একটি পরকীয়া। ভেঙে চুরমার দুটি সাজানো সংসার। স্ত্রী স্নিগ্ধা ও তার প্রেমিক কামরুল মিলে অ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিককে খুনের ঘটনায় বিস্মিত-হতবাক রংপুরের মানুষ। সর্বত্র ক্ষোভ-ধিক্কার। দু’ জন দু’ ধর্মের। পরিবার-সন্তান রয়েছে দু’ জনেরই। তবুও তাদের এই প্রেম-পরকীয়ার ঘটনার চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। হত্যাকাণ্ডের সব নেপথ্য নতুন নতুন তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
জঙ্গি হামলায় নিহত জাপানি নাগরিক হোসি কুনিও এবং মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলায় সরকার
পক্ষের প্রধান আইনজীবী ছিলেন পিপি রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা। হঠাৎ করে দক্ষ এই আইনজীবীর নিখোঁজ হওয়ার খবরে বেশ কিছু বিষয় মাথায় রেখে তদন্তে নামেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। নিখোঁজ বা গুমের ঘটনার নেপথ্যে জঙ্গি ও জামায়াত-শিবিরের কানেকশনসহ মন্দিরের জমি সংক্রান্ত বিরোধ থাকতে পারে কি না, তা নিয়ে মিডিয়াতে উত্তাপ থাকলেও পুলিশ শুরু থেকেই গুরুত্ব দিয়েছে পরকীয়ার বিষয়টি। যদিও ঘটনার ষষ্ঠ দিন নেপথ্যের ঘটনা দেশবাসীকে জানাতে সক্ষম হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
তারা প্রথমেই রথীশ চন্দ্রের স্ত্রী তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা দীপা ভৌমিক স্নিগ্ধা ও তার কথিত প্রেমিক একই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামরুল ইসলাম জাফরীর মোবাইল ফোনের কললিস্ট বের করেন। পরকীয়া নামক এই শব্দটির নিবিড় সংখ্যতা গড়ানোর কললিস্ট দেখে চমকে ওঠে পুলিশ। প্রতিদিন ‘প্রেমিক-প্রেমিকা’ জুটি ৩০ থেকে ৩৫ বার মোবাইলে কথা বলতেন। ওই কললিস্ট দেখে সন্দেহের তীর যায় কামরুলের দিকে। পুলিশ আর সময় না নিয়ে নগরীর রাধাবল্লভের বাড়ি থেকে প্রথমে গ্রেফতার করে দীপার প্রেমিক কামরুল ইসলামকে। তাকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে সাজানো নিখোঁজ নাটকের অন্তরালে ঘটানো হত্যাকাণ্ডের নানা তথ্য।
এরপর র্যাব তাজহাট বাবুপাড়ার বাড়ি থেকে দীপা ভৌমিককে গ্রেফতার করে। তাদের দেয়া তথ্য পেয়ে র্যাব মঙ্গলবার দিবাগত রাত সোয়া ১টার দিকে রথীশের বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে মোল্লাপাড়ায় কামরুলের বড় ভাই খাদেমুল ইসলাম জাফরীর নির্মাণাধীন বাড়ির মেঝেতে গর্ত করে মাটি চাপা দেয়া রথীশের লাশ উদ্ধার করে। এর আগে কামরুল ইসলাম মিথ্যা তথ্য দেয়ায় পুলিশ রথীশের সোনার বাড়ির পিছনের একটি পরিত্যক্ত ডোবার পানি নিষ্কাশন ও পরিষ্কার করে। কিন্তু সেখান থেকে একটি ময়লা শার্ট ছাড়া কিছুই উদ্ধার হয়নি। ওইদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পুলিশকে তথ্য বিভ্রাটে ফেলে হয়রানি করান দীপা ভৌমিকের চতুর প্রেমিক কামরুল ইসলাম।
এদিকে, রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনাকে হত্যার প্রধান আসামি কামরুল ইসলামকে ১০ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে এমন অনেক তথ্য বেরিয়ে আসছে বলে দাবি পুলিশের। তবে তদন্তের স্বার্থে এসব তথ্যের অনেক কিছুই সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করা হচ্ছে না বলে জানিয়েছে পুলিশ। কামরুল ইসলামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তিনিই হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন। এ ব্যাপারে দীপা ভৌমিক ও তাদের দুই স্কুলছাত্র রোকন ও সবুজ পুলিশের কাছে ১৬১ ধারায় এবং আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। পুলিশের একটি বিশ্বস্ত সূত্র এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
পুলিশ জানায়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঘটতে থাকা ব্যক্তিগত নানা বিষয় প্রেমিক কামরুলকে জানাতেন দীপা। কামরুলও সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশতে থাকেন। মূলত দুই বছর ধরে তারা পরকীয়া শুরু করেন। এরপর কামরুল দীপাকে ধর্মান্তরিত হওয়ার এবং বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু তা নাকচ করে পরকীয়া চালিয়ে যান দীপা ভৌমিক। রংপুর কোতয়ালী থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবুল মিঞা বলেন, নিহত রথীশ চন্দ্র ভৌমিকের স্ত্রী দীপা ভৌমিক, তার প্রেমিক কামরুল ইসলাম, রথীশ চন্দ্রের গাড়িচালক মদন কুমার মিলন মোহন্ত এবং দুই ছাত্র রোকন ও সবুজকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মামলাটির তদন্ত শেষে দ্রুত আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে বলে তিনি জানান।
র্যাব ও পুলিশ জানায়, জাপানি নাগরিক হত্যা ও মাজারের খাদেম হত্যা মামলার পিপি ছিলেন রথীশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা। গত ৩০ মার্চ বাবু সোনার পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিলো বাবু সোনা নিখোঁজ হয়েছেন। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। এরপর বিভিন্ন সংগঠন নিখোঁজ রথীশ চন্দ্র বাবু সোনাকে উদ্ধারে মানববন্ধন, সমাবেশ, অনশনসহ নানা কর্মসূচি পালন করে। এসব কর্মসূচিতেও সরব উপস্থিতি ছিল দীপা ভৌমিকের চতুর প্রেমিক কামরুল ইসলামের। এদিকে, আন্দোলন জোরালো হবার আগেই কোমর বেঁধে মাঠে নামেন র্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। অবশেষে তারা মোবাইল ফোনের কললিস্টের সূত্র ধরে ‘পরকীয়ার’ বলি রথীশের লাশ উদ্ধারে সক্ষম হন।
বর্তমানে পিপি রথীশ চন্দ্র হত্যা মামলায় স্ত্রী দীপা ভৌমিকসহ চারজন কারাগারে রয়েছেন। প্রেমিক কামরুলের চলছে ১০ দিনের রিমান্ডের ৪র্থ দিন আজ।