ঢাকা:আসন্ন গাজীপুর ও খুলনা সিটি নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে থেকে সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছিল বিএনপি। ১৭ই এপ্রিল নির্বাচন কমিশনে সিইসিসহ কমিশনারদের সঙ্গে এক বৈঠকে সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের আনুষ্ঠানিক দাবি জানিয়েছিল বিএনপির একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল। কিন্তু বিএনপির সে দাবি পরিষ্কারভাবে নাকচ করে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। সিটি নির্বাচন উপলক্ষে গাজীপুর ও খুলনা দুই সিটির প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে গতকাল এক বৈঠকে কমিশনের এমন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন ইসি সচিব। তিনি বলেছেন, ‘স্থানীয় নির্বাচনে কোনোভাবেই সেনা মোতায়েন করা হবে না- এ সিদ্ধান্ত রয়েছে কমিশনের’। এর আগে ৮ই এপ্রিল একটি বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেছিলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করা উচিত।
তবে স্থানীয় নির্বাচনে সেনা মোতায়েন আমরা একেবারেই চাই না।’ নির্বাচন কমিশনের এমন সিদ্ধান্তের মধ্যে অশুভ উদ্দেশ্য দেখতে পাচ্ছেন বিএনপির সিনিয়র নেতাসহ দলটির মনোনয়ন পাওয়া দুই মেয়র প্রার্থী। তারা বলছেন, অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মতো এ দুই সিটি নির্বাচনে কারচুপির কৌশল আঁটছে সরকার। সেনা মোতায়েন করা হলে তাদের সে কৌশল বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী তাই উপেক্ষা করা হচ্ছে সেনা মোতায়েনে ভোটারদের দাবি। বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকারের কথাটি নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করেছে। তবে এ নির্বাচনে যেকোনো ধরনের নৈরাজ্য, কারচুপিসহ অনিয়মের দায়-দায়িত্ব কমিশনকেই নিতে হবে।
সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের গুরুত্ব বিবেচনা থেকে সরছে না বিএনপির সিনিয়র নেতারা।
কারচুপির কৌশল বাস্তবায়ন করতেই সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী ইসি সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করতে চাইছে না বলে মনে করেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও খুলনা সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর প্রধান সমন্বয়ক গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, সরকারের কথাটি কেবল নির্বাচন কমিশনের মুখ দিয়ে প্রকাশ করা হলো। সরকার যে খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল কেড়ে নিতে চায় তা বাস্তবায়ন করতেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার ভোট কারচুপির যে কৌশল আঁটছে তার সঙ্গে সেনাবাহিনীকে যুক্ত করলে তা সফল হবে না। কারণ সাধারণ প্রশাসনের প্রতি আস্থা না থাকলেও সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা অটুট। সেনাবাহিনীকে সন্ত্রাসীরা ভয় পায়, সেনাবাহিনী থাকলে ভোটাররা সাহস পায়। তাই দলীয় অবস্থান থেকে নয়, নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে জনগণের দাবির বিবেচনায় আমরা সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি করেছি। আমরা এখনো সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবিতে অটল আছি। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর প্রধান সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা যতটুকু জেনেছি নির্বাচন কমিশন সচিব বলেছেন- সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত আপাতত নেই। আমরা তো সেনা মোতায়েন চেয়েছি নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে।
এখনো অনেক সময় বাকি আছে। আমরা সুনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকবো। আশা করি, বাস্তবতা বিবেচনা করে নির্বাচনে গাজীপুর ও খুলনা সিটিতে সেনা মোতায়েন করবে ইসি। বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে দেশের জনগণ ও ভোটারদের প্রত্যাশা ছিল সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করবে নির্বাচন কমিশন। ইসি’র দায়িত্ব হচ্ছে, নির্বাচন অনুষ্ঠানে জনগণের মনোভাব, ইচ্ছা ও প্রত্যাশার প্রতি সম্মান দেখানো এবং তার প্রতিফলন ঘটানো। গণতান্ত্রিক পরিবেশে জনগণের পারসেপশনের ওপর ভিত্তি করেই তাদের সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা। এখন জনগণের ইচ্ছাকে উপেক্ষা করে অন্য কোনো শক্তির মাধ্যমে চালিত হয়ে যদি তারা সিদ্ধান্ত নেন তাহলে তার দায়ভারও ইসিকেই নিতে হবে। তাদের মনে রাখতে হবে, সিটি নির্বাচনে গভীর নিবিষ্ট মনোযোগ রেখেছে দেশের মানুষ। বাংলাদেশের মানুষ বোকা নয়, তাদের বোকা বানানোর সুযোগ নেই।
অশুভ উদ্দেশ্য থেকেই সরকার সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের ব্যাপারে নেতিবাচক বলে মনে করেন বিএনপি দলীয় দুই মেয়র প্রার্থী। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে বিএনপি দলীয় মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকার বলেন, নির্বাচন একটি দেশ ও জাতির গণতন্ত্রের সোপান। দেশের মানুষ যদি শান্তিপূর্ণভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে তাহলে দেশের গণতন্ত্র শক্তিশালী হয়। বাংলাদেশে নির্বাচনকালে একটি বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় আর সে ধরনের পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী মাঠে থাকলে ভোটাধিকার প্রয়োগে জনমনে সাহস সঞ্চার হয়। মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে নির্বাচনের মাঠে রাখলে সমস্যা কোথায়? সেনাবাহিনীকে দুর্যোগসহ সব কাজে ব্যবহার করতে পারলে নির্বাচনী পরিবেশ রক্ষায় কেন তাদের ব্যবহার করা যাবে না?
হাসান সরকার বলেন, নির্বাচন কমিশনের এমন সিদ্ধান্তের পেছনে নিশ্চয়ই বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। সে উদ্দেশ্য নিশ্চিতভাবে জনগণের জন্য কল্যাণকর নয়। খুলনা সিটি নির্বাচনে বিএনপি দলীয় মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, জনগণ মনে করে নির্বাচনে সন্ত্রাস হতে পারে। বর্তমান সরকারের আমলে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে যে নৈরাজ্য করেছে, যেভাবে ফল ছিনিয়ে নিয়েছে সেটা মানুষের স্মৃতিতে গেঁথে আছে। সে অভিজ্ঞতার আলোকে জনগণ সিটি নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের দাবি করেছে। আমরা মনে করি, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে, ভোটারদের মধ্যে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে ভয়-ভীতি কাটিয়ে উৎসাহ সৃষ্টিতে সেনা মোতায়েনের বিকল্প নেই। কিন্তু সিটি নির্বাচনে সরকার ভিন্ন উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে চায় বলেই সেনা মোতায়েনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। মঞ্জু বলেন, কয়েকদিন ধরে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিরা খুলনায় এসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন। এতে আমাদের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে নির্বাচনে সরকার দলীয়রা ভোট ছিনিয়ে নিতে পারে। মানুষের এ আশঙ্কা দূর করতে, ভোট নিশ্চিত ও নিরাপদ করতে সেনা মোতায়েন অত্যন্ত প্রয়োজন। সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনী পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে কঠোর হতে হবে।
বিএনপির সিনিয়র নেতা ও প্রার্থীদের মতো তাদের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়করাও নির্বাচনে সেনা মোতায়েনের পক্ষে জোর দাবি জানিয়েছেন। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও গাজীপুর সিটি নির্বাচনে দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ফজলুল হক মিলন বলেন, জনগণের রায় সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগের স্বার্থে এবং বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমরা সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছি। আমরা আশা করেছিলাম, জনমতের প্রতি সম্মান দেখিয়ে নির্বাচন কমিশন এ যৌক্তিক দাবিটি আমলে নেবে। কিন্তু তারা সেনা মোতায়েন করবে না বলে জানিয়েছে। আমরা মনে করি, নির্বাচন কমিশনের এ সিদ্ধান্ত সঠিক হয়নি। মিলন বলেন, ইসি’র এমন সিদ্ধান্তে আমাদের মধ্যে আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ভোটারদের মধ্যেও নানামুখী আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তারপরও আমরা আবেদন জানাবো, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে যা যা করণীয় ইসি ও প্রশাসন তার উদ্যোগ নেবে।
খুলনা মহানগর বিএনপির সিনিয়র সহ-সভাপতি ও খুলনা সিটি নির্বাচনে দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক শাহারুজ্জামান মর্তুজা বলেন, আসন্ন দুই সিটি নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু না হয় প্রতিমুহূর্তে সে চিন্তাই করছে সরকার। বর্তমান সরকারের আমলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে তারা যেভাবে কারচুপি ও জালিয়াতি করেছিল এ নির্বাচনেও তারা সেটা অব্যাহত রাখতে চায়। আমাদের পরিষ্কার আশঙ্কা, আসন্ন দুই সিটি নির্বাচনেও ভোট কারচুপি করতে চায় সরকার। আর সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যাতে বিঘ্ন না ঘটে সে জন্য সেনাবাহিনী দিতে চায় না তারা। কারণ সেনাবাহিনী থাকলে দুষ্ট লোকেরা মাঠে থাকে না, সাধারণ মানুষ ভোটদানে উৎসাহী হয়। গাজীপুর সিটি নির্বাচনে ২০দলীয় জোটের সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব ও এলডিপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, সেনাবাহিনীর প্রতি এ দেশের মানুষ আস্থা উঁচুস্তরের।
বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনী ইতিহাস বিবেচনায় সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাই দেশের মানুষের প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দিয়ে সিটি নির্বাচনে আমরা সেনা মোতায়েন চেয়েছি। ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর বিকল্প নেই। সেনাবাহিনী তো সুষ্ঠু নির্বাচনের অন্তরায় নয়। তাহলে তাদের মোতায়েনে সরকারের অনীহা কেন? সেলিম বলেন, সেনাবাহিনী নির্বাচনের মাঠে থাকলে জনগণ নিঃশঙ্ক চিত্তে ভোট দিতে পারবে আর সেখানেই সরকারের শঙ্কা। জনমত সরকারের বিরুদ্ধে চলে গেছে তাই তারা ভোটকেন্দ্রে নৈরাজ্য, ভোটদানে বাধা ও ফল পাল্টানোর অশুভ উদ্দেশ্যেই সেনা মোতায়েন করতে চাইছে না।