একটি পরকীয়া। ভেঙে চুরমার দুটি সাজানো সংসার। স্ত্রী স্নিগ্ধা ও তার প্রেমিক কামরুল মিলে অ্যাডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিককে খুনের ঘটনায় বিস্মিত-হতবাক রংপুরের মানুষ। সর্বত্র ক্ষোভ-ধিক্কার। দু’ জন দু’ ধর্মের। পরিবার-সন্তান রয়েছে দু’ জনেরই। তবুও তাদের এই প্রেম-পরকীয়ার ঘটনার চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। হত্যাকাণ্ডের সব নেপথ্য নতুন নতুন তথ্য পেয়েছে পুলিশ। চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল রথিশ চন্দ্রের স্ত্রী দীপা ভৌমিকের প্রেমিক কামরুল ইসলাম। তার পরিকল্পনাতেই ২৯ মার্চ রাত সাড়ে দশটার দিকে হাত-পা বেঁধে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে হত্যা করা হয় আইনজীবী রথিশকে।
পুলিশ সূত্রে, জেএমবির হামলায় নিহত জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি ও মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলার সরকার পক্ষের প্রধান আইনজীবী ছিলেন রথিশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা। তাকে খুন করলে সবাই ভাববে জঙ্গিরাই তাকে মেরে ফেলেছে। এই ভাবনা থেকেই তাকে হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছেন তার স্ত্রী দীপা ভৌমিক। বৃহস্পতিবার রাতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব কথা বলেছেন তিনি। এদিন রাত দেড়টা পর্যন্ত রংপুরের অতিরিক্ত চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আরিফা ইয়াসমিন মুক্তার খাস কামরায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন দীপা।
কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পেছনের গেট দিয়ে দীপা ভৌমিক, কামরুল ইসলাম এবং দুই সহযোগী রোকন ও সবুজকে আদালতে নেয়া হয়।
দাম্পত্য জীবনে পারস্পরিক অবিশ্বাস, পারিবারিক অশান্তি, অবজ্ঞা, একাধিক নারীর সঙ্গে পরকীয়ার সম্পর্ক থাকাসহ নানা কারণে স্বামী রথিশকে হত্যা করেছেন বলে ১২ পৃষ্ঠার জবানবন্দিতে উল্লেখ করেন দীপা।
পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্রে, দীপা জবানবন্দিতে জানান- ২৫ বছরের বিবাহিত জীবনে তাদের দাম্পত্য জীবন কখনোই সুখের হয়নি। তার স্বামী পরকীয়ার সম্পর্ক থাকায় তাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। তাকে অবজ্ঞা-অসম্মান করত। শুধু তাই নয়, তার সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক ছিল খুবই অশান্তিপূর্ণ। কেউ পরস্পরকে বিশ্বাস করতেন না। তাকে অবিশ্বাস করার জন্য তিনিও স্বামীর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেননি। এর মধ্যে সহকর্মী তাজহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক কামরুল ইসলামের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
ওই সূত্র আরো জানান, প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি জেনে যাওয়ায় স্বামীর সঙ্গে তার কয়েক দফা ঝগড়া হয়। তখনই সিদ্ধান্ত নেন কামরুলকে তিনি বিয়ে করবেন। কিন্তু পথের কাঁটা হিসেবে স্বামী রথিশকে সরাতে হবে ভেবে দু’জন মিলে দুই মাস আগে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। হত্যার পর কিভাবে লাশ গুম করা হবে সে সিদ্ধান্তও নেয়া হয়।
রথিশ জেএমবির হাতে নিহত কুনিও হোশি ও মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলার সরকার পক্ষের প্রধান আইনজীবী ছিলেন। ওই দুই মামলায় জঙ্গিদের যেহেতু ফাঁসির আদেশ হয়, তাই পরিকল্পনা ছিল রথিশকে হত্যা করে বিষয়টি জঙ্গিরা করেছে বলে প্রচার করার। এটা ভেবেই তাকে হত্যা করা হয়।
পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দীপা ও কামরুল তাদের দুই ছাত্রকে লাশ গুমের জন্য মাটি খুঁড়ে গর্ত করা ও লাশ মাটিচাপা দেয়ার কাজে ব্যবহার করেছিল। এ জন্য তাদের ৩০০ টাকা দিয়েছিল। তাদের উপবৃত্তির টাকা ও পরীক্ষার ফলাফল ভালো করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কামরুল।
এ বিষয়ে আদালতে স্পষ্ট স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে দুই ছাত্র সবুজ ইসলাম (১৭) ও রোকনুজ্জামান (১৭)। আদালত তাদের জবানবন্দি গ্রহণ শেষে কিশোর বয়স বিবেচনা করে যশোর শিশু-কিশোর সংশোধনাগারে আর দীপাকে রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। কামরুল বর্তমানে রিমান্ডে আছেন।
এদিকে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আরো একাধিক ব্যক্তিকে খুঁজছে পুলিশ। নিজ পরিবারের আরো কেউ জড়িত আছে কি না সেটাও খতিয়ে দেখছে পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা।
দীপা জানান, ২৯ মার্চ রাতে রথিশ বাসায় আসলে তাকে ভাত ও দুধের সঙ্গে ১০টি ঘুমের বড়ি খাইয়ে দেয়। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অচেতন হয় পড়ে। আগে থেকে বাসার পেছনে থাকা কামরুলসহ রথিশকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। এরপর তার পরনে থাকা লুঙ্গি ও গেঞ্জি বদলে প্যান্ট ও শার্ট পরানোর পর আলমারির ভেতরে ঢুকিয়ে রাখা হয়। সকালে কামরুল বাসা থেকে বেরিয়ে একটি রিকশাভ্যান ভাড়া করে এনে আলমারিটি তুলে নগরীর তাজহাট মোল্লাপাড়ায় অবস্থিত কামরুলের নির্মাণাধীন বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে আলমারিটি গর্তে ফেলে দিয়ে বালুচাপা দেয়া হয়।
এরপর ৩০ মার্চ দীপা সবাইকে জানান, সকালে তার স্বামী কাজের কথা বলে বাইরে গেছে দুপুর পর্যন্ত ফেরেনি। তার (রথিশ) মোবাইল ফোনও বন্ধ, যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।