স্বজনহারাদের কান্না থামছে না। উল্টো যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন মুখ। সন্তানের জন্য মা-বাবার কান্না, স্বামীর জন্য স্ত্রীর কান্না, ভাইয়ের জন্য বোনের কান্না, বাবার জন্য সন্তানের কান্না। অনেকে কান্নারও ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। সন্তানের পথের দিকে তাকিয়ে থেকে অনেকেই ইতিমধ্যে মারা গেছেন। অনেকে হয়েছেন শয্যাশায়ী।
শনিবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত গণশুনানিতে গুম হওয়া মানুষগুলোর পরিবারের সদস্যরা এভাবেই তাদের কষ্টের কথা তুলে ধরলেন। শনিবারের এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন অন্তত অর্ধশত পরিবার। তাদের হাতে ছিলো নিখোঁজ ব্যক্তিদের ছবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড, অনেকের হাতে শুধুই ছবি। নিখোঁজ নুরুল আলম নুরুর ছবি দেখিয়ে তার ছোট্ট বাচ্চা বারবার বলছিলো বাবা, বাবা। নুরাজের মতো অনেকের কাছে বাবা এখন শুধু ছবির মধ্যে। পারভেজের ছোট মেয়ে হৃদিও ছবির মধ্যেই কেবল তার বাবাকে খুঁজে পায়।
গুম হওয়া মানুষদের পরিবারদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এর দেয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনে আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৭২৭ জন। এদের মধ্যে কেউ কেউ ফিরে এলেও অধিকাংশই নিখোঁজ। তাদের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত ২৫ বার সংবাদ সম্মেলন করা হয়েছে। এখন তারা অন্তত লাশটি ফেরত চান।
গণশুনানীতে স্বজনহারা মানুষগুলো বক্তব্য রাখেন। সেখানে ভৈরব থেকে নিখোঁজ শাহিনুর আলমের ছোট ভাই মেহেদি হাসান বলেন, ‘আমার ভাইয়ের নামে কোনও মামলা ছিল না। সে কোনও রাজনীতি করতো না। ২০১৪ সালের ২৯ এপ্রিল র্যাব-১৪ ভৈরব ক্যাম্পের সদস্যরা এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়। আমরা সব জায়গায় খুঁজেও তাকে পাইনি।
সাতদিন পর জানতে পারি আমার ভাইয়ের লাশ পাওয়া গেছে। পরে আমরা বিচারের আশায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে একটি মামলা দায়ের করি। ম্যাজিস্ট্রেট নাজমুন নাহারের মামলা আমলে নেন। কিন্তু সেই মামলা এখনও ঝুলে আছে। কোনও শুনানি হয়নি।’
গুম হওয়া মুন্নার বাবা নিজাম উদ্দিনের শেষ আকুতি ছিল তার ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে না পারলেও অন্তত কবরটা দেখিয়ে দেওয়ার। নিজাম উদ্দিন বেঁচে নেই। সন্তানের অপেক্ষায় থেকে মারা গেছেন মুন্নার মা, সূত্রাপুরের পারভেজ হাসানের বাবা এবং শ্বশুর।
চট্টগ্রামের নুরুর স্ত্রীর দাবি তার চোখের সামনেই পুলিশ পরিচয়ে তার স্বামীকে তুলে নেয়া হয়। বাসায় এসে কলিংবেল চেপে পুলিশ পরিচয় দেওয়ায় তিনি গেট খুলে দেন। খালি গায়েই তার স্বামীকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যায় তারা। ভোর ৪টায় খবর আসে তার লাশ পাওয়া গেছে কর্ণফুলী নদীর পাড়ে। তার মাথায় দুটি গুলি করা হয়েছে। ৩ মাসের বাচ্চা রেখে গেছে সে। সেই বাচ্চা বড় হয়ে গেছে এখন। বাবা বলে কিছু নাই তার।
ফরিদপুরের মঞ্জুরুল মওলা। মাদ্রাসায় পড়ালেখা করতেন তিনি। ২০১৫ সালে তাকে তুলে নেয়া হয়। এরপর ২ দিন থানায় রাখা হয়। থানা থেকে দ্বিতীয় দিন রাতে নির্জন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মাথায় অস্ত্র ঠেকানো হয়। এরপর তিনি যে সেখান থেকে কীভাবে জীবিত ফেরত এসেছেন সেই কথা মনে পড়লে আজও ভয়ে থাকেন।
একইভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় সিলেটের বদরুল আলমকে।
২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় কয়েকটি গাড়ি তার গতিরোধ করে তুলে নিয়ে যায়। তার নামে কোনও মামলা ছিল না। তিনি বলেন, ‘আমাকে তুলে নিয়ে বলা হয়েছিল রাইফেলের বাট দিয়ে পা ভেঙে দিবো, তোকে মেরে ফেলবো। তাদের অত্যাচারে ২১ দিন আমি হাসপাতালে ছিলাম চিকিৎসাধীন। সেখান থেকে আমাকে কারাগারে পাঠানো হয়। তারপর আমার নামে ১১টি মামলা দেওয়া হয়।’
রেহানা আজাদ মুন্নির ভাই পিন্টুকে সাদা পোশাকধারীরা নিয়ে যায়। ডিবি, র্যাব সব জায়গায় খোঁজ নেওয়ার পরও কোথাও পিন্টুকে খুজে পাওয়া যায়নি। তার মা পাগল হয়ে গেছেন। মুন্নির জিজ্ঞাসা সরকারের কাছে, ‘আপনাদের কি কোন দায় নেই? এভাবে বেঁচে থাকা যায়?’ গুম হওয়া ছাত্রদল নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন সানজিদা বলেন, ‘আমার ভাইকে র্যাব-১ এর গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়।
তাকে ফেরত পাওয়ার আশায় আজ পর্যন্ত ২৫ বার প্রেস কনফারেন্স করেছি। শুধু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতায় আমাদের ভাইকে খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কোনও সংস্থা দেশের কোনও নাগরিককে এভাবে গুম করতে পারে না। গুম করার পর তাদের কী রকম টর্চার সেলে রাখা হয় আমি জানি না। সে বেঁচে আছে নাকি তাও জানি না। আমার ভাইয়ের দোষ ছিল সে বিএনপি করতো। পুলিশ আমাদের কোনও মামলা নেয়নি। কোর্টে রিট করেছি, কোনও অগ্রগতি নেই। যতক্ষণ তারা ফিরে না আসে আমরা রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যাবো।’
২০১০ সালের ২৫ জুন রাজধানীর ফার্মগেটের ইন্দিরা রোড থেকে অপহৃত হন বিএনপি নেতা ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড সাবেক কমিশনার চৌধুরী আলম। আজো তার খোঁজ নেই। এভাবে ৮-১০ বছর নিখোঁজ রয়েছেন তাদেরও অনেক স্বজন হাজির হয়েছিলেন ‘মায়ের ডাকে’। স্বজনহারাদের এই কান্নায় যোগ হচ্ছে নিত্য নতুন মুখ।