মার্বেল চোখে আমাদের শুককুরবার

Slider লাইফস্টাইল

5b627_25241f4a7d_long

মো: আবু বক্কর সিদ্দিক সুমন  :

আমাদের সেকালের শুক্রবারেরা আসতো শুক্কুরবার হয়ে। এক একটা শুক্রবার আসতো এক এক খণ্ড ঈদবার হয়ে। বৈশাখের শুক্কুরবার আসতো কড়কড়ে রোদের মেড়মেড়ে বাবলার ছায়ায় কলাপাতার উপর ঝিনুকের মাঝ ফোটা বিশেষ অস্ত্রের ধার দিয়ে সবুজ কাঁচা আমের পিঠের চামড়া তুলে কচুকাটা করে লবণ-মরিচ মিশিয়ে খাওয়ার লুটোপুটিতে। শুক্কুর আসতো আঠাযুক্ত ফল পেপলটি গাছের দখল নেয়া না নেয়ার যুদ্ধে, ঘুড়ির লেজের বর্ণময় কারুকার্যের ব্যস্ততায়, পাগলা হাওয়ার ক্ষিপ্রতার বিপরীতে শক্তহাতে নাটাই ধরে আকাশ দখলে রাখার প্রাণপণ চেষ্টায়।

শহুরে নামকরণের মধুমাস জ্যৈষ্ঠকে আমরা চিনতাম মৌঘ্রাণের মাতাল মাস, পাকা ফলের মাস হিসাবে। তখন আপেল আঙুরের এত আধিক্য ছিল না, বারো মাসের ফল ছিল গল্পের বস্তু, তাই জ্যৈষ্ঠ ছিল ফল উদযাপনের মাস। চারদিকে পাকা আম, লিচুর মৌ মৌ ঘ্রাণ নিয়ে শুক্রবার আসতো আলাদা আযোজনে, রোদ তাঁতানো গরমে অনির্দিষ্টকাল পকুর অথবা গাঙে স্নানের পর পাকা আমরসে পেটপুরে অখণ্ড  দুপুরের গাঢ় ঘুম ছিল অনিবার্য সুখ রুটিনে।

আবার ঝুম বৃষ্টির ধোঁয়াশায় ঝাপসা চারিদিক, বাকশপাতায় কিংবা টিনের চালে একটানা বৃষ্টির শব্দ, কানে তা লেগে থাকা আষাঢ়ের শুক্কুরেরা সাত সকালেই চলে আসতো সাপ-লুডুর মই বেয়ে টুপ করে। ঝমঝম থই থই বৃষ্টি মাথায় করে অবিরত অবসর নিয়ে শুক্কুর আসতো নিশ্চিন্ত নিরবিচ্ছিন্ন ক্যারাম খেলার উপলক্ষ হয়ে। গরম সদ্য ভাজা মুড়ির সাথে জাকের চানাচুর মরিচ আর পেয়াজের মাখামাখি,  আকাশ ভাঙা নিরন্তর পতিত জলরাশি মাথায় নিয়ে ফুটবলের হুল্লোড়মার্কা খেলা , অথবা খেলা শেষে কালাইর ডাল দিয়ে মায়ের রান্না খিঁচুড়ি আর বেগুন ভাজির অমৃত স্বাদ মাখা শ্রাবণের সেইসব শুক্কুরবার আসতো রংধনুর সাতরঙ্গা সুখ নিয়ে, আর মনে হতো হুট করেই চলে গেল বুঝি।

চোখ লাল না হওয়া পর্যন্ত পুকুরের পানিতে ঝাপুস ঝুপুস গোসলের স্বাধীনতা, পাকা তালের মাতাল করা নানা আয়োজন, প্রখর গরমে গাবগাছের শীতল ছায়ায় বাঁশের মাঁচায় বসে হাজারো আষাঢ়ে গল্পের আড্ডা, এ রকম নানা সুখের পসরা নিয়ে ভাদ্রের শুক্রবারেরা হাজির হতো আমাদের সেকালে। আমাদের সেকালে আশ্বিনের শুক্ররেরা আসতো কাশফুলের ধবধবে সাদা ঘোড়ায় চেপে রূপকথার গল্পের মতন, দিগন্ত জোড়া সবুজ আর সুনীল আকাশে ভেসে বেড়ানো চিলতে সাদা মেঘের সাথে কল্পনায় আমরা উড়তাম সেইসব সাদা ঘোড়ায় চেপে,  রাতে উন্মুক্ত উঠোনে খেঁজুরপাতার বিছানা  বিছিয়ে সটান চিৎ হয়ে পরিষ্কার ধবধবে কালো আকাশের চকচকে সাদা সাদা অগণন তারার মেলা দেখার আয়োজন নিয়ে আমাদের সেকালের আশ্বিনের শুক্কুরেরা আসতো।

হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়াহীন, সারাদিন থমথমে গুমোট মেঘলা আকাশবিহীন, গ্রীষ্মের গরমহীন, শীতের কনকনে ঠান্ডাবিহীন আমাদের কার্তিকের শুক্রবার আসতো মিষ্টি সোনামাখা রোদ সাথে নিয়ে, আমরা দূর্বাঘাসের ডগায় মুক্তার মতো জমে থাকা শিশির নিয়ে খেলতাম। খেলতাম চঁড়ুই পাখির বাসা খোঁজা ও ডিম গণনার খেলা। দাঁড়িয়াবান্ধা, গোল্লাছুট খেলার অধীনে থাকতো আমাদের কার্তিক শুক্কুরের সমস্ত বিকাল।

আমাদের সেবেলায় অগ্রহায়ণের শুক্কুরেরা আসতো শীতমাখা আদরের চাদর সঙ্গী করে, দিনময় থাকতো ব্যাডমিন্টনের ব্যস্ততা, খেলতাম  নানা খেলা সারাবেলা। অবিরত আনন্দে আমাদের তখনকার শুক্কুরদের কোনো কষ্টই ছিল না। পৌষের শুক্কুর আসতো সাত সকালে রাখাল মামার কাঁধে রাখা বাকের দুপ্রান্তে রসভর্তি ভাঁড়ের মধ্যে দুলতে দুলতে। দিনের শুরু হতো রোদ পিঠ করে বসে রসভর্তি বড় মগের ভিতর হালকা মুড়ি ছেড়ে পাটখড়ির পাইপে আয়েসি ভঙ্গিতে সুখটানের মধ্যে দিয়ে। তারপর  বাদশার মতো আয়েশি হয়ে আমরা খেতাম পুলি পিঠা, রসের পিঠাসহ নানা পদ, খেলতাম সারা দিনমান স্বাধীন মনে।

বাঘ কাঁপানো মাঘের শুক্র আমাদের কাছে লেপ কম্বলের নীচে ওমের আলস্যে নিয়ে আসেনি কখনও।  সূর্য জাগার আগেই জেগে যেতাম , লেপের ওমও আটকাতে পারতো না পাটখড়ি আগুন পোহানোর হাতছানি থেকে। কাকডাকা ভোরে শিশিরে পা ভিজিয়ে, কুয়াশায় গা ভিজিয়ে বরই-শিউলি আর সজনে ফুলে হাতের মুঠো ভরতে আমরা বেরিয়ে পড়তাম  সেইসব মাঘের শুক্রসকালে।

কোকিলের সুমধুর সুর, শিমূল-পলাশ-কৃষ্ণচূড়ার লালে লাল হয়ে যাওয়া আমাদের সেকালের পৃথিবীতে প্রতিটি ফাগুনের শুক্রবার আসতো আলাদা আলাদা রঙিন ব্যঞ্জনায়, উদাস হওয়ার সম্ভবত কোনো বয়স থাকে না, শিহরণ শুরু হওয়ার হয়তো কোনো নির্দিষ্ট কাল থাকে।

কখনও কখনও সাত সকালেই মাছ ধরার জাল, গামছা, বালতি নিয়ে ছোটবড় খাল-ডোবা এমনকি পুকুর সেঁচে মাছ ধরবার প্রস্তুতি দিয়ে শুরু হতো চৈত্রের সেকালের শুক্রদিন। একপুকুর পানি সেঁচে, এক হাঁটু কাদায় নেমে সারা সকাল আর দুপুরকে প্রায় বিকেলে ঠেকিয়ে, খলখলে জ্যান্ত মাছ নিয়ে  খিলখিলিয়ে যখন আমরা ফিরে আসতাম তখন সমস্ত শরীরে কাদামাটি মাখা সেই অর্ধভূত মার্কা আমাদের দেখতে কেমন লাগতো! সেটা মনে করে, একালের এই বিষণ্ন শুক্রবারেও আমার ভীষণ হাসি পাচ্ছে।

আর একটু বড়বেলায়, শুক্রবারেরা আসতো আরো রোমাঞ্চকর আর বিনোদনের পাখায় ভর করে, সেইসব দিন ছিল ঈদরঙিন। দল বেঁধে পাঞ্জাবী-টুপি পরে অন্তত শুক্রবারের নামাজ কেউ মিস করতাম না, স্বীকারে মোটেই জড়তা নেই, সেইসব দিনে নামাজ পড়তে যাওয়ার পথেই কখন ফিরে আসবো এই চিন্তা আর নামাজ পরবর্তী কল্পনায় অস্থির থাকতাম বেশি, নামাজরত অবস্থায়ও শয়তান কাটি দিয়ে যেত মনে, আজ কি রুবেল নাকি অন্য নায়কের ছবি হবে টেলিভিশনে, সপ্তাহে এই একটা দিনই প্রতিটি ঘর রুপান্তরিত হতো সিনেমা হলে। টেলিভিশন চালানো নিয়ে সবথেকে ঘোরতর আপত্তি তোলা বাড়ির দাদি বুড়িটাও পানের বাটায় শান দিয়ে পান সাজিয়ে অপেক্ষায় থাকতো ৩.২০-এর ছায়াছবি আর রাত ৮.২০-এর আলিফ লায়লা দেখার জন্য। সেইসব শুক্রদিনেরা আসতো সার্বজনীন উৎসবের দিন হয়ে।

একালে যেমন নাগরিক সভ্যতায়, কমিউনিটি সেন্টারের ব্যস্ততায় যেকোনো দিন যেকোনো উপলক্ষ উদযাপিত হয়। আমাদের সেকালে তেমনটি হতোনা কখনোই, বিয়ে থেকে সুন্নাতে খাৎনা কিংবা মৃত্যুবার্ষিকী সকল কিছুতেই ডাকা হতো শুক্রবারকে।

আমাদের সেকালের শুক্রবারেরাও আসতো মঙ্গল, শুদ্ধতা আর পবিত্রতার মূর্ত প্রতীক হয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *