নিখোঁজ মানুষ | পাত্রিক মোদিয়ানো (১৭) || অনুবাদ: মাসুদুজ্জামান

সাহিত্য ও সাংস্কৃতি

Missing_P_banglanews24_679236295‘নিখোঁজ মানুষ’ [মিসিং পারসন, ১৯৭৮] এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতে নেওয়া পাত্রিক মোদিয়ানোর ষষ্ঠ উপন্যাস। যুদ্ধ মানুষকে কতটা নিঃসঙ্গ, অনিকেত, আত্মপরিচয়হীন, অমানবিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে পারে, এটি হয়ে উঠেছে তারই চমকপ্রদ আলেখ্য। ‘রু দে বুতিক অবসক্যুর’ শিরোনামে ফরাসি ভাষায় লেখা উপন্যাসটির নামের আক্ষরিক অনুবাদ করলে দাঁড়ায় ‘অন্ধকার বিপনীর সড়ক’। ড্যানিয়েল ভিসবোর্ট ১৯৮০ সালে এটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এর প্রধান চরিত্র ডিটেকটিভ গাই রোলান্দ। রহস্যময় একটা দুর্ঘটনার পর স্মৃতিভ্রষ্ট গাই তার আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধানে নামে। ধীরে ধীরে তার সামনে উন্মোচিত হতে থাকে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা প্যারি কব্জা করে নিলে বন্ধুদের কাছ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং নিখোঁজ হয়। বন্ধুরাও নানা দিকে ছিটকে পড়ে। সমগ্র উপন্যাসটি সেদিক থেকে বিবেচনা করলে আসলে নিখোঁজ মানুষের গল্প। ১৯৭৮ সালে উপন্যাসটি অর্জন করে প্রি গোঁকুর্ত পুরস্কার। পাঠকদের উপন্যাসটি পাঠের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। এখানে উল্লেখ্য যে, এর আগে মদিয়ানোর কোনো লেখা বাংলায় অনূদিত হয়নি। ফরাসি উচ্চারণ এবং কিছু বাক্যাংশের অর্থ উদ্ধারে সাহায্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের ফরাসি ভাষার অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য। –অনুবাদক
___________________________________

১৬তম কিস্তির লিংক

একটা বিষয় পরিস্কার হয়ে গেল, আমার নাম তাহলে ফ্রেডি হাওয়ার্ড দ্য লুজ নয়। উঁচু ঘাসে আচ্ছাদিত লনের দিকে দৃষ্টি পড়লো, দেখলাম, লনের সীমান্ত ছুঁয়ে অস্তাচলগামী সূর‌্যের রেখা ধীরে ধীরে অপসৃত হয়ে যাচ্ছে। আমার আমেরিকান দাদির সঙ্গে হাতে হাত ধরে এই লনে আমি কখনও হাঁটিনি। এই “গোলকধাঁধায়” শিশু হিসেবে আমি কখনও খেলিনি। এই যে লোহার কাঠামো আর দোলনা, আমার জন্য এখানে স্থাপন করা হয়নি। সত্যি কী করুণ এই অনুভব!
“আপনি বলছেন, লোকটা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এসেছিলেন?”
“হ্যাঁ… কিন্তু আপনার বা আমার মতো সেই লোকটা ফরাসি বলতে পারতো…”
“আমি কি অনেক দিন তাকে এখানে দেখেছেন?”
“কয়েক দিন দেখেছি।”
“কি করে জানলেন যে তিনি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে এসেছিলেন?”
“কারণ একদিন আমি তাকে আনতে প্যারি গিয়েছিলাম, এখানে নিয়েও এসেছিলাম। তিনি প্যারির এমন একটা জায়গা থেকে তাকে তুলতে বললেন যেখানে তিনি কাজ করতেন… জায়গাটায় ছিল দক্ষিণ আমেরিকার দূতাবাস…”
“কোন দূতাবাস?”
“আপনি তো দেখি অনেক প্রশ্ন করছেন…”
যে পরিবর্তন আমার জীবনে ঘটেছিলো, তার সঙ্গে অনেকেই ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে পেরেছে। আমি তখন আর সেই পরিবারের সদস্য নই যে, পরিবারের সদস্যদের নাম সোস্যাল ডাইরেক্টরিতে নিয়মিত ছাপা হতো, ছাপা হতো ইয়ারবুকেও। কিন্তু একজন দক্ষিণ আমেরিকার লোক, যার উৎস জানা নেই, তাকে খুঁজে পাওয়া তো আরও কঠিন।
“আমার মনে হয় সে ছিল ফ্রেডির ছেলেবেলার বন্ধু…”
“লোকটা কি কোনো রমণীর সঙ্গে এখানে আসতো?”
“হ্যাঁ। দুই তিনবার এসেছেন। ফরাসি রমণী। দাদার মৃত্যুর পর ওরা চার জন এখানে একসঙ্গে আসতো…”
তিনি উঠে দাঁড়ালেন।
“আমরা কি ভেতরে যেতে পারি? ঠাণ্ডা লাগছে তো…”
রাত্রি প্রায় ঘনিয়ে আসছে এবং তখনি আবিষ্কার করলাম যে আমরা আবার ‘সামার ডাইনিং রুমে’ চলে এসেছি।
“এটা ফ্রেডির খুব প্রিয় রুম… ওই চার জন– ফ্রেডি, রাশিয়ান রমণী, দক্ষিণ আমেরিকার লোকটা আর সেই মেয়েটি সন্ধ্যা হলে এখানে এসে বসতেন…”
ডিভানটা দেখে মনে হলো জাফরি-কাটা এমন একধরনের ডিজাইন এতে সাঁটা হয়েছে যেন হীরের আকার পাওয়া অস্পষ্ট নরম ছায়ারা সিলিংয়ের ওপর নাচছে। আমি সেই সন্ধ্যায় ওই ঘরে যে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি উঠছিল, তাও ধরবার চেষ্টা করলাম।
“ওরা একটা বিলিয়ার্ড টেবিল এখানে পেতেছিল… বিশেষ করে ওই দক্ষিণ আমেরিকান লোকটার গার্লফ্রেন্ড বিলিয়ার্ড খুব পছন্দ করতো …. তিনি সবসময় খেলাটাতে জয়ীও হতেন… আমি এটা নিশ্চিত হয়েই বলছি, আমি তার সঙ্গে বেশ কয়েকবার খেলেছি… কত দিন হয়ে গেল, টেবিলটা তবু এখানেই আছে…”
অন্ধকার করিডোর দিয়ে তিনি আমাকে নিয়ে হেঁটে চললেন, তার হাতে ফ্লাশলাইট, আমরা টাইলের ডিজাইন করা এমন একটা হলঘরে এসে পৌঁছালাম যে ঘরের রাজকীয় সিঁড়িগুলো নিচ থেকে ওপরের দিকে উঠে গেছে।
“এটাই হলো মূল প্রবেশপথ…”
সিঁড়ির নিচেই দেখলাম বিলিয়ার্ডের সেই টেবিলটা পাতা। টেবিলটার ওপরে তিনি ফ্লাশলাইটের আলো ফেললেন। দেখলাম, মাঝখানে সাদা একটা বল, খেলাটাতে, মনে হলো, বিরতি চলছে, যে কোনো সময়ে আবার শুরু হতে পারে। গে অরলভ, অথবা আমি, অথবা ফ্রেডি, অথবা সেই রহস্যময় ফরাসি রমণী, যে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল, অথবা বব, সবাই লক্ষ্যভেদ করার জন্য টেবিলটার ওপর ঝুঁকে পড়ছেন।
“দেখেন, বিলিয়ার্ডের টেবিলটা এখনও এখানে আছে…”
ফ্লাশলাইটের আলো ফেলে রাজকীয় সিঁড়িগুলোকে চোখের সামনে তিনি দৃশ্যমান করে তুললেন।
“ওপরের অন্য ঘরগুলো ব্যবহৃত হয় না… সবকিছুই এখন সিল করে বন্ধ রাখা হয়েছে…”
আমি ভাবছিলাম ওপরে ফ্রেডির হয়তো একটা রুম আছে। বাচ্চাদের রুম, এরপর বইয়ের তাকসর্বস্ব কোনো তরুণের রুম, তার দেয়ালগুলোতে নানারকম ছবি সাঁটা, কেউ হয়তো জানেনই না, ওই ছবিগুলোর একটাতে হয়তো আমাদের চারজনকেই দেখা যাবে, অথবা আমাদের দুজনকে- ফ্রেডি আর আমি, হাতে হাত ধরা। লোকটা বিলিয়ার্ডের টেবিলটা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তার পাইপে আবার অগ্নিসংযোগ করলেন। আমি ওই অভিজাত সিঁড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না, কেননা সিঁড়িগুলো আর ওঠানামার জন্য ব্যবহৃত হয় না। ওপরের সবকিছুই এখন সিলগালা করে রাখা হয়েছে।
পাশের ছোট্ট দরোজা দিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম, তালার ভেতরে দুবার চাবি ঘুরিয়ে দরোজাটাকে তিনি বন্ধ করে দিলেন। চারিদিকে অন্ধকার।
“আমাকে প্যারির ট্রেন ধরতে হবে,” আমি তাকে বললাম।
“আমার সঙ্গে আসেন।”
“তিনি আমার হাতটা ধরলেন এবং আগের জায়গাটাতে ফিরে না আসা অব্দি চারপাশের দেয়ালগুলোকে পেরিয়ে আসতে থাকলাম। কাচলাগানো সামনের দরোজাটা তিনি খুললেন এবং একটা তেলের বাতি জ্বালালেন।
“অনেক আগেই বিদ্যুতের লাইনটা ওরা কেটে দিয়েছে… কিন্তু পানির লাইন কাটতে ভুলে গেছে…”
আমরা একটা ঘরে এলাম, ঘরের মাঝখানটায় বেশ অন্ধকার, এখানে আছে একটা কাঠের টেবিল এবং কয়েকটা বেতের চেয়ার। দেয়ালে কয়েকটা মৃত্তিকার ফলক এবং কিছু তাম্রপাত্র। জানালার ওপরে কাঠের তৈরি একটা শুকরের মাথা।
“আমি একটা কিছু দিতে চাই আপনাকে…”
একটা বাক্স দেখালেন তিনি।
“এই বাক্সের জিনিসগুলো ফ্রেডির… ওরা যখন এই পুরানো বাড়িটা বন্ধ করতে আসে তখন আমি কিছু জিনিসপত্র সরিয়ে রেখেছিলাম…”
কথাগুলো বলতে বলতে ভীষণ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন তিনি। আমার মনে হলো তার চোখ কান্নার আবেগে ছলছল করছে।
“আমি তার ভীষণ অনুরাগী ছিলাম… অনেক ছোটবেলা থেকে আমি তাকে জানতাম… তিনি ছিলেন একজন স্বাপ্নিক মানুষ। সবসময় আমাকে বলতেন, একটা রেসের নৌকা কিনবেন… প্রায়ই বলতেন : ‘বব, তুমি হবে ওই রেসের প্রথম সঙ্গী…’ ঈশ্বর জানেন তিনি এখন কোথায় আছেন… এখনও যদি বেঁচে থাকেন…”
“আমরা তাকে খুঁজে বের করবো,” আমি বললাম।
“আপনি জানেন, দাদির কারণে তিনি একেবারে উচ্ছন্নে গিয়েছিলেন…”
বাক্সটা নিলেন তিনি এবং সেটা আমার হাতে তুলে দিলেন। স্তিওপ্পা দ্য জাগারভের কথা আমার মনে পড়লো, তিনিও লাল একটা বাক্স আমাকে দিয়েছিলেন। এরকমটা ভাবা কঠিন নয় যে চকলেট, বিস্কুট অথবা সিগার ফুরিয়ে গেলেই সব বাক্সের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যায়।
“ধন্যবাদ, বাক্সটা দেওয়ার জন্য।”
“আমি আপনার সঙ্গে স্টেশন পর‌্যন্ত যাব।”
তিনি জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া একটা রাস্তা ধরলেন এবং ফ্লাশলাইটের আলোর রেখা বরাবর সামনের দিকে এগুতে থাকলেন। যদিও আমরা জঙ্গলের গভীর থেকে আরও গভীরে ঢুকে পড়ছি, তবু আমার মনে হলো পথটা কি তিনি হারিয়ে ফেলেছেন?
“আমি ফ্রেডির বন্ধুদের নাম মনে করবার চেষ্টা করছি। আপনি ছবিতে আছে এমন একজনের কথা বলছিলেন… দক্ষিণ আমেরিকার সেই লোকটার কথা…”
চাঁদের আলোয় ঝলমল করে ওঠা গাছের পাতা মাড়িয়ে আমরা একটা খোলা জায়গা পেরিয়ে এলাম। ছাতার মতো পাইন গাছ। যেহেতু চারদিকে তখন ছিল দিনের মতো ঝলমলে আলো, ফলে তিনি তার ফ্লাশলাইটটা নিভিয়ে দিলেন।
“ঘোড়ায় চড়ার জন্য অন্য এক বন্ধুর সঙ্গে ফ্রেডি এই জাযগাটায় আসতো… বন্ধুটি ছিলেন জকি… তিনি কি কখনই আপনাকে এই জকির কথা বলেননি?”
“না।”
“আমি তার নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না… লোকটা যে আমার খুব পরিচিত ছিলেন তাও নয়… তিনি সম্ভবত, যখন ওই বৃদ্ধ লোকটার, অর্থাৎ ফ্রেডির দাদার রেসের বাতিক ছিল, তখন তিনি তার জকি ছিলেন…”
“দক্ষিণ আমেরিকার লোকটাও কি ওই জকিকে চিনতেন?”
“অবশ্যই। তারা তো এখানে একসঙ্গেই আসতেন। জকিও অন্যদের সঙ্গে বিলিয়ার্ড খেলতেন… যদ্দুর মনে পড়ে তিনিই ফ্রেডির সঙ্গে সেই রাশিয়ান রমণীকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন…”
আমার ভয় হলো আমি হয়তো এসব কথা বিস্তৃতভাবে মনে করতে পারবো না। তার কথাগুলো মনে হয় এখনি নোট করা দরকার।
পথটা মসৃণভাবে ওপরের দিকে উঠে গেছে, যদিও হাঁটার ব্যাপারটা তেমন সহজ লাগছে না, কেননা পায়ের পাতায় জড়িয়ে যাচ্ছে মৃত পাতার স্তূপ।
“দক্ষিণ আমেরিকার লোকটার নাম কি আপনার মনে পড়ছে?”
“দাঁড়ান, একটু ভাবি… হ্যাঁ মনে পড়ছে…”
আমি বিস্কুটের বাক্সটাকে নিতম্বের সঙ্গে চেপে ধরে আমার উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করলাম। ভাবলাম, কি বলতে পারেন তিনি। হয়তো আমার মনে যেসব প্রশ্নের উদয় হয়েছে, তার কথার মধ্যে সেইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাব। খুঁজে পাব আমার নাম। অথবা জকির নাম।
আমরা রাস্তাটার কিনারে এসে দাঁড়ালাম, নিচেই স্টেশন চত্বর। নিওন লাইটের উজ্জ্বল আলোয় স্টেশনটার প্রবেশপথ, মনে হলো, একেবারে জনশূন্য হয়ে আছে। একজন সাইকেল আরোহী ধীরে ধীরে চত্বরটা পেরিয়ে গেলেন এবং স্টেশনের সামনে এসে থামলেন।
“এই তো মনে পড়লো… তার ডাক নাম ছিল… পেড্রো…”

রাস্তার কিনারে এসে দাঁড়িয়েছি। তিনি তার পাইপটা আবার বের করলেন এবং একটা অদ্ভুত ছোট্ট যন্ত্র দিয়ে তা পরিষ্কার করতে থাকলেন। মনে মনে আমি নামটা বার বার উচ্চারণ করতে থাকলাম, জন্মের সময় এই নামটাই আমার রাখা হয়েছিল। জীবনের একটা সময়ে সবাই এই নামে আমাকে ডাকতো, সঙ্গে সঙ্গে অতীত দিনের বেশকিছু মানুষের মুখ আমার মানসপটে ভেসে উঠলো। পেড্রো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *