খুলনা:এক দিনেই ঘোষণা হয়েছিল দুই সিটির নির্বাচনের তফসিল। প্রচার-প্রচারণাও শুরু হয়েছিল জোরেশোরে। নির্বাচনের নয় দিন আগে স্থগিত হয়ে গেছে গাজীপুর সিটির নির্বাচন। খুলনার প্রচার-প্রচারণা এখন তুঙ্গে। তবে গতকাল গাজীপুরে ভোট স্থগিতের ঘোষণার পর খুলনায়ও দেখা দিয়েছে ভয় আর শঙ্কা। নির্বাচন হবে তো- এমন প্রশ্নও তুলেছেন কেউ কেউ।
আবার কেউ কেউ বলছেন, এক দিনে দুই সিটির নির্বাচন ছিল। এখন একটির নির্বাচন হবে। এই নির্বাচনের গুরুত্বও বেড়ে যাবে কিছুটা।
দেশের দৃষ্টি থাকবে নির্বাচনের ওপর। এই নির্বাচন এখন সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং প্রধান দুই দলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেষ মুহূর্তে নির্বাচনের পরিবেশ কেমন থাকে এটি এখন আলোচনার কেন্দ্রে। ৪নং ওয়ার্ডের ভোটার আবদুল লতিফের সঙ্গে কথা হয় নগরীর শিববাড়ি এলাকায়। তিনি বলেন, গাজীপুরের ভোট স্থগিত হয়েছে, খুলনায় কি হয় কে জানে। আর ভোট হলেও শান্তিপূর্ণ না হলে মানুষ কেন্দ্রে যেতে ভয় করবে। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তার এলাকায় প্রধান দুই প্রার্থীর মধ্যে লড়াই হবে। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক ও বিএনপি প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুর ভোট রয়েছে। দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কিনা যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। গতকাল বিকালে কথা হয় রয়েল মোড়ের হোটেলের কর্মচারী আক্কাছ আলীর সঙ্গে। নির্বাচনে কোন মেয়র প্রার্থী সবচেয়ে বেশি ভোট টানতে পারবেন জানতে চাইলে তিনি অনেকটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বলেন, এটা বলা মুশকিল। তার দৃষ্টিতে পাঁচজন প্রার্থী মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও লড়াই হবে মূলত দুই জনের মধ্যে। একজন আওয়ামী লীগ প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক, অপরজন বিএনপি প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু। তাদের কেউ-ই কারো থেকে কম নয়। খালেকের খুঁটির জোর তিনি সরকারদলীয় প্রার্থী। তার ধারণা, এ কারণে উন্নয়ন কাজের বিবেচনায় ভোটাররা তাকে মেয়র হিসেবে দেখতে চাইবে। অন্যদিকে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই বিএনপি প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু। তিনি খুলনাবাসীর কাছে একজন জনপ্রিয়, স্বচ্ছ মানুষ হিসেবে পরিচিত। তা ছাড়া আগে থেকেই খুলনা বিএনপির ঘাঁটি। সে হিসেবে তিনি এগিয়ে রয়েছেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আদৌ সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে শঙ্কা রয়ে গেছে খুলনার ভোটারদের মধ্যে।
এদিকে গতকাল হাইকোর্টের নির্দেশে একইদিন অনুষ্ঠেয় গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন স্থগিত হওয়ার খবরটি ছড়িয়ে পড়ে ভোটারদের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত খুলনার নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ তৈরী হয়। খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হয়েছেন পাঁচজন। এর মধ্যে শক্ত দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আওয়ামী লীগের তালুকদার আবদুল খালেক ও বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জু। আগামী ১৫ তারিখের নির্বাচনে এই দুই প্রার্থীর মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। এমনটাই আভাস দিয়েছেন এই সিটির তৃণমূল পর্যায়ের ভোটাররা। তারা বলছেন, প্রার্থী হিসেবে কাউকেই খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। সম্ভাব্য হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মানদণ্ড নির্ধারণও করছেন ভোটাররা। তারা বলছেন, তালুকদার আবদুল খালেকের সরকারদলীয় প্রার্থী, স্বাভাবিকভাবেই তিনি বাড়তি সুবিধা পাবেন। অন্যদিকে বিএনপি প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু ব্যক্তিগতভাবে একজন ক্লিন ইমেজের মানুষ। এটা তার বড় যোগ্যতা হিসেবে ভোটাররা বিবেচনা করবেন। ভোটারদের নানামুখী বিশ্লেষণে তাই কেউ কারো থেকে পিছিয়ে নেই। অন্যদিকে বাকি ৩ মেয়রপ্রার্থীদের আলোচনাতেই আনছেন না ভোটাররা।
গতকাল খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা গেছে, ভোট নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি নেই মানুষের মাঝে। নগরীর সড়কের পাশের চায়ের দোকানগুলোতে আড্ডায়-আলোচনায় ঘুরে ফিরে আসছে ভোটের কথা। মেয়র প্রার্থীদের পাশাপাশি তাদের আলোচনায় ওঠে আসছে বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থীরাও।
রয়েল মোড়ে কথা হয় মাহমুদ আলী নামের এক ভোটারের সঙ্গে। তিনি বলেন, তালুকদার খালেক মেয়র হলে খুলনার উন্নয়ন হবে। কারণ, তিনি সরকারি দলের মেয়র। অন্যদিকে মঞ্জু মেয়র হলে আগের মেয়রের মতো তাকেও জেলে পাঠানো হতে পারে। এ বিবেচনায় সাধারণ ভোটারদের অনেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বেছে নিতে পারেন। আগামী সংসদ নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগ হেরে যায়, তখন কি হবে জানতে চাইলে তিনি পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়েন। বলেন, আদৌ কি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে? তবে বিএনপির প্রার্থী মঞ্জুকেও তিনি একজন জনপ্রিয় প্রার্থী মনে করেন। তার ধারণা, তিনি বিরোধী দলে না থাকলে বিপুল ভোটের ব্যবধানে জিততেন। মহানগরীর ডাকবাংলা মোড়ে কথা হয় সিএনজি চালক আসাদের সঙ্গে। নির্বাচনী প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি বলেন, খুলনায় সুষ্ঠু নির্বাচন হলে নজরুল ইসলাম মঞ্জুর বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। তিনি যোগ করেন, শেষ পর্যন্ত নির্বাচন না-ও হতে পারে। আর হলেও সেটা সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। এখনো পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে কিনা জানতে চাইলে আসাদ বলেন, সরকারদলীয় প্রার্থী হওয়ায় তালুকদার আবদুল খালেক বিভিন্ন সুবিধা পাচ্ছেন, যেগুলো বিএনপি প্রার্থী পাচ্ছেন না। আর নির্বাচনের সময় তো তিনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সকলেই একচেটিয়া সহযোগিতা পাবেন।
সোনাডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের কাছেই ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধার চায়ের দোকান। সেখানে বসতেই শোনা যায় নির্বাচনী আলোচনা। এর মধ্যে দুই যুবক খুলনার রাজনীতির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, এবার তালুকদার আবদুল খালেকের বিজয় সুনিশ্চিত। কারণ হিসেবে তারা বলেন, বিএনপির ভোট এবার ভাগ হয়ে যাবে। একটি অংশ চলে যাবে জাতীয় পার্টির প্রার্থীর দিকে। এ ছাড়া বিএনপির কোনো কোনো নেতাকর্মী গোপনে এবং প্রকাশ্যে খালেকের পক্ষে কাজ করছেন বলে তারা জানান। তবে তাদের এই কথার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করেন নগরীর ১৮ নং ওয়ার্ডের একজন ভোটার আজাদ। তিনি বলেন, এটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় যে, বিএনপির ভোট জাতীয় পার্টিতে চলে যাবে। বরং জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের ভোট কাটার সম্ভাবনা রয়েছে। তা ছাড়া অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখন আওয়ামী লীগেই। বিএনপিতে এখনো কোনো মতবিরোধ তৈরী হয়নি। তবে তিনি এজন্য নজরুল ইসলাম মঞ্জুর ব্যক্তিত্বকে ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করেন। বলেন, বিএনপির অন্য যেকোনো প্রার্থীর তুলনায় মঞ্জু বিতর্কের ঊর্ধ্বে। একপর্যায়ে দুই যুবক ওঠে গেলে তিনি বলেন, হুমকি-ধমকি দিয়েও বিএনপিকে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন থেকে সরাতে পারবে না। সেক্ষেত্রে ভরাডুবির ভয়ে নির্বাচন স্থগিতও করতে পারে বলে তার ধারণা। তিনি বলেন, কিছুক্ষণ আগে শুনলাম গাজীপুর সিটি নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত খুলনার নির্বাচনেও এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কোন যুক্তিতে তিনি এমন ধারণা করছেন? জবাবে আজাদ বলেন, সরকারের কাছে বিভিন্ন সংস্থার জরিপ রয়েছে।