ঢাকা: গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের এক দিনের ব্যবধানে অন্তত ১৯ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে এবং পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এই সংখ্যা বাড়তেও পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গেল কয়েক বছরও এমন খবর গণমাধ্যমে উঠে আসে। তবে এ বছর সংখ্যাটা বেশি। কিন্তু কেন এই আত্মঘাত? এর জন্য দায় কার? এসবের উত্তর ও প্রতিকার অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। নইলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাওয়াটা অস্বাভাবিক হবে না।
ফেল করাটাও যে পরীক্ষার অংশ কিংবা জিপিএ-৫-এর বাইরেও যে অন্যান্য পয়েন্ট আছে, গত ১০-১২ বছরে তা ক্রমান্বয়ে ভুলতে বসেছে শিক্ষার্থীরা। অভিভাবকেরাও একই মন্ত্রে বুঁদ হয়ে থাকেন। কেবল তা-ই নয়, অনেক কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান শুধু জিপিএ-৫-কেই মেধার মানদণ্ড হিসেবে বেঁধে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট এবং শিক্ষাব্যবস্থা এত উন্নত ও নির্ভুল নয় যে এখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থী পাস করবে, সবাই জিপিএ-৫ পাবে। কিন্তু এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করার মানসিকতা এরই মধ্যে সমাজে তৈরি হয়ে গেছে। যার ফলস্বরূপ পরীক্ষায় পাস না করা কিংবা জিপিএ-৫ না পাওয়ায় আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেতে হলে ১০টি বিষয়ের মধ্যে অন্তত ৯টি বিষয়ে A+ পেতে হয়। আর A+ মানে ৮০ শতাংশ নম্বর। প্রায় প্রতিটি বিষয়ে ৮০ শতাংশ নম্বর তোলা সহজ কথা নয়। কিন্তু এই কঠিন কাজ সহজ করে ফেলা হয়েছে। এসএসসিতে গ্রেডিং পদ্ধতি চালু হয়েছিল ২০০১ সালে। সে বছর সারা দেশে জিপিএ-৫ পায় মাত্র ৭৬ জন। আর ২০০২ সালে ৩৩০ জন, ২০০৩ সালে ১ হাজার ৫৯৭ জন। এরপর ২০০৪ সালে তা এক লাফে হলো ৮ হাজার ৫৯৭ জন এবং ২০০৫ সালে বাড়ল প্রায় দ্বিগুণ, ১৫ হাজার ৬৩১ জন। তখন পর্যন্ত সংখ্যাটা মোটামুটি সীমিত বা স্বাভাবিক থাকায় জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের খুবই মেধাবী হিসেবে গণ্য করা হতো। সে সময় জিপিএ-৫ প্রাপ্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিযুদ্ধে খুব সহজেই উত্তীর্ণ হতো। এমনকি তখন জিপিএ-৪.০০, জিপিএ-৩.৫০, জিপিএ-৩ প্রাপ্তদেরও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াটা খুব কঠিন ছিল না। অর্থাৎ গ্রেডিং পদ্ধতির প্রথম কয়েক বছর কেউ জিপিএ-৫-এর কাছাকাছি পেলেও মেধাবী হিসেবে গণ্য হতো। যেমন: ৪.০০, ৪.২৫, ৪.৪০, ৪.৫০, ৪.৭৫, ৪.৮৮। আর জিপিএ-৩ থেকে জিপি-৪-এর মধ্যে থাকলে তাকে মোটামুটি ভালো ফল হিসেবে মনে করা হতো। কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোয় লাখে পৌঁছে যায় জিপিএ-৫ প্রাপ্তের সংখ্যা! সবশেষ ২০১৭ সালে জিপিএ-৫ পায় ১ লাখ ৪ হাজার ৭৬১ জন এবং এ বছর জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার ৬২৯ জন।
এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাওয়া কতটা স্বাভাবিক, তা নিয়ে খোদ বোর্ড পরীক্ষকদের কেউ কেউ গণমাধ্যমে বলেছেন যে তাঁদের উদারভাবে উত্তরপত্র মূল্যায়নের লিখিত নির্দেশনা দেওয়া হতো। এ ছাড়া কোনো পরীক্ষকের মূল্যায়িত উত্তরপত্রে জিপিএ-৫ কিংবা পাসের হার কম হলে তাঁকে জবাবদিহি করতে হতো। কয়েকজন বোর্ড পরীক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জিপিএ-৫-এর সংখ্যা এতটা বাড়ার পেছনে সৃজনশীল পদ্ধতিও একটি বড় কারণ। কেননা, এ পদ্ধতির মূল তত্ত্বই হলো দেখা (Seen) তথ্য-উপাত্ত থেকে উত্তর বের করা। সেখানে নম্বর কাটার সুযোগ কম থাকে। বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, দেশের বেশির ভাগ স্কুলশিক্ষকের সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন করার দক্ষতা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। সৃজনশীল পদ্ধতি প্রণয়নের উদ্দেশ্য ছিল মুখস্থনির্ভর শিক্ষা থেকে বেরিয়ে আসা। কিন্তু জ্ঞানের ভান্ডার বাড়ানোর জন্য তো মুখস্থেরও প্রয়োজন রয়েছে। আমরা ছোটবেলায় স্কুলপর্যায়ে যেসব বিষয় পাকাপোক্তভাবে মুখস্থ করেছি, সেগুলোর অনেক কিছুই আমাদের এখনো মনে আছে। তাই ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে প্রয়োজন হলেই সেই মুখস্থভান্ডার থেকে আমরা আহরণ করি। ক্লাসে যদি শিক্ষক প্রতিটি বিষয়ের প্রতিটি অধ্যায় ভালোভাবে পড়ান, তাহলে তা মুখস্থ রাখলেই-বা সমস্যা কী? দায়িত্বটা শিক্ষকের। শিক্ষকেরা সব সময় ঠিকমতো বুঝিয়ে পড়ান না বিধায়, শিক্ষার্থীরা না বুঝে মুখস্থ করে। সুতরাং বুঝিয়ে পড়ানো, মুখস্থ ও সৃজনশীল—এই তিনের মধ্যে সমন্বয়টা জরুরি। শুধু সৃজনশীলের আবরণে ছাত্রছাত্রীদের বেশি নম্বর তোলার ফর্মুলায় আদতে কোনো কল্যাণ নেই।
জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বাড়ানো মানের শিক্ষার্থীদের এগিয়ে দেওয়া নয়, বরং পিছিয়ে দেওয়া। কারণ, এই সংখ্যা যত বাড়বে, জিপিএ-৫ প্রাপ্তরা প্রতিযোগিতায় তত পিছিয়ে পড়বে। আর জিপিএ-৫-এর নিচে যারা পেয়েছে, তারা আরও তলানিতে পড়ছে।
প্রথমত, শুধু এসএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে কলেজে ভর্তির নিয়মের কারণে জিপিএ-৫ প্রাপ্তরা ভালো কলেজগুলো দখলে নেয় এবং অন্যরা বঞ্চিত হয়। দ্বিতীয়ত, জিপিএ-৫-এর সংখ্যা হু হু করে বাড়ায় বুয়েটসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনের শর্তে এসএসসি ও এইচএসসিতে পদার্থ, রসায়ন, গণিত ও ইংরেজিতে জিপিএ-৫ বাধ্যতামূলক করা হয়। এ ক্ষেত্রেও বৈষম্য তৈরি হচ্ছে; যদিও গত বছর এই নিয়ম কিছুটা শিথিল করা হয়। তৃতীয়ত, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকসহ নানা প্রতিষ্ঠানে চাকরির বিজ্ঞাপনে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৫ শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। তাই এদিক থেকেও তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। চতুর্থত, কোনো শিক্ষার্থী জিপিএ-৫-এর এক বিন্দু কম পেলেই অভিভাবকেরা বিব্রত হয়ে পড়ছেন, পাছে পাড়াপড়শি নাক শিটকায়।
পরিবার ও সমাজের এসব বঞ্চনা, গ্লানি পুরোটাই একতরফাভাবে বইতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। ফলে চারদিক থেকে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। এই বাস্তবতায় জিপিএ-৫ না পাওয়া ১৫-১৬ বছর বয়সী কিশোর বা কিশোরীরা প্রচণ্ড মানসিক চাপ অনুভব করে এবং তা থেকে মুক্তি পেতে চায়। আর এই বয়সে এত বড় চাপ মোকাবিলায় তারা সবাই সফল হয়ে উঠবে, এমন আশা করাটা বাড়াবাড়ি রকমের আবদার।
জিপিএ-৫ সবাই পাবে না। দেওয়াও উচিত নয়। কেননা, প্রতিটি বিষয়ে শতকরা ৮০ নম্বর পাওয়ার যে ধরনের মানসম্পন্ন লেখার প্রয়োজন, পরীক্ষার হলে মাত্র দুই-তিন ঘণ্টায় তা কতজন পারে? আমরা আশা করতে পারি সবাই ভালো করুক। কিন্তু জোর করে এত এত জিপিএ-৫ ধারী তৈরি করছি কেন? বেশি শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাওয়া মানে তো শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে যাওয়া নয়। মনে রাখতে হবে, কোনো জিনিস সহজলভ্য হয়ে গেলে সেটির মূল্যায়নও কমে যায়। জিপিএ-৫ যে গতিতে বেড়েছে, সেই গতিতে না আবার আত্মহত্যা বেড়ে যায়! ‘পরীক্ষার ফল প্রকাশ ও আত্মহত্যা’—এটিকে এখন একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করার সময় এসেছে।
জিপিএ-৫ না পাওয়ার মতো পাস করতে না পারাকেও আর মেনে নিতে পারছে শিক্ষার্থীরা। লেখাপড়ার ব্যাপারে আগের চেয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা এসেছে ঠিকই। পাসের হার বাড়াটাও ইতিবাচক। প্রতিটি শিক্ষার্থী পাস করুক, সেটা কে না চায়। কিন্তু পাসের হার যখন দ্রুতগতিতে বেড়ে শতকরা ৮০ থেকে ৯০-এর ঘরে ঘোরাফেরা করে, তখন ফেল করাটা সমাজের চোখে ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের বিষয়ে পড়ে। সে কারণেই এবার যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে বা করে ফেলেছে, গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী তাদের বেশির ভাগই পাস করতে না পারার কারণে। কথা হলো, পাস-ফেল পরীক্ষারই অংশ। একবার না হলে পরেরবার হবে। কিন্তু এটির প্রতি আমরা শিক্ষার্থীদের কীভাবে, কেন এতটা মরিয়া করে তুললাম?
এই সমস্যা নিরসনে চলমান সিলেবাস, পরীক্ষা-পদ্ধতি, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন—সবকিছুতেই বাস্তবতার আলোকে পরিবর্তন আনা অত্যন্ত জরুরি। সাময়িক নয়, বরং টেকসই একটা ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার, যার মাধ্যমে ভবিষ্যতে কেবল জিপিএ-৫ প্রাপ্তরাই নয়, অন্যান্য পয়েন্ট পাওয়া শিক্ষার্থীরাও মূল্যায়িত হবে এবং সমাজে এ-সংক্রান্ত অস্থিরতা কাটিয়ে ওঠা যাবে।
এখানে গণমাধ্যমেরও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে। প্রতিবার ফলাফল প্রকাশের পরপরই জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের ওপর বেশি বেশি আলো ফেলা হয়। এর ফলে অন্যরা হীনম্মন্যতায় ভোগে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে এত সাড়ম্বরে সংবাদ প্রকাশ বা সম্প্রচারের কী আছে? থাকুক না ওরা ওদের মতো, উদ্যাপনটা ওরা নিজেদের মতো করে করুক। গণমাধ্যমের একমুখী প্রতিবেদনের ফলে শিক্ষার্থী, অভিভাবক তথা সমাজে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হচ্ছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখা দরকার।
যখন অবাক করা গতিতে পাসের হার ও জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বাড়া শুরু করল, তখন গণমাধ্যমও এর কারণ অনুসন্ধান করা শুরু করল। শিক্ষাবিদেরাও এর ত্রুটি-বিচ্যুতি নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন উঠল। হয়তো শিক্ষামন্ত্রীও তা অনুধাবন করতে পেরেছেন। তাই গেল বছর উচ্চমাধ্যমিকের পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই কমেছে। তখন শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, উত্তরপত্র মূল্যায়ন সঠিক হওয়ায় পাসের হার কমেছে। এ বছর মাধ্যমিকে পাসের হার কমে ৮০ থেকে ৭৭ শতাংশ হলো। এবারও শিক্ষামন্ত্রী বললেন উত্তরপত্র সঠিক মূল্যায়ন হয়েছে, নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা কমেছে, পাসের হার কমলেও শিক্ষার মান বেড়েছে। কিন্তু এখন আবার কোনো কোনো গণমাধ্যম পাসের হার কমাকে ফলাফলের অবনতি হিসেবে প্রতিবেদন প্রচার করছে। আসলে ৮০ থেকে ৭৭ কিংবা ৭৭ থেকে ৮০-তে ওঠা-নামা অবনতি বা উন্নতির মান নির্দেশ করে না; বরং স্বাভাবিকভাবে পুরো প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটাই কাম্য।
মোদ্দা কথা হলো, পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল-পরবর্তী আত্মহত্যাপ্রবণতা বাড়ার এই প্রেক্ষাপটে সরকারে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নড়েচড়ে বসার সময় এসেছে। এই সমস্যা সমাধানে বিস্তারিত ব্যাখ্যা ও করণীয় নিয়ে দেশের মানুষের সামনে শিক্ষামন্ত্রীর হাজির হওয়া সময়ের প্রয়োজন বলে মনে করি।
লেখক: সাংবাদিক