চ্যালেঞ্জে হেভিওয়েট মন্ত্রী-এমপিরা

Slider রাজনীতি

316073_148

সিলেট সদর আসন থেকে আর নির্বাচন না করার ব্যাপারে একাধিকবার ঘোষণা দিয়েও নির্বাচন করছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তবে এবার ওই আসনে প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহউদ্দিন সিরাজ। অর্থমন্ত্রী নির্বাচন না করলে তার ভাই ও জাতিসঙ্ঘের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি এম এ মোমেনও প্রার্থী হতে আগ্রহী। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রার্থী করা হতে পারে এমন আলোচনাও দলে আছে।

ঢাকা-১ (দোহার-নবাবগঞ্জ) আসনে গত নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সালমা ইসলামের কাছে হেরে যান আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান খান। জাতীয় পার্টির কাছে হেরে দলের ইমেজ নষ্ট করায় এবার আওয়ামী লীগ সভাপতির বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের কর্নধার সালমান এফ রহমান এখানে মনোনয়ন পাচ্ছেন বলে জোর আলোচনা আছে। তবে এখনো মাঠ ছাড়েননি আবদুল মান্নান খান।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে টানা দুইবারের এমপি ও বিশিষ্ট শিল্পপতি, গাজী গ্রুপের চেয়ারম্যান গোলাম দস্তগীর গাজীর আসনে এবার মনোনয়ন চান আরেক শিল্পপতি বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনবীর আকবর সোবহান। এ দুই ব্যবসায়ীর দ্বন্দ্বে সম্প্রতি রূপগঞ্জে গাজীর সমর্থক সুমন নামে স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক কর্মীও খুন হন।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা: দীপু মনির চাঁদপুর-৩ আসনে মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ করছেন দলের কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী। এই দুই নেতাকে নিয়ে কেন্দ্রীয় অন্য নেতারাও দুই ভাগে বিভক্ত। তবে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাঁদপুর সফরের পর ডা: দীপু মনির মনোনয়ন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্য দিকে সুজিত রায় নন্দীও প্রতিবেশী দেশসহ বিভিন্ন মাধ্যমে মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।

জানা গেছে, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এ রকম প্রায় ৮০ থেকে শতাধিক হেভিওয়েট প্রার্থী কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি রয়েছেন। মনোনয়ন পাওয়ার আগেই নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বীকে মোকাবেলা হচ্ছে এসব মন্ত্রী এমপি ও প্রভাবশালী নেতাদের। নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে মন্ত্রী-এমপিদের সাথে কেন্দ্রীয় ও তৃণমূল নেতাদের বহুমুখী দ্বন্দ্ব ক্রমেই বাড়ছে। এ নিয়ে মাঠপর্যায়ে দলে চরম অস্থিরতা রয়েছে। মাঝে মধ্যে তা সহিংতা ও খুনোখুনিতেও রূপ নেয়। তবে এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী নির্বাচনে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা।
দলীয় বিভিন্ন সূত্র বলছে, মাদারীপুরে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান এবং দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের দ্বন্দ্ব বেশ পুরনো। গত নির্বাচনে শাজাহান খানকে সদর আসনে রেখে বাহাউদ্দিনকে কালকিনিতে মনোনয়ন দেয়া হয়। পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারিতে বাদ পড়া সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন কালকিনি থেকে এর আগে তিনবার এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি এবারো তৎপর রয়েছেন। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করছেন।

চট্টগ্রাম-৯ আসনে মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি ও কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল মনোনয়ন চান। গত নির্বাচনে আসনটি জাতীয় পার্টির প্রার্থী জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবুলকে ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। তবে এবার নুরুল ইসলাম বিএসসি এবং মরহুম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে নওফেল মনোনয়ন পেতে বেশ তৎপর রয়েছেন।

ফরিদপুরের ভাঙ্গায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ মনোনয়ন পান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্য ও এমপি নূর ই আলম চৌধুরী লিটনের ভাই মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন ওই আসনে স্বতন্ত্র নির্বাচন করে জয়ী হন। এরপর থেকে দুই পরে মধ্যে বিরোধ চরমে। এবারো কাজী জাফর উল্যাহ মনোনয়ন পেলে নিক্সন আবারো স্বতন্ত্র প্রার্থী হবেন বলে আলোচনা আছে।
পাবনায় ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ ডিলুর সাথে তারই জামাতা ঈশ্বরদী পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম আজাদের বিবাদ তুঙ্গে। ভূমিমন্ত্রীর বয়স হয়েছে। উত্তরাধিকার কে হবেন এ নিয়ে মন্ত্রীর ছেলে ও জামাতার দ্বন্দ্ব সঙ্ঘাতে রূপ নিয়েছে একাধিকবার। মন্ত্রীর ছেলেকে কারাগারেও যেতে হয়েছে। এই বিবাদের জের মনোনয়নেও পড়তে পারে বলে মনে করছেন দলের নেতারা।

গাইবান্ধায় ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়ার আসনে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন মনোনয়নের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছেন। নিয়মিত সভা সমাবেশ করে যাচ্ছেন রিপন। এবার শেষ পর্যন্ত তিনি মনোনয়ন পাবেন বলে আশাবাদী।
শরীয়তপুর নড়িয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত আসনের বর্তমান এমপি সাবেক ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী দলে কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছেন। তার হয়ে ছেলে খালেদ শওকত রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তৎপর আছেন। তবে এ আসনে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম প্রার্থী হতে চান। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হকের ভাই উপজেলা চেয়ারম্যান ইসমাইল হক স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী। তিনিও মনোনয়ন চান। সম্প্রতি আইজিপির মেয়াদ শেষ হলে ইসমাইল হকের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে।

অন্য দিকে শরীয়তপুর সদরে বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক। কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ইকবাল হোসেন অপুও এ আসনে সক্রিয়। দলের প্রভাবশালী একটি অংশ অপুর প্রতি সহানুভূতিশীল।

নেত্রকোনার আটপাড়া ও কেন্দুয়া উপজেলা নিয়ে গঠিত আসনে আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল প্রার্থী হতে চান। এ আসনের বর্তমান এমপি ইফতেখার উদ্দিন তালুকদার। অসীম কুমার উকিলের স্ত্রী যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক অপু উকিলও দলে পরিচিত মুখ। নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, ২০০৮ সালে অসীম মনোনয়ন না পাওয়ায় তার স্ত্রীকে সংরতি মহিলা এমপি করা হয়। এবার তারা দুইজনেই নিয়মিত এলাকায় জনসংযোগ করছেন। নেতাকর্মীদের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়াতে প্রতি সপ্তাহে একাধিকবার এলাকায় যাচ্ছেন তারা। স্থানীয় নেতাকর্মীরাও এবার অসীম উকিলকে চান। সে জন্য এবার মনোনয়নের ব্যাপারে আশাবাদী বলে নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন অসীম উকিল।

নেত্রকোনার পূর্বধলা আসনের এমপি ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল এবার কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেনের চ্যালেঞ্জে রয়েছেন। দুই পরে মধ্যে টুকটাক সঙ্ঘাত লেগেই আছে। এবার মনোনয়নের ব্যাপারে আশাবাদী আহমদ হোসেন।
ঢাকা-১৩ আসনের এমপি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক এ আসনের সাবেক এমপি ও দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হাজী মকবুল হোসেনের চ্যালেঞ্জে রয়েছেন। এ ছাড়া এখানে দলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খানও মনোনয়নপ্রত্যাশী।

কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া) আসনে বর্তমান এমপি মো: সোহরাব উদ্দিন। তার বাইরে এ আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূর মোহাম্মদ। তিনি এলাকায় জনসংযোগও করছেন। এ ছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ আফজল, পাকুন্দিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামসহ আরো অনেক নেতা মনোনয়ন চান।

পিরোজপুর সদরে বর্তমান এমপি এ কে এম আউয়ালকে চ্যালেঞ্জে ফেলছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আইনবিষয়ক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম। এবার তিনি মনোনয়ন পাবেন বলে আশাবাদী।
নরসিংদীর রায়পুরা আসনে সাবেক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর আসনে এবার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য এ বি এম রিয়াজুল কবির কায়সার মনোনয়ন পেতে সক্রিয়। তবে রাজুর ভাই সালাহউদ্দিন আহমেদও দলীয় মনোনয়নপ্রত্যাশী।

চট্টগ্রাম লোহাগড়া ও সাতকানিয়ার একাংশ নিয়ে গঠিত আসনে বর্তমান এমপি আবু রেজা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন নদভীর আসনে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপপ্রচার সম্পাদক আমিনুল ইসলাম তৎপর আছেন।
ফেনী সদর আসনের বিতর্কিত এমপি নিজাম হাজারীর আসনে এবার মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় উপকমিটির সহসম্পাদক ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাইফুদ্দিন নাসিরসহ আরো কয়েকজন।

এ দিকে কেরানীগঞ্জের একাংশ, ঢাকার হাজারীবাগ ও সাভারের একাংশ নিয়ে ছিল খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের আসন। সীমানা পুনর্নির্ধারণের কারণে এ আসন আর থাকছে না। কেরানীগঞ্জের এমপি বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু এবং সাভারে রয়েছেন ডা: এনামুর রহমান। তাই এবার কামরুলের স্থান কোথায় হবে তা কেউ জানেন না।
আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো বলছে, বার্ধক্যজনিক কারণ এবং বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের মধ্যে ৭০-৮০ জন বাদ পড়তে পারেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে একাধিকবার এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। এ ছাড়া জোট-মহাজোটকে ছাড় দিতে গিয়েও কপাল পুড়তে পারে অনেকের।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন আওয়ামী লীগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ নির্বাচনে বিতর্কিতরা বাদ পড়বেন বলে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ইতোমধ্যেই সতর্ক করে দিয়েছেন। তবে এখন নেতৃত্ব ও পদের সাময়িক প্রতিযোগিতা থাকলেও শেষ পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনে দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তার পইে সবাই কাজ করবেন বলে আমরা মনে করি।
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, প্রতি আসনেই আওয়ামী লীগের ৫ থেকে ১০ জন যোগ্য প্রার্থী আছেন। তাদের নিয়ে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর জরিপ করা হচ্ছে। এসব রিপোর্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়মিত পর্যালোচনা করছেন। এর মাধ্যমে যোগ্য প্রার্থীকে বেছে নেয়া হবে। তবে কোনো অবস্থায়ই বিতর্কিত এমপি যারা দলের ইমেজ নষ্ট করেছেন তারা আর মনোনয়ন পাবেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *