়ের বিরুদ্ধে দায়ের করা রিভিউ দরখাস্তে যেসব বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে এক্সপাঞ্জ চাওয়া হয়েছে, তার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন সংক্রান্ত পর্যবেক্ষণ নেই।
বিচারপতি সিনহা লিখেছিলেন, দুই মেয়াদে (২০১৪ সালের দশম এবং আসন্ন একাদশ সংসদ) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে শুধু একটি বাধা অপসারণ করতে হবে। আর তা হলো কোনো অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে প্রধান উপদেষ্টা করা যাবে না।
সিনহার পর্যবেক্ষণ: বিচারপতি এস কে সিনহা তার রায়ে লিখেছেন, স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে যোগ দেয়নি। সে কারণে সংসদ দুই মাসের বেশি স্থায়ী হয়নি। বিরাট বিক্ষোভের পরে সরকার সংবিধান সংশোধন করতে বাধ্য হয়েছিল। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তন করা হয়েছিল। কিন্তু এই ব্যবস্থার যে অনিরাময়যোগ্য কিছু অন্তর্গত দুর্বলতা রয়েছে, তা শনাক্ত করতে বেশি বিলম্ব ঘটেনি। ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫৮খ, ৫৮গ, ৫৮ঘ, ৫৮ঙ অনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়। এবং ৬১, ৯৯, ১২৩, ১৪৭ এবং ১৫২ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা হয়। তৃতীয় তফসিলে ফরম ১ ক যুক্ত করা হয়। সংশোধিত বিধানের আওতায়, একটি নির্দলীয় সরকার প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা ভোগ করবে। কিন্তু তারা একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে কাজ করবে। এবং পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী শপথ না নেয়া পর্যন্ত মেয়াদে এই সরকার কোনো নীতিনির্ধারণী সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া ছাড়াই দৈনন্দিন রুটিন দায়িত্ব পালন করবে। কি উপায়ে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করা হবে, সেটা সংবিধানের ৫৮গ অনুচ্ছেদে বলা আছে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বাছাই নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলো। এরকম একটি মেয়াদে সেনাবাহিনীর প্রধান একটি ক্যু-এর ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন এবং তার পরিণামে তাকে অপসারিত হতে হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত এই ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হলো। এবং আপিল বিভাগেও তা এলো। আবদুল মান্নান বনাম বাংলাদেশ (৬৪ ডিএলআর) মামলায় সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে ওই সংশোধনীকে সংবিধান বহির্ভূত বলে রায় দেয়া হলো। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে এটা স্থির হলো যে, আগামী দুটি সাধারণ নির্বাচন ত্রয়োদশ সংশোধনীর আওতায় হতে পারে; তবে শর্ত হলো ৫৮ গ অনুচ্ছেদের ৩ ও ৪ ধারার আওতায় প্রধান উপদেষ্টার নিয়োগ সাবেক প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতির মধ্য থেকে নেয়া যাবে না।
বিচারপতি এস কে সিনহা আপিল বিভাগ কেন ওই নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেই বিষয়ে তার পর্যবেক্ষণ দেন। তিনি লিখেছেন, আপিল বিভাগ ওই পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন এটা বিবেচনায় নিয়ে যে, প্রধান বিচারপতি নিয়োগে তাহলে রাজনীতিকীকরণ হতে পারে। আর সেজন্য বিকল্প ব্যবস্থা হবে নির্বাচন কমিশনকে আরো শক্তিশালী করা। তার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ জোরদার করতে হবে যাতে সংসদীয় নির্বাচন সর্বদাই অবাধ ও সুষ্ঠু হতে পারে। আপিল বিভাগ লক্ষ্য করেছেন যে, প্রতিটি নির্বাচনে যে দল হেরে যায়, তারাই নির্বাচনে নিরপেক্ষতার বিষয়ে অভিযোগ তুলে থাকে এবং বিরোধী দল সংসদে সহযোগিতা করে না। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নিলো না।
এরপর বিচারপতি সিনহা লিখেছেন, এই আপিল বিভাগ মত দিচ্ছে যে, সরকার একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সব রকম ক্ষমতা প্রদান করে তাকে শক্তিশালী করবে। নির্বাচন কমিশনে কোনো শূন্যতা তৈরি হলে সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই তা আপনাআপনি পূরণ হয়ে যাবে। কিন্তু কোনো সরকারই এবিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
বিচারপতি সিনহা অবাধ নির্বাচনে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায়ের উল্লেখ করে বলেছেন, এটা প্রত্যাশিত যে, একটি দেশ যেখানে সাংবিধানিক গণতন্ত্র থাকবে, সেখানে নিচে উল্লিখিত বিষয়গুলো বিদ্যমান থাকবে। আর তা হলো: ক. নির্বাচনের শুদ্ধতা, খ. শাসনে সাধুতা, গ. ব্যক্তির মর্যাদার পবিত্রতা, ঘ.আইনের শাসনের পূতঃপবিত্রতা, ঙ. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, চ. আমলাতন্ত্রের দক্ষতা এবং গ্রহণযোগ্যতা, ছ. বিচারবিভাগ, আমলাতন্ত্র, নির্বাচন কমিশন, সংসদের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা, জ. এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সততা ও শ্রদ্ধাভাজন হওয়া।
বিচারপতি খায়রুলের পর্যবেক্ষণ:
বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক ত্রয়োদশ সংশোধনী রায়ের অথর জাজ। তিনি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে এসোসিয়েশন অব ডেমোক্রেটিক রিফরমস মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি শাহ’র বরাতে লিখেছেন, একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে যতো ধরনের ক্ষমতার দরকার তার সবটারই এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। সংবিধানে যে ‘নির্বাচন’ শব্দটি রয়েছে এর আওতায় একটি নির্বাচন করার আগে ও পরের প্রতিটি স্তর ও ধাপ অন্তর্ভুক্ত আছে বলেই গণ্য হবে। সংসদ যদি কখনও কোনো ‘‘বৈধ’’ আইন তৈরি করে তবে তার বিধানাবলী তাকে মানতে হবে। তবে সংবিধান নির্বাচন কমিশনের জন্য এমনই রেসিডুয়ারি ক্ষমতা সংরক্ষিত করেছে যার আওতায় তার পক্ষে অবাধ নির্বাচনের স্বার্থে সবরকম পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব।
বিচারপতি খায়রুল এরপর মন্তব্য করেছেন, ‘‘ওই মতামত থেকে এটাই পরিষ্কার যে, সর্বাগ্রে নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলের প্রভাব বা হস্তক্ষেপ থেকে তার নিজকে মুক্ত রাখতে হবে। এমন ব্যক্তিদের দিয়ে ইসি গঠন করতে হবে যারা জনগণের চোখে নিরপেক্ষ বলে গণ্য হবেন।’’
বিচারপতি খায়রুল হক ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ে দুই মেয়াদে কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন করার জায়গা থেকে সরে এসে নতুন করে এখতিয়ারবহির্ভূত রায় পুনর্লিখন করেছেন বলে উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন সুপারসিডেড হয়ে পদত্যাগকারী বিচারপতি এম এ ওয়াহ্হাব মিয়া। বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিয়া মনে করেন, বিচারপতি খায়রুল যেভাবে দুই মেয়াদে কেয়ারটেকারের অধীনে নির্বাচন করার রায় পাল্টেছেন তা এখতিয়ারবহির্ভূত। বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানাও বিচারপতি ওয়াহ্হাব মিয়াকে সমর্থন করেছেন।