বড় ঋণের ফাঁদে আটকা পড়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ব্যাংকিং খাতের মোট ঋণের প্রায় সাড়ে ৫৭ শতাংশই বড় ঋণ। এ ঋণের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ৪০ শতাংশ, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৬৫ শতাংশ, বিশেষায়িত ব্যাংকের ৪৭ শতাংশ এবং বিদেশী বাণিজ্যিক ব্যাংকের ৭৩ শতাংশ বড় ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। ২০১৬ সালে ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ৫৮ শতাংশ ছিল বড় ঋণ। কয়েক বছর ধরে বড় ঋণের দিকে বেশি ঝুঁকছে ব্যাংকগুলো। বড় ঋণের কারণে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সব ধরনে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
গতকাল রাজধানীর মিরপুরে বিআইবিএম অডিটোরিয়াম এবং বাংলাদেশ ব্যাংক রাজশাহী অফিসে ‘ক্রেডিট অপারেশনস অব ব্যাংকস’ শীর্ষক বার্ষিক পর্যালোচনা কর্মশালায় উপস্থাপিত গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। কর্মশালায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এবং বিআইবিএম নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান ও বিআইবিএমের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্বে) ড. শাহ মো: আহসান হাবীব ও প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন ড. প্রশান্ত কুমার ব্যানার্জ্জী।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর বলেন, ব্যাংক ঋণসংক্রান্ত বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবসময়ই বিশেষ সজাগ। এর পরও খেলাপি ঋণসহ বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ আর্থিক অনিয়ম বিষয়ে নজরদারি বাড়িয়েছে এবং খেলাপি ঋণ কমাতে বেশ কয়েকটি পদেক্ষপ নিয়েছে।
মূল প্রবন্ধে ড. ব্যানার্জ্জী বলেন, ক্রেডিট ডিপোজিট রেশিও, শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ সীমা এবং বড় ঋণের বিষয়ে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। একই সাথে ঋণের গুণগত মানোন্নয়নের বিষয়ে বিশেষ নজর রাখতে হবে। তিনি বলেন, নৈতিকতাসম্পন্ন লোকের অভাব নেই। কিন্তু তারা যথার্থ মূল্যায়িত হয় না। বরং যারা নৈতিকতার সাথে সমঝোতা করে তারা পেশাগত দিক থেকে এগিয়ে গেছে, যা ব্যাংকিং খাতের জন্য সুখকর নয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. বরকত-এ-খোদা বলেন, গ্রামের মানুষ ঋণ কম পাচ্ছে। এতে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং কম হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে নীতিনির্ধারকদের চিন্তা করতে হবে, কিভাবে সবাইকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনা যায়।
পূবালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হেলাল আহমদ চৌধুরী বলেন, গ্রাহকদের মানসিকতার পরিবর্তন হলে কোনো ঋণ খেলাপি হবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও বিআইবিএমের সুপারনিউমারারি অধ্যাপক ইয়াছিন আলীলেন, কিছু ধূর্ত লোক একই সম্পত্তি দেখিয়ে বারবার দেখিয়ে ঋণ নেয়। এ সংক্রান্ত বিষয়ে বারবার আলোচনা হয়েছে। বিষয়টি এখন নজর দেয়ার সময় এসেছে।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো: ওবায়েদ উল্লাহ-আল মাসুদ বলেন, ঋণ দেয়ার আগে গ্রাহকদের ছয় মাসের ব্যাংক লেনদেন খতিয়ে দেখতে হবে। খেলাপি ঋণ মনিটরিংয়ে ডাটা ব্যাংক করতে হবে।
গৃহঋণের বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কেননা আইনজীবীরা জমিসংক্রান্ত অনেক তথ্য দেয় যা সঠিক নয়। অবশ্যই সরেজমিন পরিদর্শন করে ঋণ দিতে হবে। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ওয়াসেক মো: আলী বলেন, ব্যাংক জনগণের অর্থ অন্যদের ঋণ দেয়। এ কারণে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে ব্যাংক কর্মকর্তাদের। ঋণ নিয়ে গ্রাহকেরা কারখানা বানাল, না দামি গাড়ি কিনে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা ব্যাংককে নজরদারি করতে হবে। এনআরবি ব্যাংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মেহমুদ হোসেন বলেন, সব ব্যাংক খেলাপি কমানোর চেষ্টা করছে। তবে গুণগত মানের উন্নতি হচ্ছে না। এ জন্য ব্যাংক ঋণের বিষয়টি আবার পর্যালোচনা করতে হবে। ত্রুটি-বিচ্যুতি খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নিতে হবে। অনুষ্ঠানের সভাপতি ড. শাহ মো: আহসান হাবিব ঋণ আদায়ে আরো শক্তিশালী আইন প্রণয়ন তার প্রয়োগ এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
গবেষণা দলে অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ সোহেল মোস্তাফা, বিআইবিএমের সহযোগী অধ্যাপক অতুল চন্দ্র পণ্ডিত, বিআইবিএমের সহকারী অধ্যাপক তাহমিনা রহমান, বিআইবিএমের প্রভাষক সাদমিনা আমির এবং জনতা ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো: ইসমাইল হোসেন।