যৌনকর্মে পাচার হচ্ছে রোহিঙ্গা কিশোরী

Slider ফুলজান বিবির বাংলা

99b1674703310221f1886a9206b6529d-5ab2318b2a398

ঢাকা:  আনোয়ারা তার ছদ্মনাম। বয়স ১৪। সহিংসতায় পরিবারের সবাই মারা যাওয়ার পর মিয়ানমার থেকে পালাচ্ছিল সে। গন্তব্য বাংলাদেশ। পথে এর-ওর কাছে সহায়তা চাইছিল। কয়েকজন নারী ভ্যানে করে আসছিল। তারা ওকে সুন্দর জীবনের আশ্বাস দিয়ে সঙ্গী করে নেয়। পরে একটি গাড়িতে তুলে দেয়। কিন্তু সুন্দর জীবনের সেই ঠিকানা খুঁজে পায়নি আনোয়ারা। কাছের শহর কক্সবাজারে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।

আনোয়ারা বলে, ‘এখানে আসার পর শিগগিরই দুজন ছেলে আসে। ওদের অশোভন প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তারা আমাকে ছুরি দিয়ে ভয় দেখায় এবং মারধর করে। এরপর তারা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে ধর্ষণ করে।’

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকাগুলোতে এ ধরনের ঘটনার কথা অহরহই শোনা যায়। এর প্রধান শিকার নারী ও কিশোরীরা। উন্নত ও নিরাপদ ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে কাজের কথা বলে তাদের যৌনকর্মে বাধ্য করা হয়।

মারাত্মক ঘনবসতিপূর্ণ ক্যাম্পে বিশৃঙ্খল পরিবেশ পাচারকারীদের সুযোগ যেন আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

এসব ঘটনা শোনার পর অলাভজনক সংস্থা ফাউন্ডেশন সেন্টিনেল ও বিবিসির একটি দল যৌথভাবে তা খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশে আসে। তারা বিদেশি ক্রেতা সেজে দালালদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। মুহূর্তেই আসতে থাকে একের পর এক প্রস্তাব। ফাউন্ডেশন সেন্টিনেল শিশুদের শোষণ ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দিয়ে আসছে।

১৪ বছরের মাসুদা (ছদ্মনাম) বলে, ‘এক নারী তাকে কাজের প্রস্তাব দিয়েছিল। তিনি রোহিঙ্গা। অনেক দিন ধরে এখানে আছেন। সবাই জানে তিনি মেয়েদের যৌন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আমরা তাকে চিনি। কিন্তু আমার কোনো উপায় ছিল না। আমার পরিবার নিখোঁজ, আমার টাকা নেই। মিয়ানমারে আমি ধর্ষণের শিকার হয়েছি। আমি আমার ভাইবোনদের সঙ্গে মাঠে খেলে বেড়াতাম। কিন্তু এখন আমি খেলা ভুলে গেছি।’

অনেক মা-বাবা কাঁদছেন—হয়তো আর কোনো দিন সন্তানের ডাক শুনবেন না। আবার সুন্দর জীবনের আশায় অনেক অভিভাবকের মুখে হাসি। একজন মা বলেই বসেন, এই ক্যাম্পের জীবনের চেয়ে ‘বাইরে যেকোনো জায়গায় ভালো’।

কিন্তু এই শিশুদের কোথায় নেওয়া হয় এবং কাদের মাধ্যমে নিয়ে যাওয়া হয়?

বিবিসির ও ফাউন্ডেশন সেন্টিনেলের যৌথ দলের কয়েকজন সদস্য যারা বিদেশি, তাঁরা গ্রাহক সেজে যৌনকর্মীর খোঁজ শুরু করেন। ছোট ছোট হোটেল ও সৈকত-সংলগ্ন মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই জোগাড় হয়ে যায় স্থানীয় দালালদের টেলিফোন নম্বর। রুমও ভাড়া পাওয়া যায়।

এই দলটি আগেই পুলিশকে সব জানিয়ে নেয়। বিদেশি এই গ্রাহকেরা ছোট মেয়ে, বিশেষ করে রোহিঙ্গা কিশোরী পাওয়া যাবে কি না, দালালদের কাছে জানতে চান। একজন দালাল বলেন, ‘আমাদের কাছে অনেক ছোট মেয়ে আছে, কিন্তু আপনারা রোহিঙ্গা মেয়ে চাচ্ছেন কেন? এরা খুব নোংরা।’

দালালেরা তাঁদের একের পর এক ছবি দেখাতে থাকে। এসব কিশোরীর বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছরের মতো। দালালেরা বলে, কিশোরীর কোনো অভাব নেই। একজনকে পছন্দ না হলে আরেকজন আছে।

অনেক কিশোরী দালালের পরিবারের সঙ্গে থাকে। যেদিন তাদের কোনো খরিদ্দার থাকে না, সেদিন তাদের দিয়ে ঘরের কাজ করানো হয়। দালালেরা জানায়, গ্রাহকদের মধ্যে বেশির ভাগই বাংলাদেশি। কিশোরীরা ‘হইচই’ করে বলে তাদের বেশি দিন রাখা হয় না।

বিবিসি দালালদের সঙ্গে তাদের কথাবার্তার রেকর্ড, ভিডিওসহ সব তথ্য-প্রমাণ স্থানীয় পুলিশের কাছে জমা দেয়। এরপর পুলিশ এসবের বিরুদ্ধ অভিযান চালাতে একটি দলকে দায়িত্ব দেয়। একজন পুলিশ স্থানীয় এক দালালকে চিনতে পারে।

ওই দালালকে ধরতে পুলিশের সহায়তায় নাটক সাজায় যৌথ দলটি। ফাউন্ডেশন সেন্টিনেলের এক কর্মী খরিদ্দার সেজে ছবি দেখানো হয়েছে, এমন দুজন কিশোরীকে হোটেলে নিয়ে আসতে বলেন ওই দালালকে।

তবে দালাল নিজে না এসে গাড়ির চালককে দিয়ে ওই দুই কিশোরীকে পাঠায়। টাকার লেনদেন শেষে পুলিশ চালককে গ্রেপ্তার করে। আর ওই কিশোরী দুটির সহায়তায় এগিয়ে আসে শিশুযত্নবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও ট্রাফিকিং বিশেষজ্ঞরা। তবে তাদের মধ্যে একজন আশ্রয়কেন্দ্র যেতে অসম্মতি জানায়, ১৫ বছরের অন্যজন রাজি হয়।

পাচারকারীরা কম বয়সী নারী ও কিশোরীদের বেছে নেয়। প্রথম আলো ফাইল ছবিএই দুই কিশোরী দারিদ্র্য ও যৌনবৃত্তির বেড়াজালে পড়ে আছে। তারা বলে যৌনকর্মের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ ছাড়া নিজেদের ও পরিবারকে সাহায্য করার আর কোনো পথ তাদের নেই।

আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় পর্যায়ে নারী ও শিশু পাচারে খুব শক্তিশালী নেটওয়ার্ক দরকার হয়। এ ক্ষেত্রে ইন্টারনেটকে অন্যতম পন্থা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রোহিঙ্গা কিশোরীদের বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, নেপালের কাঠমান্ডু ও ভারতের কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

ঢাকায় সাইবার ক্রাইম ইউনিট দেখিয়েছে, কীভাবে ইন্টারনেটের সহায়তায় পাচারকারীরা মেয়েদের পাচার করে। বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপ ও গোপন ওয়েবসাইট এসব কাজ করে। এমন ওয়েবসাইটও পাওয়া যায়, যেখানে কীভাবে রোহিঙ্গা মেয়েদের ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে ধাপে ধাপে তথ্য দেওয়া হয়েছে। তবে পুলিশ ওয়েবসাইটটি সরিয়ে ফেলেছে।

এই রোহিঙ্গা সংকটটি বাংলাদেশে যৌন-বাণিজ্য গড়ে তুলেছে—বিষয়টি এমন নয়, কিন্তু যৌনকর্মী হিসেবে নারী ও শিশু পাচারের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *