সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সাত বছর পার হলেও যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবেলা করে এখনো ক্ষমতায় টিকে আছেন প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ। সারা দেশে নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে শনিবারের পশ্চিমা হামলা একটি বড় আঘাত তার জন্য। তথাপি পশ্চিমারা বাশারকে হঠাতে চায় তেমন কোন দৃঢ় মানসিকতা দেখা যাচ্ছে না।
গৃহযুদ্ধের প্রথম দিকে বিদ্রোহীরা যখন ক্রমশ তার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে একটির পর একটি এলাকা দখল করে নিচ্ছিল, তখন ক্ষমতাচ্যুত আরব শাসকদের তালিকায় বাশারের নামটিও উঠবে বলেই মনে হচ্ছিল; কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সিরিয়ার বিদ্রোহীরাই আজ পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে। রাজধানী দামেস্কর পাশ্ববর্তী পূর্ব গৌতা ও উত্তরাঞ্চলীয় নগরী আলেপ্পোর মত বড় দুটি ঘাঁটি হাতছাড়া হয়েছে তাদের। বাশারের এই ক্ষমতায় টিকে থাকা ও ক্রমশ অবস্থার জোরদার করার পেছনে রয়েছে কয়েকটি কারণ
১.বিদেশী সমর্থন
২০১২ সালে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে এক বোমা বিস্ফোরণে নিহত হয় বাশার সরকারের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও বাশারের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আসিফ শওকত। ওই সময় বিদ্রোহীদের অবস্থান খুবই জোরালো ছিলো। তার ওপর প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে হত্যা করে বিদ্রোহীরা ভেবেছিলো তারা জয়ের দ্বারপ্রান্তে। বিদ্রোহী গ্রুপ ফ্রি সিরিয়ান আর্মির কমান্ডার বাশার আল জোউবি বলেছিলেন, সিরীয় সেনাবাহিনী ধ্বংস হয়ে গেছে। তবে এরপরই এই যুদ্ধে হ্স্তক্ষেপ করে ইরান।
তারা বাশার সরকারের বাহিনীকে উন্নত প্রশিক্ষণ দেয়, অভিজ্ঞ সেনা বিশেষজ্ঞদের পাঠায় যুদ্ধের কলাকৌশল নিয়ে কাজ করতে এবং আরো পাঠায় শিয়া মিলিশিয়া বাহিনীর প্রচুর সশস্ত্র যোদ্ধা। ইরানের প্রশিক্ষিত ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স নামের মিলিশিয়া বাহিনীই মূলত যুদ্ধের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়। এই বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ৯০ হাজার।
আঞ্চলিক রাজনীতিতে ইরানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একজন মিত্র বাশার আল আসাদ। তবে ইরানের সরাসরি যোদ্ধা প্রেরণের চেয়েও বাশার সরকারের জন্য বড় সাহায্যটি এসেছিলো রাশিয়ার পক্ষ থেকে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে সিরিয়ার বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা শুরু করে রাশিয়া। রুশ বিমান হামলার সহায়তা নিয়েই আলেপ্পো, গৌতার মত শক্ত অবস্থানগুলো থেকে বিদ্রোহীদের বিতাড়িত করে সেনাবাহিনী।
২.বিদ্রোহীদের অন্তর্কোন্দল
বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর অন্তর্কোন্দলেরও সুবিধা পেয়েছেন বাশার। বিশেষ করে ফ্রি সিরিয়ান আর্মি নামের গ্রুপটি প্রায়ই অন্যদের সাথে বিরোধে লিপ্ত হয়েছে। বিদ্রোহীরা মাঝে মধ্যেই আইএসের সাথে সমঝোতা করেছে; যদিও অল্পদিন পরেই আবার গোষ্ঠিটির সাথে লড়াই করতে হয়েছে তাদের। যা তাদের সরকার বিরোধী যুদ্ধে পিছিয়ে দিয়েছে।
বিদ্রোহীরা যখন আইএসের কাছ থেকে বেশ কিছু এলাকা উদ্ধার করেছে, অন্যদিকে বিদ্রোহীদের এলাকা তখন দখল করেছে কুর্দি যোদ্ধারা কিংবা সরকারি বাহিনী। শুধু আইএস নয়, বর্তমানে বিদ্রোহীদের মধ্যে কয়েক ডজন গ্রুপ রয়েছে যারা বিভিন্ন আঞ্চলিক, জাতীগত, রাজনৈতিক ইস্যুতে বিভক্ত।
৩.আন্তর্জাতিক অবস্থান
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো ছাড়াও তুরস্ক, সৌদি আরবের মতো অনেক দেশ বাশার সরকারের নির্যাতন-নীপিড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলো। তবে বাশারকে ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য কার্যকর কোন পদক্ষেপ তারা নেয়নি। বিদ্রোহীদের আহ্বানের পরও সিরিয়ায় সর্বাত্মক সামরিক অভিযান চালায়নি যুক্তরাষ্ট্র। অথচ লিবিয়ার শাসক মুয়াম্মার আল গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তারা কোন কিছুই বাদ রাখেনি। যেসব অস্ত্র বিদ্রোহীদের হাতে এসেছে তা সরকারের বিমান হামলার জবাব দেয়ার জন্য যথেষ্ট নয় বলেও জানিয়েছেন বিদ্রোহী নেতারা। তাছাড়া আইএসের হাতে পড়তে পারে এই আশঙ্কায় অস্ত্রের সরবরাহও বিভিন্নভাবে সীমিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
যুদ্ধের মাঝে পশ্চিমা নেতারা বাশারকে সরানোর বিষয়েও ভিন্নমত পোষণ করেছেন কখনো। ২০১৭ সালের মার্চে জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি বলেছেন, বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করা যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান উদ্দেশ্য নয়। মাত্র দুই মাস আগেও ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, শান্তি চুক্তির অধীনে বাশারের ক্ষমতায় থাকতে কোন সমস্যা নেই।
৪.অভ্যন্তরীণ সমর্থন
দেশ জুড়ে বাশারের শাসনের বিরুদ্ধে মানুষ ফুঁসে উঠলেও কিছু ক্ষেত্রে, বা কিছু অংশের সমর্থন ছিলো তার প্রতি। বিশেষ করে তার ধর্মীয় আলভি সম্প্রদায়(শিয়াদের একটি গ্রুপ) তার প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। বাশারের যুগে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন এমন অনেক সুন্নী নেতাও শাসক পরিবর্তনের বিষয়ে ততটা আন্তরিক ছিলেন না।