ঢাকা: চুয়াডাঙ্গা, নীলফামারী, দিনাজপুর, নেত্রকোনা, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ সন্দেহভাজন আট মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন।
দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযানের মধ্যে গতকাল সোমবার রাতে এই ‘বন্দুকযুদ্ধ’ হয়। এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় গত আট দিনে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ৩৬ জন নিহত হলেন। তাঁদের মধ্যে ৩০ জন মাদক ব্যবসায়ী বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি।
প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, আঞ্চলিক কার্যালয় ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
চুয়াডাঙ্গা: গতকাল দিবাগত রাত একটার দিকে আলমডাঙ্গা শহরের রেলস্টেশনের পাশে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ কামরুজ্জামান ওরফে সাধু (৪৫) নামের এক ব্যক্তি নিহত হন।
পুলিশের ভাষ্য, কামরুজ্জামান জেলা পুলিশের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর বাড়ি আলমডাঙ্গা উপজেলার হারদী ইউনিয়নে।
ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, তিনটি গুলি ও এক বস্তা ফেনসিডিল উদ্ধারের দাবি করেছে পুলিশ। তারা বলছে, এ ঘটনায় পুলিশের তিন সদস্য আহত হন।
সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি-সদর) আহসান হাবীবের ভাষ্য, বিপুল পরিমাণ মাদক আসার খবর পায় পুলিশ। এই খবরের ভিত্তিতে আলমডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু জিহাদ ফকরুল আলম খানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল গতকাল রাতে স্টেশনের পাশে অবস্থান নেয়। রাত একটার দিকে সন্দেহভাজন কয়েকজনকে থামতে বলে পুলিশ। এ সময় সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়ে। বন্দুকযুদ্ধে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী কামরুজ্জামান আহত হন। তাঁকে উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসা কর্মকর্তা।
পুলিশ বলছে, বন্দুকযুদ্ধে পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) জিয়াউর রহমান, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) হামিদুল ইসলাম ও কনস্টেবল মাসুদ রানা আহত হয়েছেন। তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
আলমডাঙ্গা থানার ওসি আবু জিহাদ ফকরুল আলম খান জানান, কামরুজ্জামানের লাশ চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। তিনি পুলিশের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে অন্তত ১২টি মামলা রয়েছে। কারাভোগের পর সম্প্রতি বাড়ি ফিরে আবার মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি।
নীলফামারী: সৈয়দপুরের গোলাহাট বধ্যভূমি এলাকায় গতকাল রাতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ দুই ব্যক্তি নিহত হন। তাঁরা হলেন শহরের নিচু কলোনি এলাকার জনি (৩৪) ও ইসলামবাগ এলাকার শাহিন (৩২)।
পুলিশ বলছে, জনি ও শাহিন মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। বন্দুকযুদ্ধের স্থান থেকে ইয়াবা ও ককটেল উদ্ধার করা হয়েছে।
এলাকাবাসীর ভাষ্য, জনি ও শাহিনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল। আজ মঙ্গলবার ভোরে গোলাহাট এলাকায় তাঁদের লাশ পাওয়া যায়।
সৈয়দপুর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অশোক কুমার পালের ভাষ্য, আটকের পর জনি ও শাহিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা জানান, গোলাহাট বধ্যভূমি এলাকায় জসিয়ার রহমান ও নূর বাবু নামের দুই মাদক ব্যবসায়ী মাদকের বড় চালান নিয়ে আসবেন। এই তথ্যের সূত্র ধরে আটক দুজনকে নিয়ে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। এ সময় পুলিশকে লক্ষ্য করে মাদক ব্যবসায়ীরা গুলি চালান। ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটনান। পুলিশ পাল্টা গুলি করে। এ ঘটনায় জনি ও শাহিন নিহত হন। আহত হন পুলিশের তিন সদস্য।
পুলিশ জানায়, নিহত দুজনের লাশের ময়নাতদন্ত হবে। এ জন্য লাশ দুটি মর্গে পাঠানো হবে।
দিনাজপুর: বিরামপুর পৌর শহরের মনিরামপুর এলাকায় গতকাল রাতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ প্রবল হোসেন (৩৫) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। পুলিশ বলছে, প্রবল হোসেন মাদক ও অস্ত্র ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর বাড়ি উপজেলার দক্ষিণ দামোদরপুর-বাসুপাড়া গ্রামে। বাবার নাম খলিলুর রহমান।
পুলিশের ভাষ্য, ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল, তিনটি গুলি, পাঁচটি ককটেল ও ৯২ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশের তিন সদস্য আহত হয়েছেন।
দিনাজপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) মো. মিজানুর রহমানের ভাষ্য, মাদক ও অস্ত্রের চালান আসছে বলে খবর পায় পুলিশ। এই তথ্য পেয়ে গতকাল রাতে পুলিশের একটি দল মনিরামপুর এলাকায় যায়। এ সময় ১০-১২ জন ব্যক্তি পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি করে। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। এতে প্রবল হোসেন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আহত হন পুলিশের তিন সদস্য।
বিরামপুর থানার ওসি আব্দুস সবুর জানান, ময়নাতদন্তের জন্য প্রবলের লাশ দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
ফেনী: গতকাল রাতে সদর উপজেলার লেমুয়া ব্রিজ এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মঞ্জুর আলম (৪৫) নামের এক ব্যক্তি নিহত হন।
র্যাব বলছে, মঞ্জুর আলম মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায়। বন্দুকযুদ্ধের স্থান থেকে ৯ হাজার ৮২০টি ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়েছে।
র্যাবের ভাষ্য, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে র্যাব-৭, ফেনী ক্যাম্পের সদস্যরা গতকাল রাতে লেমুয়া ব্রিজের পূর্ব পাশে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে তল্লাশিচৌকি বসায়। এ সময় একটি মাইক্রোবাসকে থামার সংকেত দেয় র্যাব। তারা সংকেত অমান্য করে। একপর্যায়ে মাইক্রোবাস থেকে আরোহীরা নেমে র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। র্যাবও পাল্টা ছোড়ে। পরে মাইক্রোবাস নিয়ে চালক পালিয়ে যান। ঘটনাস্থল থেকে এক ব্যক্তিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে র্যাব। তাঁর কাছে প্রায় ১০ হাজার ইয়াবা বড়ি পাওয়া যায়। তাঁকে উদ্ধার করে ফেনী সদর হাসপাতালের নেওয়া হয়। পরীক্ষা শেষে তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসা কর্মকর্তা। পরে নিহত ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত করা হয়।
র্যাব-৭ ফেনী ক্যাম্পের অধিনায়ক স্কোয়াড্রন লিডার শাফায়াত জামিল ফাহিম বলেন, নিহত ব্যক্তিকে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করেছিল চট্টগ্রাম র্যাব। তাঁর বিরুদ্ধে অপহরণ, ডাকাতি ও মাদকের মামলা রয়েছে। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন।
নেত্রকোনা: সদর উপজেলার বড়ওয়ারি বালুমহাল এলাকায় গতকাল রাতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ আমজাদ হোসেন (৩২) নামের এক ব্যক্তি নিহত হন। পুলিশ বলছে, আমজাদ তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগে ১৩টি মামলা রয়েছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আমজাদ হোসেন জেলা ছাত্রদলের কর্মী ছিলেন। তাঁর বাড়ি শহরের পশ্চিম নাগড়া এলাকায়।
পুলিশ বলেছে, মাদকবিরোধী অভিযানের অংশ হিসেবে গতকাল রাতে আমজাদকে তাঁর বাসা থেকে আটক করা হয়। পরে তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারে বড়ওয়ারি বালুমহাল এলাকায় অভিযানে যায় পুলিশ।
এ সময় সংঘবদ্ধ মাদক ব্যবসায়ীদের একটি দল পুলিশের ওপর হামলা করে। পুলিশ পাল্টা গুলি চালায়। এতে আমজাদ নিহত হন। এ ঘটনায় পুলিশের কয়েকজন সদস্য আহত হন।
নেত্রকোনা মডেল থানার ওসি বোরহান উদ্দিন খান বলেন, ঘটনাস্থল থেকে ৫০০ গ্রাম হেরোইন, ৩০৫টি ইয়াবা বড়ি, একটি পাইপগান ও দুটি কার্তুজ উদ্ধার করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া: গতকাল রাত দুইটার দিকে বাঞ্ছারামপুর উপজেলার সোনারামপুর এলাকায় র্যাব-১০-এর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মো. ধন মিয়া ওরফে সবুজ (২৯) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। র্যাব বলছে, তিনি মাদক ব্যবসায়ী।
সবুজের বাড়ি উপজেলার মরিচাকান্দি গ্রামে। তাঁর স্ত্রী আরজিনা বেগমকে র্যাব আটক করেছে।
র্যাবের ভাষ্য, ঘটনাস্থল থেকে ১১ হাজার ৬০০টি ইয়াবা বড়ি, একটি বিদেশি পিস্তল ও একটি প্রাইভেট কার উদ্ধার করা হয়েছে।
র্যাব-১০-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মহিউদ্দিন ফারুকীর ভাষ্য, নারায়ণগঞ্জের একটি কুরিয়ার সার্ভিস থেকে ইয়াবার চালান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে যাবে বলে খবর পাওয়া যায়। এই খবরের ভিত্তিতে কালো রঙের একটি প্রাইভেট কারের পিছু নেয় র্যাব। একপর্যায়ে বাঞ্ছারামপুরের সোনারামপুর গ্রামের মো. আলীর বাড়ির পাশের রাস্তায় প্রাইভেট কারটি আটকে যায়। র্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে গাড়িতে থাকা সবুজ গুলি চালায়। র্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। এতে সবুজ গুরুতর আহত হন। তাঁকে উদ্ধার করে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন কর্তব্যরত চিকিৎসা কর্মকর্তা।
বাঞ্ছারামপুর থানার ওসি নিজাম উদ্দিন বলেন, ময়নাতদন্তের জন্য সকালেই সবুজের লাশ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
চট্টগ্রাম: গতকাল রাত তিনটার দিকে নগরের বায়েজীদ বোস্তামী থানার ডেবারপাড় এলাকায় র্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শুক্কুর আলী (৪৫) নামের এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। র্যাব বলছে, নিহত ব্যক্তি মাদক ব্যবসায়ী ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে নগরের বিভিন্ন থানায় মাদকের ১০টি মামলা রয়েছে।
র্যাব-৭ চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক (গণমাধ্যম) মিমতানুর রহমান বলেন, মাদক ব্যবসায়ীরা অবস্থান করছেন—এমন খবর পেয়ে র্যাবের একটি দল ডেবারপাড় এলাকায় অভিযান শুরু করে। এ সময় র্যাব সদস্যদের লক্ষ্য করে মাদক ব্যবসায়ীরা গুলি ছোড়েন। র্যাবও আত্মরক্ষার্থে পাল্টা গুলি করে। পরে ঘটনাস্থলে একজনের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। তাঁর পরিচয় নিশ্চিত করে স্থানীয় লোকজন। ঘটনাস্থল থেকে ১০ হাজার ইয়াবা বড়ি, ৫০০ গ্রাম গাঁজা, একটি ওয়ান শুটারগান, তিনটি গুলি, দুটি গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়।
রাতেই শুক্কুরের লাশ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে আজ সকালে নিহত ব্যক্তির বড় মেয়ের স্বামী মো. সোহেল দাবি করেন, তাঁর শ্বশুরের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। গতকাল তিনি ডেবারপাড়ে আসেন। রাত ১২টার দিকে সাদাপোশাকধারী কিছু লোক এসে তাঁর শ্বশুরকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে যায়। পরে তাঁরা রাতে গুলি শব্দ শুনতে পান। বাসা থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে শ্বশুরের লাশ দেখতে পান তিনি।
নিহত ব্যক্তির স্ত্রী জরিনা বেগমের দাবি, তাঁর স্বামী মাদক সেবন করতেন। কিন্তু বিক্রি করতেন না।