বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৩টি রায়ে ১৪ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা প্রদান করা হয়েছে। গত ২৪ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোবারক হোসেনের রায়ের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনাল থেকে ১৩ তম রায় ঘোষণা করা হয়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ পুরোনো হাইকোর্ট ভবনে স্থাপন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। মামলার সংখ্যা বাড়ায় এবং বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ২০১২ সালের ২২ মার্চ একই ভবনে ছোট পরিসরে স্থাপন করা হয় ট্রাইব্যুনাল-২ । ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যে ১৩টি রায় আসে।
এছাড়া মামলা কার্যক্রম সমাপ্ত করে রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ আছে চারটি মামলা। শিগগিরই এ মামলাগুলো থেকে কয়েকটির রায় ঘোষণা আসবে এ বছরের মধ্যে-এমনটি আশা প্রকাশ করছেন প্রসিকিউশন টিমের সদস্যরা।
ভারপ্রাপ্ত চিফ প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী নতুন বার্তাকে বলেন, এখন পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল থেকে যে কয়টি মামলার রায় হয়েছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট। তবে আশা করেছিলাম সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। তারপরও আদালত বিচার বিশ্লেষণ করে যে রায় দিয়েছেন তা আমাদের মানতেই হবে।
তিনি বলেন, এতো অল্প সময়ে এতগুলো রায় পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। বিশ্বের কোনো আদালতই এই ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারেনি যা বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছে। এজন্য অবশ্য প্রসিকিউশন, তদন্ত সংস্থাসহ বিচার সংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে। অনেক রাত জেগে জেগে কাজ করতে হয়েছে। খুব শিগগিরিই বাকি রায়গুলো ঘোষণা করা হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন প্রসিকিউটর সৈয়দ হায়দার আলী।
এ বিষয়ে তদন্ত সংস্থার জ্যেষ্ঠ সদস্য সানাউল হক নতুন বার্তা ডটকমকে বলেন, ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার প্রায় পাঁচ বছরের মধ্যে ১৩টি মামলায় ১৪ জনের সাজা প্রদান একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
তিনি বলেন, এটা খুবই কঠিন কাজ ছিল। এই কাজ সফল করতে তদন্ত সংস্থাসহ সবাইকে নিরলস পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমরা এখনো কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, এখন থানা ও জেলা পর্যায়ে কাজ করছে তদন্ত সংস্থা। তবে জাতীয় পর্যায়ে বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাই গিয়াস কাদের চৌধুরী ও ওয়াহিদুল আলমের বিরুদ্ধে তদন্ত কাজ চলছে। তদন্ত সম্পন্ন হলে তার প্রতিবেদন আমরা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করবো।
এ ছাড়া ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ আরো কিছু মামলার তদন্ত কাজ শেষ করতে পারবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন এই তদন্তকারী কর্মকর্তা।
সব মিলিয়ে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন অথবা হতে যাচ্ছেন মোট ৫২ ব্যক্তি এবং সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামী।
রাজনৈতিক দল হিসেবে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াতের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হয়েছে। তবে আইন সংশোধনের জন্য তা অপেক্ষায় আছে।
এক নজরে ট্রাইব্যুনালের ১৩ রায়
ট্রাইব্যুনাল-১
এক. জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি (২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩)
দুই. জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের ৯০ বছরের কারাদণ্ড (১৫ জুলাই ২০১৩)
তিন. সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড (১ অক্টোবর ২০১৩)
চার. জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী মৃত্যুদণ্ড (২৯ অক্টোবর ২০১৪)
পাঁচ. পলাতক বিএনপির স্থানীয় নেতা জাহিদ হোসেন খোকনের মৃত্যুদণ্ড (১৩ নভেম্বর ২০১৪)
ছয়. ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মোবারক হোসেন মৃত্যুদণ্ড (২৪ নভেম্বর ২০১৪)।
ট্রাইব্যুনাল-২
এক. জামায়াতের সাবেক রুকন মাওলানা আবুল কালাম আযাদ মৃত্যুদণ্ড (২১ জানুয়ারি ২০১৩)।
দুই. জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন (৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩)।
তিন. জামায়াত নেতা মুহাম্মদ কামারুজ্জামান মৃত্যুদণ্ড (৯ মে ২০১৩)।
চার. জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহমান মুহাম্মদ মুজাহিদ মৃত্যুদণ্ড (১৭ জুলাই ২০১৩)।
পাচঁ. বিএনপি নেতা আব্দুল আলীম আমৃত্যু কারাদণ্ড (৯ অক্টোবর ২০১৩)
ছয়. পলাতক আশরাফুজ্জামান ও চৌধুরীর মঈনুদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড (৩ নভেম্বর ২০১৩)
সাত. জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড (২ নভেম্বর ২০১৪)
দুই ট্রাইব্যুনাল ১৩ মামলায় ১৪ জনের মধ্যে ১১ জনকে মৃত্যুদণ্ড, একজনকে যাবজ্জীবন, একজনকে ৯০ বছর ও একজনকে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।
সাজা প্রাপ্ত ১৪ জন আসামির মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পলাতক রয়েছেন- চারজন। বিচার চলাকালীন সময়ে মৃত্যুবরণ করেছেন একজন। রায়ের পর কারাবস্থায় মৃত্যু হয় দুজনের এবং রায় কার্যকর হয় একজনের।
আপিল মামলার কার্যক্রম
ট্রাইব্যুনাল থেকে রায় ঘোষিত ১৩টির মধ্যে এ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে এসেছে ৮টি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা।
এগুলোর মধ্যে তিনটি মামলার চূড়ান্ত রায় ঘোষিত হয়েছে। এসব রায়ের মধ্যে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কাদের মোল্লার সাজা বাড়িয়ে ফাঁসির আদেশ দেন আপিল বিভাগ, যা কার্যকর হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল থেকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেলেও সাঈদীর সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। অন্যদিকে কামারুজ্জামানের ফাঁসির দণ্ডাদেশ বহাল রাখা হয়েছে।
গোলাম আযম ও আব্দুল আলীম আপিল বিভাগে আপিল করলেও দণ্ড ভোগরত অবস্থায় স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন তারা। ফলে এসব আপিল অকার্যকর ঘোষণা করা হয়েছে।