এবার রমজানে রাজধানীবাসীকে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হবে। দুই সিটি করপোরেশন, মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থা নগরজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি করে রাখার কারণে রাস্তাগুলো সরু হয়ে গেছে। এ ছাড়া যত্রতত্র পার্কিং, রাস্তা-ফুটপাথ দখল করে হকারদের ব্যবসা, অবৈধ রিকশার আধিপাত্য, সড়কে আবর্জনার ডাস্টবিন, বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা, কেনাকাটা বৃদ্ধিসহ অসহনীয় যানজট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পুলিশ ও সিটি করপোরেশন বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো পথ দেখছেন না নগরবাসী।
রাজধানীতে বর্তমানে জনাধিক্য চলছে। নানাকাজে ঢাকামুখী স্রোত অব্যাহত রয়েছে। প্রতিদিনই বাড়ছে জনসংখ্যা। প্রতিটি সড়ক, অলিগলিতে সকাল থেকেই শুরু হয় জনস্রোত। গভীর রাত পর্যন্ত অলিগলির সড়ক থাকে কর্মব্যস্ত। এজন্য সকাল-সন্ধ্যা যানজট লেগেই থাকছে। এমন কোনো সড়ক নেই যে কর্মদিবসে যানজটের শিকার হতে হয় না নগরবাসীকে। আগে ছুটির দিনগুলোতে রাস্তাঘাট যানজট থেকে একটু ফুসরৎ পেত। এখন ছুটির দিনে রাস্তায় ব্যক্তিগত বাহন আরো বেশি নামে। দিনদিন পরিস্থিতি জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। রমজানে রাজধানীতে মানুষের পদচারণা আরো বেড়ে যাবে। মাসের শুরুতে বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা পাইকারি দরে কাপড়, মসলাসহ নানা জাতীয় পণ্য কিনতে ঢাকায় আসেন। এ ছাড়া রমজানকে কেন্দ্র করে বাইরে থেকেও অনেক পণ্য আসে রাজধানীতে।
বিশেষ করে মওসুমি হকারেরা ঢাকায় আসেন বিপুলসংখ্যক। আর শেষ দিকে রাজধানী ছেড়ে যাওয়ার জন্য মানুষ ভিড় জমান টার্মিনাল ও ঘাটগুলোতে।
সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ঈদকে কেন্দ্র করে ঢাকার বাইরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী বাড়তি উপার্যনের জন্য ঢাকায় আসেন। এদের মধ্যে সর্বাধিক হচ্ছেন হকার, রিকশাচালক ও ভিক্ষুক। এ ছাড়াও ব্যবসায়ী কারণে আসার সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। সবমিলিয়ে ১০ লক্ষাধিক বহিরাগত এই সময় ঢাকায় প্রবেশ করেন।
বর্তমানে রাজধানীর মূল সড়ক থেকে অলিগলির অসংখ্য সড়ক খুঁড়ে রাখা হয়েছে। মেট্রোরেলের কারণে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত চলছে খোঁড়াখুঁড়ি। বিশেষ করে মিরপুরের বিশাল এলাকাজুড়ে রাস্তার অর্ধেক বন্ধ করে রাখা হয়েছে। এতে দুই দিকের সড়ক সরু হয়ে পড়েছে। এতে মিরপুরের সড়কগুলোতে প্রতিদিন অসহনীয় যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। আর বৃষ্টি হলেই ওই এলাকার সড়কগুলোতে জলাবদ্ধতার চিত্র সবার জানা। আগারগাঁও, কাজীপাড়া, শ্যাওড়াপাড়ার বিপুলসংখ্যক জনগণ এ কারণে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন কয়েক মাস ধরেই। মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে চার দিকের প্রতিটি রাস্তা খুঁড়ে রাখা হয়েছে। এতে প্রতিদিন ওই এলাকায় ভয়াবহ যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। রমজানে এ যানজটের মাত্রা আরো বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া বাসাবোর বিভিন্ন সড়ক, শাজাহানপুর, রাজারবাগ, ফকিরাপুল, আরামবাগ, নাজিমউদ্দিন রোডসহ পুরান ঢাকার বিভিন্ন সড়ক খুঁড়ে রাখায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন এলাকাবাসী।
রাজধানীতে হকারেরা ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ছেন। তাদের আচারণ এখন এমন যে, তারাই যেন রাস্তার মালিক। সিটি করপোরেশন সম্প্রতি ফুটপাথ চওড়া ও উন্নয়ন করলেও তার সুফল পথচারীরা পাচ্ছেন না। বরং ফুটপাথে হকারদের বসিয়ে প্রতিদিন কোটি টাকা আয় করা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আরো পোয়াবারো হয়েছে। নতুন নতুন হকার বসিয়ে তারা ব্যবসা আরো প্রশস্ত করেছে। রমজান আসার কারণে ফুটপাথের হকারদের যেন লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে সিটি করপোরেশনও। তারা আর এ মাসে কোনো অভিযান চালাবে না বলেও ঘোষণা দিয়েছে। ফলে ফুটপাথ-রাস্তা সবই এখন হকারদের দখলে। ফলে পথচারীরা আর হাঁটতে পারছেন না। আর যেসব স্থানে হকারেরা বসে না সেখানে দোকানদারেরা তার দোকানের সামনের অংশে মালামাল রেখে দখল করে রাখছেন। ফুটপাথ দখল করে চলছে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ। অলিগলির সরু রাস্তায় ছোট টংঘর, পানের দোকান, ভ্যানে রাস্তার ওপর সবজি, কাপড়চোপড় নিয়ে বসে পড়ছেন কিছু ব্যক্তি। ফলে ওই সড়ক দিয়ে আর কোনো গাড়িও সঠিকভাবে যেতে পারছে না। এ ছাড়া পাইকারি মার্কেটগুলোর সামনে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান, ঠেলাগাড়ি রেখে অর্ধেক রাস্তা দখল করে রাখা হচ্ছে।
আরিফুর রহমান নামে এক ব্যাংক কর্মচারী বলেন, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, পল্টন মোড়, নয়াপল্টন, ফকিরাপুল, মালিবাগ, মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকাতেই দেখা যায়, ফুটপাতের ওপর মালামাল সাজিয়ে বসে আসেন হকারেরা। তাদের কারণে পথ দিয়ে হাঁটাও যায় না। তাদের কিছু বলতে গেলে উল্টো মারতে আসে। গুলিস্তানের একজন দোকানদার বলেন, হকারদের কারণে আমাদের দোকানে ক্রেতারা ঠিকমতো আসতেও পারেন না। তারা কোনো গাড়ি, বাইক নিয়ে এলেও রাখার জায়গা থাকে না। হকারদের বলতে গেলে তারা উল্টো চোখ গরম দেখায়। কারণ তাদের সাথে প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা আছেন।
রাজধানীতে গাড়ি পার্কিং অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশির ভাগ অফিস ও মার্কেটে কোনো পার্কিংয়ের জায়গা নেই। এ কারণে গাড়ির মালিকেরা সড়কেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি পার্কিং করে রাখছে। এতে রাস্তার বেশির ভাগ অংশ দখল হয়ে থাকছে। এতে গণপরিবহন ও মানুষের চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। সড়কে পার্কিংয়ের কারণে যানজটও বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ছাড়া গণপরিবহন চলাচলে প্রতিযোগিতার কারণে নির্দিষ্ট কোনো স্টপেজ না থাকায় যাত্রী তুলতে প্রতিযোগিতা চলছে। রাস্তায় গাড়ি দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছে গণপরিবহনগুলো। এতেও সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের।
রাজধানীতে এক সময় ৮৭ হাজার রিকশার লাইসেন্স ছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশন সেগুলো নবায়ন না করায় সবই অবৈধ হয়ে গেছে। কিন্তু বিভিন্ন জরিপ থেকে জানা যায়, বর্তমানে প্রায় ১০ লাখের মতো রিকশা অবৈধভাবে চলাচল করছে ঢাকায়। এসব রিকশা কোনো নিয়ম-কানুন মানছে না। যে সব সড়কে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেখানেও ঢুকে পড়ছে রিকশা। এ ছাড়া মোটরচালিত রিকশার আধিপত্য রয়েছে অলিগলির সড়কে। এসব রিকশা যখন যাত্রী থাকে না তখন রাস্তা দখর করে দাঁড়িয়ে থাকছে। বিশেষ করে রাস্তার মোড়ে রিকশার জট লেগেই থাকে। এ ছাড়া বেশির ভাগ রিকশা সুযোগ পেলেই উল্টোপথে চলার প্রবণতার কারণে যানজট ও দুর্ঘটনা বাড়ছে।
বর্ষাকাল আসতে এখনো প্রায় এক মাস বাকি। কিন্তু রাজধানীতে অনেক আগেই বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। গত কিছুদিনের বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য মতে রমজানজুড়েই বর্ষার আধিপত্য থাকবে। এ কারণে রমজানে বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতায় অনেক ভুগতে হবে ঢাকাবাসীকে। রমজানে মানুষের কেনাকাটা বেড়ে যায়। বিশেষ করে বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকেন ক্রেতারা। এতে সড়কে মানুষের চাপ বেড়ে যায়। ফলে সৃষ্টি হয় যানজটের। এ বছর বেশির ভাগ সড়ক খুঁড়ে রাখায় রাস্তা সরু হয়ে গেছে। এতে প্রতিটি সড়কেই ভয়াবহ যানজটের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
নগরবিশেষজ্ঞ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, নগরীতে রাস্তা কেটে আবার মাটি ফেলা হচ্ছে রাস্তার আরেক অংশে। এতে রাস্তা সরু হয়ে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এভাবে রাস্তার ওপর মাটি ফেলে রাখার কোনো নিয়ম নেই। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনকে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি আরো বলেন, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের দিনে ঢাকায় প্রবেশ করার কথা নয়। কিন্তু সেগুলো বিভিন্নভাবে ঢুকে পড়ছে। এতে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন নয়া দিগন্তকে বলেন, রমজান মাসে অনেক নগরবাসী বড় বড় শপিংমল থেকে মালামাল কিনতে পারেন না। তারা ফুটপাথ থেকে কাপড় কেনেন। এজন্য রমজানে আমরা হকারদের উচ্ছেদ না করে তাদের কিভাবে শৃঙ্খলায় আনা যায় সে চিন্তা করছি। তিনি বলেন, রিকশা ও লেগুনা বিভিন্ন সড়কের বাম দিক দখল করে দাঁড়িয়ে থাকে। এতে সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়। প্রাইভেট কার রাস্তার ওপর পার্কিংয়ের কারণে যানজট হয়। আমরা এগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পুলিশকে অনুরোধ করেছি। মেয়র বলেন, রাস্তার উন্নয়ন কাজের জন্য খোঁড়াখুঁড়ি করতে হয়েছে। তবে রমজানে যাতে ভোগান্তি কমে সেজন্য পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডসহ আশপাশের সড়কগুলো তিন-চার দিনের মধ্যে জনসাধারণের চলাচলের উপযোগী করার জন্য আমাদের প্রকৌশল বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছি। অন্যান্য এলাকাতেও দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য বলেছি। কিন্তু বর্ষা মওসুম হওয়ার কারণে কাজ সঠিকভাবে করা যাচ্ছে না।