খালেদা জিয়ার জামিন শুনানি : যা বললেন দুই পক্ষের আইনজীবীরা

Slider রাজনীতি

316762_168

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জামিন বিষয়ে আপিলের শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, জামিন আবেদনকারী বেগম খালেদা জিয়া তার আবেদনে বলেছেন যে তিনি সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং একটি দলের চেয়ারপারসন। গত ৩০ বছর ধরে তিনি বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। তার দুই হাঁটু প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। তিনি হাঁটতে পারে না। তিনি আটক অবস্থায় আছেন। রেস্টে আছেন। বরং আমরা আপিল শুনানি শেষ করি। শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল এই বক্তব্য দেয়ার সাথে সাথে আদালতে উপস্থিত কয়েক হাজার আইনজীবী প্রতিবাদ জানান। এতে আদালতে কিছুটা হট্টগোল ও হইচই হয়।

এ সময় সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি জয়নুল আবেদীন আইনজীবী বলেন, উনার এসব কথা বলার দরকার কী? উনি রাষ্ট্রের একজন প্রধান আইন কর্মকর্তা। উনি কী এসব বলতে পারেন? তারপর তিনি আইনজীবীদের শান্ত থাকতে বলেন। এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, হাইকোর্ট চার মাসের মধ্যে এ মামলার আপিল শুনানির জন্য পেপার বুক করতে বলেছেন।

পেপার বুক তৈরি শেষ হয়েছে। আমরা তাড়াতাড়ি শুনানি শুরু করতে পারি। হাইকোর্ট খালাস দিলে কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এই পর্যায়ে তাকে জামিন দেয়া যায় না। তাই আপিল নিষ্পত্তি করা হোক।

মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চে শুনানিকালে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম এসব কথা বলেন। আপিল বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।

শুনানির শুরুতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, খালেদা জিয়া জামিনের অপব্যবহার করেছেন। তিনি বিভিন্নভাবে বিচার বিলম্বিত করেছেন। এসব বিবেচনা না করে হাইকোর্ট তাকে জামিন দিয়েছেন। তিনি ভারতের লালু প্রসাদ যাদব, দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট পার্ক গিউন হায়কে ২৪ বছরের কারাদণ্ড এবং ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট লুলা ডি সিলভাকে ১২ সাজা দেয়ার কথা উল্লেখ করেন।

অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, খালেদা জিয়াকে পিজি হাসপাতালে নেয়ার সময় হুইল চেয়ারে বাসার কথা বলা হয়েছে, কিন্তু তিনি তা ব্যবহার করেননি।

তবে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা বলেছেন, খালেদা জিয়ার পায়ের হাঁটুতে ব্যথা। তিনি হাঁটতে পারেন না। হাত ফুলে গেছে। উনার ঘাড়ে ব্যথা। উনার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, কারাগারের ডাক্তার উনাকে চেকআপ করলেন। পরে নাপা ওষুধ সেবনের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু উনার ব্যক্তিগত ডাক্তাররা দেখা করলেন, আবার বাইরে এসে সংবাদ সম্মেলন করেন। এটা কীভাবে সম্ভব। তারা তো ডাক্তার, ট্রিটমেন্ট করবে। সংবাদ সম্মেলন করতে পারে না। উনারা পরামর্শ দিলেন ইউনাইটেড হাসাপাতালে ভর্তির জন্য। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ উনাকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে পরীক্ষা করিয়েছেন। তাই করাগারে উনার সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তিনি বলেন, প্রয়োজন হলে ইউনাইটেড হাসপাতালে বা পিজিতে চিকিৎসা দেয়া হবে। তবে তা কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হবে। কেননা, উনার সঙ্গে একজন সেবিকাও দেয়া হয়েছে। কারাগারে এটা দেয়া হয় না।

এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ফৌজদারি মামলায় এর চেয়ে স্বচ্ছ বিচার দুনিয়ার কোথাও হয়নি। এটা একটা স্বচ্ছতম বিচার।
এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, এটি দেশের সর্বোচ্চ আদালত। তিনি এগুলো বলতে পারেন না। এমন একটি মামলায় তিনি দাঁড়াতে পারেন না। তখন আইনজীবীরা চিৎকার করে বলতে থাকেন ইয়েস! ইয়েস!’

এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, তাকে সাবমিট রাখতে দিন। এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ফৌজদারি মামলায় একজনের বেশি আইনজীবী যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেন না। সেখানে খালেদা জিয়ার পক্ষে পাঁচজন আইনজীবী যুক্তি উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেন, তারা এই মামলা ৯ বছর বিলম্ব করেছে। আমরা চাই তাড়াতাড়ি আপিল শুনানি হোক।
এ সময় খালেদা জিয়ার আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, এখন তো জামিনের শুনানি চলছে। আপিলের না। এ সময় আইনজীবীরা হৈচৈ শুরু করলে বিচারকক্ষের পরিবেশ কিছুটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।’

ওই সময় বিচারপতি ইমান আলী বলেন, আপনার সমর্থকদের চুপ থাকতে বলেন। তখন আইনজীবীরা বলেন, আমরা সমর্থক নই, আমরা আইনজীবী।
এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, হোক না। শেষ হয়ে গেছে! শেষ করতে দিন। আমরা এভাবে শুনতে পারব না।’ একপর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ মামলায় আপিলের নথি প্রস্তুত। আমরা চাইলে আগামীকাল থেকে শুনানি শুরু করতে পারি।

এরপর খালেদা জিয়ার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী শুনানি শুরু করেন। শুরুতেই তিনি অ্যাটনি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বলেন, অ্যাটর্নি জেনারেলের এখানে দাঁড়ানোর এখতিয়ার নেই। এখানে অ্যাটর্নি জেনারেলের বক্তব্য দেয়ার সুযোগ নেই। তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি বলেন, দুদক (দুর্নীতি দমন কমিশন) একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। তাদের আইনজীবী রয়েছে। আপনি এখানে শুনানি করতে পারেন না। আপনি কি রাষ্ট্রের নাকি দুদকের আইনজীবী? এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ আঙ্গুল উঁচিয়ে এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, আপনি এ সব বলতে পারেন না। জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও আঙ্গুল উঁচিয়ে বলেন, আমি বলতে পারি, আমি এই মামলার পার্টি। এ সময় এই দুই আইনজীবী মধ্যে কিছুটা বাকবিতণ্ডা শুরু হয়। আদালতে উপস্থিত শত শত আইনজীবীও হট্টগোল-হইচই শুরু করেন।

এসময় প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা আক্রমণ করে বক্তব্য দেবেন না। তিনি বলেন, এরকম হলে শুনানি করা যাবে না।

এরপার এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, খালেদা জিয়া যাতে নির্বাচন না করতে পারেন সেজন্য আদালতকে ব্যবহার করা হচ্ছে। তিনি বলেন, হাইকোর্ট জামিন দিয়েছেন তা আপিল বিভাগ স্থগিত করেছেন এমন একটি সিংগেল কেসও নেই।

এসময় প্রধান বিচারপতি বলেন, এই মামলার বিচার শেষ হতে নিম্ন আদালতে ৮-৯ বছর লেগেছে।
জবাবে এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, এই মামলা সাত বছর স্থগিত ছিল। অ্যাটর্নি জেনারেল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।

তিনি বলেন, দুদক ১৯৯৪ সালের নথি দিয়েছে। আর আমি আপনাদের ২০১৮ সালের মামলার নথি দিচ্ছি আপিল বিভাগের এই পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ দুদকের মামলায় নিম্ন আদালতের দেয়া ১০ বছরের সাজায় আপনারা জামিন দিয়েছেন। সেই বেঞ্চে আপনারাই ছিলেন। তিনি সব বিচারপতির নাম উল্লেখ করেন।

এসময় বিচারপতি ইমান আলী বলেন, এটা সংক্ষিপ্ত। ১০ বছরের সাজায় আপিল বিভাগ জামিন দিয়েছেন এটা বলতে চাচ্ছেন জবাবে এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, হ্যাঁ।
এরপর এজে মোহাম্মদ আলী বলেন, ভারতে হাইকোর্টে জামিন দিয়েছে তার একটা কেসেও আপিল বিভাগ স্থগিত করেননি। এখানে গোটা বিশ্বকে দেখানো হচ্ছে তিনি দুর্নীতিবাজ। কার্যতভাবে খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার জন্য এটা করা হচ্ছে।

আদালতে খালেদা জিয়ার আইনজীবী হিসেবে আরো উপস্থিত ছিলেন ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, খন্দকার মাহবুব হোসেন, আমিনুল হক, আবদুর রেজাক খান, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, মাহবুবউদ্দিন খোকন, বদরুদ্দোজা বাদল, সানাউল্লাহ মিয়া, কায়সার কামাল প্রমুখ।

মঙ্গলবার সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগ বেঞ্চে এ শুনানি শুরু হয়। শুরুতেই দুদক আইনজীবী খুরশিদ আলম মামলার পেপারবুক থেকে পড়ে শোনান। তিনি বলেন, খালেদা জিয়াকে বিচারিক আদালত পাঁচ বছরের কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন। এই লঘু দ- জামিনের কোনো কারণ হতে পারে না। দুদক বিচারিক আদালতের এই লঘু দণ্ডের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিভিশন করেছে।

তিনি বলেন, খালেদা জিয়া আদালতের অনুমতি না নিয়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন। চিকিৎসার কোনো সনদপত্র তিনি আদালতে জমা দেননি। এমনকি হাইকোর্টেও খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে কোনো সনদপত্র জমা দেয়া হয়নি। তিনি দাবি করেন, বয়স ও অসুস্থতা জামিনের কোনো কারণ হতে পারে কি না।

খুরশিদ আলম বলেন, দণ্ড হওয়ার পর বয়স জামিনের কারণ হতে পারে না। বয়স বিবেচনায় নিয়েই বিচারিক আদালত খালেদা জিয়ার সাজা কমিয়েছেন। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া কত দিন কারাগারে ছিলেন, সে বিষয়টি সেখানে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। খালেদা জিয়ার অসুস্থততার কথা বলে যে পেপারবুক আসামিপক্ষ আদালতে দিয়েছে, সেখানে ব্যক্তিগত চিকিৎসকের বক্তব্য দেয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *