ইতিহাসের গল্প: রূপমতি

সাহিত্য ও সাংস্কৃতি

zসুলতান বাজ বাহাদুরের মাথায় কবিতার দুটি লাইন ঘুরছে,

‘সূর্যালোতে অন্ধ হলো গন্ধ বকুল ফুল
অতল জলে স্পর্শ খেলে সখীর দীঘল চুল’

পুরো কবিতাটা সাজানো যাচ্ছে না। ব্যাপারটায় তিনি খুব বিরক্ত। গতরাতে একটা স্বপ্ন দেখলেন। মন খুব অস্থির। স্বপ্নে দেখেছেন বিশাল জলাশয়ে একটা নীল পদ্ম ফুটে আছে। অতি আশ্চর্য সেই নীলপদ্মের পাশে বসে আছে এক রূপসী নারী। সে একটা ধারালো ছুরি দিয়ে হাত কেটে রক্ত বের করে নীল পদ্মে ঢালছে পদ্মটিকে লাল করার জন্য। স্বপ্নের অর্থ বের করতে পারছেন না।

ভাবলেন শিকারে যাবেন। এতে যদি মনের অস্থিরতা একটু কমে। ছুটলেন নর্মদা নদীর ধারে। নদীর ধারে বনে শিকার খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ শুনলেন কিন্নর কণ্ঠে কে যেন গান গাইছে। চুপচাপ এগুলেন উৎস দিকে। গিয়ে দেখলেন নদীতে স্নান করছে এক অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে। আবক্ষ জলে নেমে রূপসী গান করছে-

‘নদী, তোর জল ছুঁয়ে গেলো মোর যৌবন মধু
তীর্থ পথে কাঙালপনায় মেঘ হয়ে রবে শুধুশুধু
যদি সে আসে
বসে পাশে পাশে
বৃষ্টি ঝরায় মধুর আশে
তবে তাকে ভিজিয়ে দিস যৌবন সুধারসে’

কী চমৎকার সেই কণ্ঠ! সুলতান মুগ্ধ হয়ে গান শুনলেন। স্নান শেষে মেয়েটি জল থেকে উঠলে তিনি এগিয়ে গেলেন। কালো চোখের মেয়েটি বিস্ময় নিয়ে তাকালো। সুলতান জানালেন, আমি বাজ বাহাদুর। গোস্তাকি মাফ করবেন। আড়াল থেকে আপনার কিন্নর কণ্ঠের সুধা পান করেছি। পান করার পর তৃষ্ণা দমেনি, আরো বেড়ে গেছে। আমার মহলে এসে যদি গান শুনিয়ে এ অভাগার তৃষ্ণা দূর করতেন, চিরঋণী থাকতাম।’ মেয়েটি কী বলবে বুঝে পেলো না। চপল পায়ে ভেজা শরীরে লজ্জায় দৌড়ালো।

মেয়েটির নাম রূপমতি। সাধারণ হিন্দু রাজপুত ঘরের মেয়ে। গান ভালোবাসে। অসাধারণ রূপবতী মেয়েটিকে প্রথম দেখে ও গান শোনার পর মালওয়ার সুলতান বাজ বাহাদুর কঠিন প্রেমে পড়লেন। এর মাঝে লোক লাগিয়ে মেয়েটিকে একবার মহলে এনে গানও শোনা হলো। রূপমতি কেবল রূপবতীই নয়, তার স্বরে যাদু আছে। গান শুনে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়তে হয়।

রূপমতিও মনে মনে রাজার প্রেমে পড়ে আছেন। কিন্তু কিছুই প্রকাশ করছেন না। রাজাই একদিন মহলে ডাকলেন রূপমতিকে গান শোনানোর জন্য। গান শুনে রাজা প্রস্তাব রাখলেন, ‘সুকণ্ঠী, তোমার গানের কণ্ঠ অসাধারণ, রূপযৌবনে তোমার সমকক্ষ কেউ নেই। অতুলনীয়া, তোমার যা আছে সেই তুলনায় আমার কিছুই নাই। তবু মন মানে না। তোমাকে পাওয়ার জন্য অস্থির মন। যদি এই ভিখারি তোমার কাছে তোমার ভালোবাসা প্রার্থনা করে, তবে কি ফিরিয়ে দেবে?’ রূপমতি রাজাকে ফেরাবেন কি! নিজেওতো তার প্রেমে ডুবে আছেন। তবে শর্ত জুড়ে দিলেন যদি মান্ডুর এই রাজপ্রাসাদ থেকে নর্মদা নদী দেখা যায় তবেই তিনি এ প্রাসাদে থাকবেন। প্রাণের নদীকে ছেড়ে না হলে তিনি থাকতে পারবেন না। সুলতান শর্ত মেনে নিলেন, তার হবু বেগম রূপমতির জন্য পাহাড়ের ওপরে বানালেন এক ঐশ্বরীয় রাজপ্রাসাদ যার নাম রূপমতি প্যাভিলিয়ন এবং যার ওপর থেকে রূপালি সূতোর এক চিলতে নর্মদাকে দেখা যায়।

হিন্দু রূপমতিকে সুলতান হিন্দু ও মুসলমান দুই রীতিতেই বিয়ে করলেন। বিয়ের পর কবি সুলতান বাজ বাহাদুর আর গায়িকা রূপমতির সুখের সংসার ভালোই চলছিলো। শিল্পপ্রেমী বাজ বাহাদুরের আর আর সুলতানদের সাথে ভালোই সম্পর্ক। দিল্লির সম্রাট আকবরের সাথেও তার ভালোই খাতির, তাই নির্ভাবনায় শিল্পসাধনায় এই দম্পতির জীবন সুখেই কাটছিলো। রূপমতির রূপ আর কণ্ঠের প্রশংসা ছড়িয়ে পড়লো সারা ভারতবর্ষে। সম্রাট আকবরের কানেও গেলো। সম্রাট আকবর বাজ বাহাদুর আর রূপমতিকে আমন্ত্রণ জানালেন দিল্লির দরবারে। বাজ বাহাদুর তার আমন্ত্রণ রক্ষা করলেন। রূপমতি গান গেয়ে শুনালেন,

‘তোমায় তুষ্ট করতে ফুল ছিঁড়ে খোঁপায় দিয়েছি
ভালোবাসার জন্যই প্রিয় আমি এত নির্মম হয়েছি’।

কয়েকদিন দিল্লি থেকে বাজ বাহাদুর রূপমতিকে নিয়ে ফিরে গেলেন মান্ডু। কিন্তু আকবর কিছুতেই ভুলতে পারেন না রূপমতির রূপ, তার কিন্নর কণ্ঠস্বর। ভেতরে ভেতরে ছটফট করে ওঠেন সম্রাট। কোথাকার কোন এক ছোট-খাট সুলতান বাজ বাহাদুর, তার কাছে রূপমতির মত মহামূল্যবান ধন কেন থাকবে!
ডাকলেন সেনা অধম খানকে। হুকুম করলেন বাজ বাহাদুরকে মেরে রূপমতিকে তুলে নিয়ে আসতে। অধম খান বিশাল সৈন্য নিয়ে মান্ডু আক্রমন করতে গেলেন। বাজ বাহাদুর কবি, শিল্প নিয়েই পড়ে থাকেন। তার সৈন্য বাহিনী ছোট। অধম খানের আক্রমনের সামনে দাঁড়াতে পারলেন না। বাধ্য হয়ে পালাতে হলো। রূপমতিকে নিয়ে যাওয়ার মতো সুযোগটাও হলো না তার। রূপমতি খবর পেলেন বাজ বাহাদুর পরাজিত হয়েছেন, অধম খান তাকে নিয়ে যেতে আসছে। নিজেকে অন্যের হাতে তুলে দিতে চাইলেন না। আত্মহত্যা করলেন রূপমতি।

সম্রাট আকবর যখন রূপমতির আত্মহত্যার সংবাদ পেলেন, তখন তার চোখের কোণায় জল জমলো। তিনি গুনগুন করে গাইলেন,

‘ভালোবাসার জন্যই প্রিয় আমি এত নির্মম হয়েছি…’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *