Slider চট্টগ্রাম

310033_125

বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে প্রথমে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) নিতে হবে। পরে আবেদনের পরিপ্রেেিত তাদের নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। গত বুধবার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে যাওয়া মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ড. উইন মিয়াত আয়ের এমন প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছেন রোহিঙ্গারা। একই সাথে তারা তাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার দাবি জানান।

বৈঠকে কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের মন্ত্রীকে ১৩ দফা দাবিসংবলিত একটি আবেদনপত্র দেন। যার মধ্যে ছিল নাগরিকত্ব প্রদান, সিত্তে ও রাখাইনের অন্য জায়গার যেসব রোহিঙ্গা বাস্তচ্যুত হয়ে ক্যাম্পে অবস্থান করছেন সেসব ক্যাম্প বন্ধ করা, রোহিঙ্গাদের নিরাপদে থাকার জন্য রাখাইনে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান নিশ্চিত করা, ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড প্রথা বাতিল, জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী সংস্থার মাধ্যমে প্রত্যাবাসন, রোহিঙ্গা নির্যাতনে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি, রোহিঙ্গাদের ধ্বংস করা সম্পত্তির তিপূরণ প্রদান, তাদের আদি নিবাসে ফেরত যাওয়ার অধিকার এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়া, মানবাধিকার সংস্থাগুলোর রাখাইনে অবাধ প্রবেশের সুযোগ দেয়া।

রোহিঙ্গাদের এসব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমারের মন্ত্রী জানিয়েছেন, মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে আপনাদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে। তবে সরকারের কাছে আবেদন করতে হবে। তবেই কেবল ন্যাশনাল কার্ড দেয়া হবে। তিনি আরও বলেন, রাখাইনে এখন শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। আপনাদের ফিরতে কোনো সমস্যা হবে না। দেশে এখন নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আপনারা এখন নিশ্চিতভাবে থাকতে পারবেন।

মিয়ানমারের মন্ত্রী বুধবার সকালে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পৌঁছে রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদের সাথে কথা বলেন। এ সময় তিনি রোহিঙ্গাদের ‘বাঙালি’ হিসেবে চিহ্নিত করে রাখাইনে ফিরিয়ে নেয়ার কথা বলেন। ‘বাঙালি’ বলায় রোহিঙ্গারা বিুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা বলেন, আমরা বাঙালি নই, রোহিঙ্গা পরিচয়ে মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাই। রোহিঙ্গাদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, নাগরিকত্ব পেলে আপনাদের সহায় সম্পদ জমিজমা ফেরত দেয়া হবে।

ত্রাণ ও শরণার্থী পুনর্বাসন কমিশনার আবুল কালাম জানিয়েছেন, মিয়ানমারের মন্ত্রীর ‘এনভিসি পরিকল্পনা’ প্রত্যাখ্যান করেছেন রোহিঙ্গারা। প্রত্যাবাসনের আগে তারা বিভিন্ন দাবি পেশ করেছেন। এর মধ্যে নাগরিক অধিকার অন্যতম। কুতুপালং ক্যাম্পে সাত মাস ধরে আশ্রিত আব্দুর রহমান বলেন, আমরা নাগরিক অধিকার চাই। ক্যাম্পের মো: সালাম নামে এক বাসিন্দা বলেন, আমরা আমাদের ভূ-সম্পত্তি, ঘরবাড়ি, সম্পদ হারিয়েছি। প্রত্যাবাসনের আগে সেসব ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তা চাই।

এ দিকে সাড়ে তিন বছর আগের প্রায় আড়াই হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মিয়ানমার। বাংলাদেশের প থেকে অনেকবার তাগিদ দেয়ার পরও তারা সেই প্রতিশ্রুতি রাখেনি। ২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট ঢাকায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের অষ্টম বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে বাংলাদেশ থেকে দুই হাজার ৪১৫ জন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল মিয়ানমার। তখন উভয় দেশের প থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল দুই মাসের মধ্যেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। কিন্তু পরে মিয়ানমার কর্তৃপ আর কোনো সাড়া দেয়নি।

২০১২ সালে রাখাইনে জাতিগত দাঙ্গা এবং ২০১৬ সালের অক্টোবর ও ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বর্বরোচিত নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে এ সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এ কারণে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। গত বছর ২৩ নভেম্বর দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা অনুযায়ী গত ২৩ জানুয়ারি থেকে প্রত্যাবাসন কার্যক্রম শুরুর কথা থাকলেও তা এখনো শুরু হয়নি।

মিয়ানমারের রাখাইন থেকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রথমবার পালিয়ে আসে ১৯৭৮ সালে। তখন তাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি স্বার হয়। এর অধীনে ছয় মাসেরও কম সময়ের মধ্যে প্রায় দুই লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ফিরে যান। এরপর ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন আড়াই লাখের বেশি রোহিঙ্গা। ওই সময় তাদের দেশে ফেরত পাঠাতে আরেকটি সমঝোতা হয়। এর অধীনে ১৯৯৩ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দুই লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা ফিরে যান মিয়ানমারে।

কিন্তু ২০১৬ সালের অক্টোবর ও ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বর্বরোচিত নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য ফরম পূরণে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ঠিকানায় গ্রাম, ডাকঘর ও থানার নামে রোহিঙ্গাদের ভাষা ও বার্মিজ ভায়ার মধ্যে মিল না থাকায় এ জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে।

রোহিঙ্গাদের সূত্র জানায়, তাদের গ্রামের নামগুলো মিয়ানমারের অফিসিয়াল নামের সাথে মিল নেই। উদাহরণস্বরূপ রোহিঙ্গারা যে গ্রামকে থাইম্মাহালি বলেন, সেই গ্রামের নাম মিয়ানমারে সরকারি দফতরে থাম্মিংসং নামে উল্লেখ করা হয়েছে। একইভাবে জাইল্যাপাড়া, কাওয়ারবিল, নাগপুড়া, তুম্ব্রু, লাবাদক, চৌপ্রাং, সিকদার পাড়া এ জাতীয় রোহিঙ্গা সৃষ্ট নামগুলোর ভিন্ন বার্মিজ নামও রয়েছে। ফলে রোহিঙ্গাদের ঠিকানাগত নামে মিল না থাকলে মিয়ানমার কর্তৃপ অনাপত্তিপত্র দিচ্ছে না।

পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মতে, মিয়ানমারের কাছে দেয়া ভেরিফিকেশন ফরম সঠিকভাবে পূরণ না করা হলে অথবা ফরমে কোনো ভুল তথ্য থাকলে এমনকি বানান ভুল হলেও তাদের গ্রহণ করতে রাজি হবে না মিয়ানমার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *