শীর্ষপদের জন্য দৌড়ঝাঁপ বিতর্কিত ও অভিযুক্তদের

Slider রাজনীতি

317565_160

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলন শুরু হচ্ছে আজ। দুই দিনব্যাপী এ সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব উঠে আসবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে গঠন করা নতুন এই কমিটিকে ভবিষ্যতে দলের প্রয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। তাই এবারের সম্মেলনকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে ছাত্রলীগ ও এর অভিভাবক সংগঠন আওয়ামী লীগ। এজন্য পদপ্রত্যাশীদের ব্যাপারে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। যদিও বরাবরের মতো এবারের কমিটিতেও শীর্ষপদ প্রত্যাশীদের তালিকায় রয়েছেন বিতর্কিত, অভিযুক্ত, বিবাহিত ও অনিয়মিতরা। তবে বিতর্কিত নেতাদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছে আওয়ামী লীগ। বিভিন্ন সময় নেতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দলকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলেছেন ওইসব নেতারা যেন কোনোভাবেই কমিটিতে আসতে না পারে সেজন্য সরকারি-বেসরকারি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তবে সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে নেতৃত্ব নির্বাচনে কিন ইমেজ, মেধাবী এবং নিয়মিতদের প্রাধান্য দেয়া হবে। তবে গঠনতন্ত্র মেনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিয়ে এবারের নতুন নেতৃত্ব আসবে বলে ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে।

সম্মেলন উপলক্ষে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে ছাত্রলীগ। আজ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রধান অতিথি থেকে এ সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, এবারের সম্মেলনে যে কয়েকটি বিষয় প্রাধান্য দেয়া হবে তার মধ্যে রয়েছেÑ মেধাবী, সাহসী ও নিয়মিত ছাত্রদের অগ্রাধিকার। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তাদের বয়স হবে অনূর্ধ্ব সাতাশ বছর। এর আগে ছাত্রলীগের যেকোনো কমিটি নির্দিষ্ট সময়ে তাদের সম্মেলন করতে না পারায় গত সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২ বছর বাড়িয়ে তাদের বয়স ২৯ বছরে বেঁধে দেন। তবে এ বছর যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই সম্মেলন হচ্ছে তাই সাতাশ বছরকেই বিবেচ্য হিসেবে ধরা হবে বলে ছাত্রলীগের একাধিক সূত্রে জানা গেছে। নির্বাচনের মাধ্যমেই আগামীর জন্য দক্ষ, মেধাবী, পরিশ্রমী, সংগঠনের জন্য ত্যাগী এবং শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার যোগ্য নেতৃত্ব উঠে আসবে বলে জানা গেছে। তবে সিলেকশনের একটি ব্যাপার শোনা গেলেও ইলেকশনের ব্যাপারেই ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। কারণ এর মাধ্যমে তৃণমূলের মত প্রকাশের সুযোগ থাকে। এ ছাড়া সিলেকশন পদ্ধতিতে নেতৃত্ব আসলে বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে তাদের মধ্যে কোন্দরসহ বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। তবে সর্বক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনাকে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হিসেবে দেখছে ছাত্রলীগ।

সম্মেলনের সার্বিক বিষয়ে জানতে কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। জানতে চাইলে সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন বলেন, সম্মেলনকে কেন্দ্র করে আমাদের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। কিছু কাজ বাকি থাকলেও রাতের মধ্যেই তা সম্পন্ন হবে। আগামীকাল (আজ) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে এ সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন। তবে আগামীর নেতৃত্ব নির্বাচনে বিবেচ্য বিষয় সম্পর্কে জানতে চাইলে জাকির বলেন, গঠনতন্ত্র অনুসারে সবকিছু পরিচালিত হবে। মেধাবী, সাহসী, নিয়মিত ছাত্র, অবিবাহিত, ত্যাগী ও পরিশ্রমী সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে পারবে এমন নেতৃত্ব উঠে আসবে। তবে সর্বক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকেই প্রাধান্য দিয়ে আগামীর নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে। তিনি আমাদের যে নির্দেশনা দেন আমরা তাই করবো।

ইতোমধ্যে ঢাকার (মহানগর উত্তর, দক্ষিণ) দু’টি এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মেলন শেষ হলেও এখনো কমিটি ঘোষণা হয়নি। কেন্দ্রীয় সম্মেলনের পরপরই এসব কমিটির শীর্ষপদগুলোর আগামী নেতেৃত্বের নাম ঘোষণা করা হবে। তাই কেন্দ্রীয় কমিটি, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় এবং মহানগর কমিটিতে শীর্ষপদের জন্য দৌড়ঝাঁপ দিচ্ছেন তারা।

এ দিকে সংগঠনটির শীর্ষপদগুলোর জন্য ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেটের কাছে লবিং করছেন বিতর্কিত এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্তরা। সম্মেলনকে সামনে রেখে মাদকাসক্ত, ইয়াবা ব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ, ঠিকাদার, বিবাহিত ও নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অভিযোগ আছে, এমন নেতাদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ভালো ইমেজধারী নেতারা অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন।

জানা গেছে, পদপ্রত্যাশী নেতাদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধেই রয়েছে নানা অভিযোগ। তাদের মধ্যে ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির পদপ্রার্থী দিদার মু নিজামুল ইসলামের বাড়ি কুমিল্লায়। তার বড় ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালেয়র বিজ্ঞান অনুষদ শিবিরের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পরে লন্ডনে জামায়াত করতেন। তা ছাড়াও তার চাচাতো ভাই মাওলানা রাশেদুল ইসলাম জামায়াতে ইসলামীর রুকুন ও ছাত্রশিবিরের দেবিদ্বারের সাবেক নেতা। তার বড় ভাই চবিতে শিবির করাকালে ছাত্রলীগের সাথে শিবিরের সংঘর্ষ হয়। তাতে সে তৎকালীন এক ছাত্রলীগ কর্মীর পা ভেঙে ফেলেন। তিনি হলের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন পলাশীগামী একটি সিএনজি থেকেও ১০ হাজার টাকা চাঁদা নেন বলেও অভিযোগ আছে।

ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক পঞ্চগড়ের সাদ্দাম হোসাইনের বাবা স্থানীয় থানা জামায়াতের আমিরের সাথে ভালো সম্পর্ক। বোদা থানা জামায়াতের আমিরের বাড়ির পাশেই তাদের বাসা। তা ছাড়া তার বাবা মুক্তিযুদ্ধা হওয়ায় এই কোটায় তার তিন ভাই-বোনের সরকারি চাকরি হয়েছে। তিনি ২০১০-১১ সেশনে ঢাবির আইন বিভাগে ভর্তি হলেও এখনো তার অনার্স (তৃতীয়) শেষ হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্সও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় শীর্ষ দুই পদের প্রার্থী। ঢাবির রেজিস্টার ভবনে টেন্ডারবাজি ও ঢাবির অস্থায়ী ক্যাম্পাসের দোকানগুলো থেকে চাঁদাবাজি, গণরুমে ঢুকে হকিস্টিক দিয়ে শিার্থীদের পেটানো, বিভাগের শিকদের সাথে অসদাচারণ এবং বিশ^বিদ্যালয়ের অনিয়মিত শিক্ষার্থীসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ আছে তার বাবা জামায়াতের ভোটার ও বিএনপির রাজনীতি করে। তার দাদা মুসলিমলীগ করত। তিনিও এক সময় শিবিরের বিভিন্ন প্রোগ্রামে উপস্থিত থাকতেন।

মাহজারুল ইসলাম শামীমের পরিবারের সাথে বিএনপি জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করেছেন ছাত্রলীগের একটি সূত্র। তার বাবা গতবার বিএনপি থেকে চেয়ারম্যান নির্বাচন করেছে। আপন চাচাতো ভাই হাফেজ হুমায়ুন কবির কুমিল্লা শহর শিবিরের সাবেক সেক্রেটারি ছিলেন। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী ও বর্তমান সহসভাপতি আরেফিন সিদ্দিক সুজনের বাবা পাকিস্তান আমলে জামায়াতের রোকন ছিলেন। তার মেঝ ভাই নাহিদুল ইসলাম বিএনপি রাজনীতির সাথে জড়িত বলে জানা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে তার বিরুদ্ধে মোটরসাইকেল ছিনতাইয়ের অভিযোগ রয়েছে। আছে ক্যান্টিনে ফাও খাওয়ার অভিযোগ।
বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রলীগে সাবেক সহসভাপতি শাহরিয়ার কবির বিদ্যুতের বিরুদ্ধে মুহসিন হলে মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে। পাশাপাশি মোতাহার হোসেন প্রিন্সের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারেও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে।

কেন্দ্রীয় কমিটির উপদফতর সম্পাদক শেখ নকিবুল ইসলাম সুমন ৫ জানুয়ারির আগ মুহূর্তে ছাত্রদলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। নির্বাচনের পরে এসে আবার ছাত্রলীগে সক্রিয় হন। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের সভাপিত ইউসুফ উদ্দিন খানের বিরুদ্ধে বিরোধী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততার অভিযোগ।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল শাখার বর্তমান সভাপতি তাহসান আহমেদ রাসেল, সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান তাপস, রাকিবুল ইসলাম ঐতিহ্য সাংবাদিক মারধর, পলাশীতে চাঁদাবাজির এবং হলে ফাও খাওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী ও মাস্টার দা সূর্যসেন হলের বর্তমান সভাপতি মো: গোলাম সরওয়ার এবং শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের সভাপতি সোহানুর রহমান সোহানের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা মামলা ছাড়াও ক্যান্টিন ও দোকানে ফাও খাওয়ার অভিযোগ। পদপ্রত্যাশী আমিনুল ইসলাম বুলবুলের বিরুদ্ধে গোপালগঞ্জ থানায় হত্যাচেষ্টা মামলা রয়েছে। যার ১ নম্বর আসামি তিনি।

ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে পরিচিত কেন্দ্রীয় কমিটির উপগ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ফুয়াদ হোসেন শাহাদাতের বিরুদ্ধে বিজয় একাত্তর হলের ক্যান্টিনে এবং ক্যাম্পাসে ভ্রাম্যমাণ দোকানে চাঁদাবাজির অভিযোগ।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পদপ্রতাশী ও বর্তমান কমিটির দুই সহসভাপতি নাজমুল হক ও নিশীতা ইকবাল এবং সাংগঠনিক সম্পাদক আশিকুল পাঠান ওরফে সেতু ও দারুস সালাম শাকিল, আপ্যায়ন সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম ওরফে রাশেদ, উপপরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মোজাহিদুল ইসলাম ওরফে সোহাগ ও উপ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক মাহাবুবুল ইসলাম ওরফে প্রিন্সের বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুল্লাহ বিপ্লবের বিরুদ্ধে ৫ জানুয়ারির আগে ছাত্রদল করার অভিযোগ রয়েছে। তার পরিবারও বিএনপির সাথে সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত বলে জানা যায়।
স্যার এ এফ রহমান হলের সদ্যবিদায়ী সভাপতি হাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে উদ্যানে মাদক ব্যবসায় নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মারামারির অভিযোগ আছে। কবি জসীম উদ্দীন হলের বর্তমান সভাপতি আরিফ হোসেন ক্যান্টিনে বাকি খাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সাধারণ সম্পাদক শাহেদ খানের বিরুদ্ধেও ক্যান্টিনে চাঁদাবাজির অভিযোগ। এ ছাড়া দু’জনের বিরুদ্ধে হলে ইন্টারনেট বাণিজ্যেরও অভিযোগ আছে। অমর একুশে হলের সভাপতি আবদুর রাজ্জাক রাজ ও সাধারণ সম্পাদক এহসান উল্লাহার বিরুদ্ধে আনন্দবাজার থেকে লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *