কয়েক দিন আগেই ছেলে শাহীন মিয়ার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেন শাফিয়া বেগম। মায়ের ভাষায়, ‘ছেলের সঙ্গে ম্যালা কথা কইলাম। ছেলের কাছে জানতে চাইলাম, বাবা, বাড়িত আসবা কবে? ছেলে জানাইল, এক-দেড় মাস দেরি হইব।’ এ টুকু বলে শাফিয়া বেগম আর কথা বলতে পারেননি।
এক-দেড় মাস নয়, ছেলে আসলেই কবে বাড়ি ফিরবেন বা আদৌ ফিরবেন কি না, তাই নিয়েই এখন অনিশ্চয়তা। বর্তমানে শাহীন মিয়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) প্রায় অচেতন অবস্থায় রয়েছেন।
শাহীন মিয়া হলেন খুলনার প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) বস্ত্র প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী। গত শনিবার রাতে ময়মনসিংহের ভালুকায় একটি ছয়তলা বাড়ির তৃতীয় তলায় শক্তিশালী বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনি দগ্ধ হন। শুধু শাহীন মিয়া নন, এ ঘটনায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগের দীপ্ত সরকার ও হাফিজুর রহমান গুরুতর দগ্ধ হন। তাঁরাও এখন ঢাকা মেডিকেলের আইসিইউতে রয়েছেন। ঘটনাস্থলেই বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী তৌহিদুল ইসলাম মারা যান। তাঁর বাড়ি বগুড়া জেলার শাজাহানপুর উপজেলার শাজাহানপুর গ্রামে।
সোমবার দুপুরে কথা হয় শাফিয়া বেগম ও দগ্ধ ব্যক্তিদের অন্যান্য স্বজনের সঙ্গে। প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করছে, ত্রুটিযুক্ত গ্যাস-সংযোগ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে। ঘটনাটি যে কারণেই ঘটুক, স্বজনদের মন তো আর মানে না। দগ্ধ শিক্ষার্থীরাই ছিলেন পরিবারগুলোর আশার আলো। মাত্র কদিন পরেই তাঁদের পরিবারের হাল ধরার কথা ছিল। বিভাগে ফলাফলের দিক থেকেও এই চার শিক্ষার্থী ছিলেন সেরা। প্রথম ১০ জনের মধ্যে তাঁদের অবস্থান ছিল বলে জানিয়েছেন সহপাঠী ও শিক্ষকেরা।
আইসিইউর কনসালট্যান্ট চিকিৎসক মৌমিতা তালুকদার বলেন, দগ্ধ তিনজনের অবস্থাই আশঙ্কাজনক। এই মুহূর্তে কিছুই বলা সম্ভব নয়। শাহীন মিয়ার শরীরের শ্বাসনালিসহ ৮৩ শতাংশ পুড়েছে। ডান হাত ভেঙে গেছে। হাফিজুর রহমানের পুড়েছে শ্বাসনালিসহ ৫৮ শতাংশ আর দীপ্ত সরকারের শ্বাসনালিসহ পুড়েছে ৫৪ শতাংশ। এ দুজনকেই কৃত্রিমভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। তবে শাহীনকে এখনো কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাস দিতে হয়নি।
দগ্ধ শিক্ষার্থীরা শিক্ষানবিশ হিসেবে ভালুকা উপজেলার মাস্টারবাড়ি এলাকায় অবস্থিত স্কয়ার ফ্যাশন লিমিটেড নামের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করছিলেন। যে বাড়িতে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, তাতে ভাড়া ছিলেন এই চার শিক্ষার্থী। ফ্ল্যাটটি ছিল কারখানার কাছেই।
আইসিইউর বাইরে শাহীন মিয়ার মা শাফিয়া বেগম কথা বলছেন, আর তাঁর দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। চোখের পানি মোছার শক্তিও যেন তাঁর আর অবশিষ্ট নেই। শাহীন মিয়ার বাড়ি সিরাজগঞ্জ।
শাফিয়া বেগম জানালেন, তাঁর দুই ছেলে দুই মেয়ে। শাহীনের বাবা মারা গেছেন তিন বছর আগে। এক ছেলে বাবার দোকান সামলান। পরিবারটি তাকিয়ে ছিল শাহীন মিয়ার দিকে। শাফিয়া বেগম বলেন, ‘কত আশা ছিল এই ছেলেকে নিয়া। এহন তো…।’
নওগাঁর দগ্ধ হাফিজুর রহমানের বাবা কৃষিকাজ করেন। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে হাফিজুরের বড় ভাই রবিউল ইসলাম এইচএসসি পাস। তিনি বলছিলেন, ‘ভাইকে নিয়ে আমাদের বুকভরা আশা ছিল। আমাদের পরিবার দরিদ্র, তবে আমার ভাই পড়াশোনায় দরিদ্র ছিল না। মেট্রিক, ইন্টারে গোল্ডেন জিপিএ-৫সহ সব পরীক্ষায় ভালো ফল করেছে।’
মাগুরার দীপ্ত সরকারের ভাই নারায়ণ সরকারে ভাষ্য, ‘আমার ভাই তো বিভাগের সেকেন্ড বয়। বিভাগের ৬০ জনের মধ্যে সেকেন্ড। এক নম্বরের জন্য প্রথম হতে পারেনি।’ কথাটুকু বলে কিছুক্ষণ আর কথা বলতে পারেননি। নারায়ণ সরকার এমএ পাস করেছেন। তিনি জানালেন, তাঁদের চার বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা মারা গেছেন। ছেলের দুর্ঘটনার কথা শুনে মা অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন।
নারায়ণ সরকার জানালেন, কৃত্রিমভাবে শ্বাস নেওয়ার আগে দীপ্ত সরকারের সঙ্গে তাঁর একটু কথা হয়েছে। দীপ্ত বলেছেন, ‘দাদা, তুই চিন্তা করিস না, আমি ফিরে আসব।’ নারায়ণ সরকার বললেন, ‘আমরা এখন ভাইয়ের জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায় আছি। খরচ যতই লাগুক, ভাইকে তো বাঁচানো লাগবে।’
কুয়েটের বস্ত্র প্রকৌশল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মণি শংকর মণ্ডল জানালেন, আর মাত্র ২০ দিন পরে এপ্রিলের ২২ তারিখে এই শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন শেষ হতো। এঁরা সবাই ছিলেন মেধাবী।
আইসিইউর বাইরে দগ্ধ শিক্ষার্থীদের সহপাঠী ও শিক্ষকেরা কেউ কোনো স্বজনের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন, আবার কেউ রক্ত সংগ্রহের জন্য দৌড়াচ্ছেন। কেউ খোঁজ নিচ্ছেন রোগীদের। হাসপাতালের বাইরে থেকে ওষুধ কেনাসহ অন্যান্য খরচও তাঁরাই বহন করছেন।